জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ভাষণে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে আছে- গণভোট, সংসদের উচ্চকক্ষ ও সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি পরিষদ গঠন।
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এগুলোর ধরন ও কার্যকর হওয়ার ধাপ সম্পর্কেও উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হলো- গণভোটের ব্যালটে একটি প্রশ্নের সঙ্গে যে চারটি বিষয় উল্লেখ থাকবে সেগুলোর অর্থ কী। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ভোট জয়ী হলে কি হবে? সংবিধান সংস্কার পরিষদের কাজ কী। সংসদে উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠন হবে?
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ অনুযায়ী, গণভোট অনুষ্ঠিত হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। তিনি ভোটের তারিখ উল্লেখ করেননি। এই তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। আবার একজন ভোটার ব্যালটে সিল মেরে হ্যাঁ-না ভোট দিবেন নাকি আলাদা বক্সে (হ্যাঁ/না সম্বলিত) ব্যালট ফেলে মতামত জানাবেন সে সম্পর্কেও নির্বাচন কমিশন পরে প্রচার চালাবে।
গণভোটের ৪ বিষয় ও প্রশ্নের অর্থ
মূলত ব্যালট পেপারে থাকা চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই মূল প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছে। প্রশ্নটি জানার আগে দেখা যাক চারটি বিষয় কোনগুলো।
ক. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ. সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
এগুলোর ওপর ভিত্তি করে যে প্রশ্নটি তৈরি করা হয়েছে সেটি হলো- ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
অর্থ্যাৎ, উল্লেখিত চারটি বিষয়েই যদি আপনি সম্মত হন তাহলে প্রশ্নটির উত্তরে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেবেন। আর চারটি বিষয়েই অসম্মত হলে দেবেন ‘না’ ভোট। এখানে উল্লেখ্য, চারটি বিষয়ের একটি-দুটিতে সম্মত কিংবা অসম্মত হওয়ার সুযোগ নেই। হ্যাঁ ভোট দেওয়ার অর্থ দাঁড়াবে- আপনি চারটি বিষয়েই সম্মত হয়েছেন। বিপরীত অর্থ দাঁড়াবে না ভোট দিলে।
ভোটের ফলের প্রভাব
ভোটে যদি ‘হ্যাঁ’ জয়ী হয় তাহলে জুলাই জাতীয় সনদের একমত হওয়া প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হবে। এই কাজ করবেন সংসদ নির্বাচনে জয়ী এমপিরা। সংসদের অধিবেশন শুরুর ১৮০ দিন পর্যন্ত তারা ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ এর সদস্য হিসেবে পরিচিত হবেন। অর্থ্যাৎ, জুলাই সনদে একমত হওয়া বিষয়গুলোর আলোকে তারা সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবেন।
এটি একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। গণভোটের ব্যালটে যে চারটি বিষয় থাকবে বলে শুরুতে উল্লেখ করেছি; সেটির একটি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে। বর্তমান সংবিধানের চতুর্থ ভাগে ‘প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ’ অংশে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমার কথা উল্লেখ নেই। গণভোটে হ্যাঁ ভোট জয়ী হলে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। তখন সেখানে যুক্ত করা হবে ‘একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যত বারই হোক সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন।’ এই মেয়াদ সংক্রান্ত বিষয়টি উল্লেখ আছে জুলাই জাতীয় সনদে। এই যে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া; এটি বাস্তবায়ন করাই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ এর দায়িত্ব।
পরিষদ কি সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য
হ্যাঁ। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে গণভোটের যে চারটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, সেখানে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে। আবার গণভোটের ব্যালটেও এটি উল্লেখ থাকবে। সেটি হলো- সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ জুলাই জাতীয় সনদের যে ৩০টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠন হবে
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে দেশে প্রথমবারের মতো সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন, উচ্চকক্ষের সদস্য হবেন ১০০ জন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে এই সংখ্যক সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে।
আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। ধরুন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১০ কোটি। এর মধ্যে ‘ক’ নামের দল পেয়েছে ৫ কোটি বা ৫০ শতাংশ। তাহলে উচ্চকক্ষে এই দলের প্রতিনিধি সংখ্যা হবে ৫০। আবার ‘খ’ নামের দল পেয়েছে ভোট প্রদত্ত ভোটের ১ শতাংশ। তাহলে উচ্চকক্ষে তাদেরও একজন প্রতিনিধি থাকবেন। ১ শতাংশের কম ভোট পেলে সেই দলের প্রতিনিধি উচ্চকক্ষে থাকবে না।
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চকক্ষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিম্নকক্ষের কাছে আইন প্রণয়নের জন্য প্রস্তাব দিতে পারবে। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া সব ধরনের বিল (অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে) অনুমোদনের জন্য উচ্চকক্ষে পাঠানো হবে। উচ্চকক্ষ সেটি দুই মাসের বেশি আটকে রাখলে ধরে নেওয়া হবে বিলটি পাস হয়েছে।
সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত যেকোনো বিল উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করতে হবে।
‘না’ ভোট জয়ী হলে যা হবে
দেশে আগের যে তিনটি গণভোট হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটিতে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়েছে। ফলে ‘না’ ভোট জয়ী হলে কি হয়েছে- সেরকম উদাহরণ নেই। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টাও তাঁর ভাষণে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি।
তবে গত ২৮ অক্টোবর এ নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে হওয়া এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘গণভোটে পাস না হলে গণভোট পাস হবে না। তার মানে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।’ অর্থ্যাৎ, এই প্রক্রিয়ার সেখানেই ইতি ঘটবে।






























