পরাধীন দেশের শাসনব্যবস্থা একটা মিথ্যাকে আশ্রয় করিয়া গড়িয়া ওঠে, আর পরাধীন দেশের মানুষও সমান একটি মিথ্যার ভাষায় তাহার জবাব দেয়।
-ফ্রানৎস ফানোঁ, দুনিয়ার মজলুম (পারি: লা দেকুবেরত, ২০০২), পৃ. ৫২।
Au mensonage de la situation coloniale, le colonisé repond par un mensonage égal.
—Frantz Fanon, Les damnés de la terre (Paris: La Découverte, 2002), p. 52.
এ বছর-মানে ২০১৯ সালের-জুলাই মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করিয়াছিলেন। সম্মেলনে কয়েকজন ভারতীয় আর দুয়েকজন মার্কিন অতিথির আগমন ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটির মর্যাদাও রক্ষা করিয়াছিল। এই সম্মেলনে যুক্ত হইবার সৌভাগ্য বর্তমান লেখকেরও হয়। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি ছিল তাহা এতদিনে আমার আর পুরাপুরি মনেও নাই। কিন্তু আমাকে যে বিষয়ে বলার আদেশ দেওয়া হইয়াছিল তাহার মধ্যে সুশাসন (বা তাহার ইংরেজি পরিভাষা ‘গবর্নেন্স’) শব্দটিও ছিল। সেই বক্তৃতার স্মৃতি-রোমন্থন করিয়া আজিকার এই ক্ষুদ্র নিবন্ধটি লিখিতে হইতেছে।
১.
বক্তৃতার শুরুতেই নিবেদন করিয়াছিলাম-পরাধীন দেশে সুশাসন সম্ভব নহে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছিল ‘কেন নহে?’। উত্তরে আমি আমার প্রিয় একজন বিজ্ঞলোকের রচনা হইতে যুক্তি আহরণ করিয়াছিলাম। প্রশ্ন উঠিয়াছিল-সে তো অতীতের কথা, অধিকন্তু কাহিনীটাও বিদেশের। স্বভাবতই নতুন প্রশ্ন দেখা দেয়-আমাদের দেশের মতন দেশে বর্তমানে সুশাসন নাই কেন? এই নিবন্ধে আমি এই দুটি প্রশ্নের বিস্মৃতিচারণ করিলাম। কুড়ি মিনিটের আন্তর্জাতিক আসরে সামান্য কথা বিশেষ করার সুযোগ পাওয়া মুশকিল। এখানেও তাহার ব্যতিক্রম হইবে না।
গোড়াতেই ফিরিয়া যাই। আমার প্রিয় বিজ্ঞলোকটির নাম ফ্রানৎস ফানোঁ (১৯২৫-১৯৬১)। এক সহকর্মীর সহিত মিলিয়া তিনি ফরাশি দেশের নিস্ শহরে ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে একটি ছোটখাট নিবন্ধ উপস্থিত করিয়াছিলেন। নিবন্ধের নাম ‘উত্তর আফ্রিকায় অপরাধ-স্বীকার’। বলিয়া রাখা ভালো, ফ্রানৎস ফানোঁ ছিলেন পেশায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার-বিশেষ মনোরোগের চিকিৎসক। ১৯৫৩ সনের কথা। ফরাশি মুলুকে পড়াশুনা শেষ হইলে তিনি চাকরি উপলক্ষে উহাদের উপনিবেশ আলজিরিয়ায় গমন করিলেন। তিনি নিযুক্তি লাভ করিয়াছিলেন আলজিয়ার্স নগরীর অদূরে ব্লিদা নামক একটি ক্ষুদে শহরের মানসিক হাসপাতালে।
ফানোঁ যখন চাকরি ব্যপদেশে আলজিরিয়ায় পা রাখিতেছেন তখন সে দেশে ফরাশি শাসনের একশ বছরেরও অধিক সময় পার হইয়াছে। পরাধীনতা-ব্যবসায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সেখানে একটা মজার-একই সঙ্গে উদ্বেগজনক-প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছিলেন। সেই ঘটনার মাধুরী-মেশানো একটা জবাবও তাঁহাদের রচনা করিতে হইয়াছিল। তাই প্রশ্নের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ভিন্ন জবাব খাড়া করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন ফ্রানৎস ফানোঁ।
