ভূমিকম্পের বড় ধাক্কায় টিকতে পারবে না ঢাকা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৫, ০৮:১১ পিএম
ভূমিকম্পের বড় ধাক্কায় টিকতে পারবে না ঢাকা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকার ভূমিকম্প-সহনশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূকম্পনকে কেন্দ্র করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অনুমোদনহীন ভবন আর দুর্বল মাটির গঠন-সব মিলিয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে ঢাকা। এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

ঢাকার জন্য রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পে করা এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে ভবনের সংখ্যা ২১ লাখ ৪৫ হাজার। ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—বেশির ভাগ ভবন নির্মাণে জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড মানা হয়নি। অনুমোদিত নকশার বাইরেই গড়ে উঠেছে ৯৫ শতাংশ ভবন।

রাজউকের হিসাবে চলতি বছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার অবৈধ ভবন শনাক্ত করা হয়েছে। বসিলা, ঢাকা উদ্যান ও কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের বহু এলাকায় অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে শত শত ভবন। মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপের তথ্যমতে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ঢাকায় বছরে গড়ে ৯৫ হাজার স্থাপনা গড়ে উঠেছে, কিন্তু রাজউক থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে মাত্র চার হাজারটির কিছু বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে বহুতল ভবন, বস্তি, সরু রাস্তা—সব মিলিয়ে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ভয়াবহ আকারে বাড়িয়েছে। ঢাকার মাটির প্রকৃতি আলগা ও জলাবদ্ধ হওয়ায় বড় কম্পনে মাটি তরলীকৃত হয়ে ভবন ধসের আশঙ্কা আরও বাড়ে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় করা এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভবনই ২০ থেকে ৩০ বছর আগে নির্মিত। কোথাও নির্মাণসামগ্রীর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, কোথাও নকশার বাইরে গিয়ে নির্মাণ। ফলে সামান্য কম্পনেও এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

শুক্রবারের ভূমিকম্পে রাজধানীর ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মালিবাগ, আরমানিটোলা, বনানী, বসুন্ধরা, খিলগাঁও, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভবনে ফাটল দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় ভবনগুলোর ভূমিকম্প-সহনীয়তা পরীক্ষার মতো পর্যাপ্ত জনবল বা যন্ত্রপাতি নেই রাজউকের কাছে। অনুমোদনহীন ভবনের সঠিক সংখ্যাও তাদের জানা নেই। খাল-বিল দখল করে কত ভবন হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়। পরিকল্পনা না থাকায় এবং কোড বাস্তবায়নে দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক মনে করেন, ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে যে ধাক্কা দেখা গেছে, তাতে বোঝা যায় ৭ মাত্রার কম্পনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হলে ভবনধস ও হতাহতের পরিমাণ খুব বেশি হতে পারে।

রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সাবেক পরিচালকও মনে করেন, ঢাকার ভবনগুলো ন্যূনতম মান বজায় না রেখেই গড়ে উঠেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে রিস্ক সেনসিটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান করা হলেও ভবন নিরাপত্তা মূল্যায়নের কার্যকর প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মনে করিয়ে দেন, ঢাকা শহরে নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত খোলা জায়গা নেই। ভূমিকম্পে আতঙ্কে মানুষ বেরিয়ে এলেও অধিকাংশ এলাকায় খোলা জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, বিল্ডিং কোড, ইমারত বিধিমালা, ড্যাপ—সবই আছে, কিন্তু বাস্তবায়নে দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি পরিস্থিতিকে কার্যত অকার্যকর করে রেখেছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব না হলেও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন তালিকাভুক্ত করে অপসারণ করতে হবে। নিম্নাঞ্চলে নির্মাণ নিষিদ্ধের পাশাপাশি জলাধার ও বেসিন এলাকায় ভরাট বন্ধ করতে হবে।

রাজউক ৩ হাজার ৩৮২টি বিধিবহির্ভূত ভবন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানা গেছে। শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর রাজউকের কর্মকর্তারা মাঠে নেমে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করছেন।

২০২২ সালে প্রকাশিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সম্প্রতি সংশোধনের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। নতুন পরিকল্পনায় রাজধানীকে ৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে, ঢাকার পরিসর কমিয়ে এক হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার করা হয়েছে।

নতুন বিধিমালায় বহু এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফলে আগে যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা যেত, এখন সেখানে ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত অনুমতি মিলবে। প্লটে খোলা জায়গা যত বেশি থাকবে, ভবনের উচ্চতায় তত বেশি ছাড় দেওয়া হবে।

এ ছাড়া খসড়া বিধিমালায় অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট একবার নিলেই আজীবনের জন্য বৈধ থাকবে। পাঁচ কাঠা বা তার বেশি জমিতে এসটিপি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনুমোদন ফি দিতে হবে সুপারিশ পাওয়ার পর, এবং আবেদন নিষ্পত্তির সময় ৪৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৮০ দিন করা হয়েছে।

গত ১৫ বছরে ঢাকার কাছাকাছি ফরিদপুর এলাকায় দুইবার ৪-এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প নথিবদ্ধ হয়েছে। ২০১০ সালে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প ছিল ঢাকার নিকটবর্তী সবচেয়ে শক্তিশালীগুলোর একটি। এর আগে ১৮২২, ১৮৮৫ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সবশেষ শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার কম্পনের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বারবার ভূমিকম্প ঢাকাকে সতর্ক করছে—বড় ধাক্কা সামনে অপেক্ষা করছে। এখনই পরিকল্পনা ও কঠোর নজরদারিতে না ফিরলে রাজধানী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে।

Link copied!