আগে প্রশ্নটা নিবেদন করি। আলজিরিয়ায় বসতি স্থাপনকারী কোন এয়ুরোপিয়া অপরাধীকে গ্রেপ্তার করিবার পর যদি তাহাকে যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণের মুখোমুখি করা হইত-তখন তিনি ঝরঝর করিয়া আপনকার কৃত অপরাধটা স্বীকার করিতে কসুর করিতেন না। অথচ আরব প্রজাসাধারণের মধ্যে কেহ যদি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হইতেন-তাঁহার সামনে যদি সমস্ত দুনিয়ার অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণও হাজির করা হইত-তবু তিনি অপরাধটা স্বীকার করিতেন না। এমন কি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টাও বড় একটা করিতেন না তিনি। এইসব বিষয়ে পুলিশের লোকজন সচরাচর যাহা বলিয়া থাকেন শেষ পর্যন্ত তাহাই খবরের কাগজের খোরাক হইয়া থাকে। আর এই ভোজ্যতেলেরই অপর নাম দাঁড়ায় জনমত। জনসাধারণের চিন্তা বলিয়া তো কিছু নাই। আছে শুদ্ধ জনমত। সেই এয়ুরোপিয়া জনমত অনুসারে, আরবেরা জন্মের দোষেই মিথ্যা বলে। এই দোষ তাহাদের প্রকৃতিগত। আরবজন্মই ইহাদের মিথ্যা বলিবার কারণ। যাহাদিগকে বলা হয় ‘আদিম সমাজ-বিশেষজ্ঞ’ তাঁহারাও হামেশা বলেন, শুদ্ধ আরবদেশে কেন এই দুনিয়ায় যত আদিম কি বর্বর-এক কথায় ‘অনুন্নত’-সমাজ আছে তাহাদের সবগুলিতেই এই রোগের বিকাশ ঘটিয়াছে। এই অপরাধ অস্বীকারের প্রবণতা অনুন্নত জাতির মন হইতেই জাগ্রত হইয়া থাকে। এই দোষ আদিমতার।
ফ্রানৎস ফানোঁ যে হাসপাতালে চাকরি করিতেন তাহা হইতে গোটা তিরিশ মাইল দূরে আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স। সেখানে আরো বড় একটি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র। ইহার প্রধান বিশেষজ্ঞের নাম আঁতোয়ান পোরো। পোরো-অন্য এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলিত হইয়া একবার-১৯৩২ সাল নাগাদ-লিখিয়াছিলেন, আরবদের এই অপরাধ-প্রবণতা জিনিশটার পিছনে একটা বিকাশ-কাহিনী, একটা ইতিবৃত্ত, একটা পাশবিকতা এবং একটা বর্বরদশা বা বন্যপ্রকৃতি খুঁজিয়া পাওয়া যায়। প্রথম প্রথম জিনিশটা ভারি বিস্ময়কর ঠেকে। তবে ঘটনাগুলি ঘটে বিশেষ ধরণের আবেগ-প্রবণতার দোষে। এই দোষ জাতিগত। পোরো লিখিতেছেন, তিনি গত দশ বছরের মধ্যে (১৯২২-১৯৩২) আলজিরিয়ায় মোট পঁচাত্তরজন দেশীয় অপরাধীর মানসিকতা পরীক্ষা করিয়াছেন, দেখিয়াছেন তাহাদের মধ্যে একষট্টিজন কোন প্রকারের জ্ঞাত কারণ ছাড়াই খুনখারাবি করিয়াছেন কিংবা খুনজখম করিবার চেষ্টা করিয়াছেন।
ফ্রানৎস ফানোঁর অভিজ্ঞতাও অনুরূপ। মনোরোগের চিকিৎসক পরিচয়ে তাঁহাকেও অপরাধীদের নথিপত্র যথেষ্ট দেখিতে হইয়াছিল। তাঁহার ঘাঁটা নথিপত্রেও দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রথম প্রথম পুলিশের সামনে অপরাধ-স্বীকার করিয়াছিলেন কিন্তু কিছুদিন হাজতবাস করিবার পর তিনিই আবার সেই স্বীকৃতি প্রত্যাহার করিয়া লইতেছেন। শুদ্ধ তাহাই নহে, তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করিতেও চেষ্টা বিশেষ করিতেছেন না। ডাক্তার ডাকা হইতেছে অপরাধীর মানসিক সুস্থতা আছে কিনা তাহা যাচাই করিবার জন্য। দেখা যাইতেছে, তিনি অন্যভাবে মোটেও অসুস্থ নহেন।
২.
সে সময় আলজিরিয়ার আরবদের সচরাচর দুই দলে ভাগ করা হইত। একদল সমতলবাসী বা আরব-অন্যদলের নাম কাবিল বা পাহাড়ি। এই পাহাড়িদের মধ্যে দেখা গিয়াছে মোট কুড়ির মধ্যে গোটা ষোলজনই অপরাধ অস্বীকারকারীর দলে পড়ে। প্রকাশ থাকে, এইসব অপরাধ সংঘটিত হইয়াছিল বিদেশি দখলদারদের বিরুদ্ধে নহে, সকলই ঘটিয়াছিল স্বদেশের কোন না কোন লোকের বিরুদ্ধে-এমন কি ঘনিষ্ট আত্মীয়দের মধ্যে-কখনও উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে, কখনও বা জোতজমি বেচাকেনার বিরোধে, আর কখনও বা স্বামীস্ত্রীর পরস্পরে অবিশ্বাসী হইবার কারণে কি অজুহাতে।
ফ্রানৎস ফানোঁ সমস্যাটা আরও প্রাঞ্জল করিতেছেন এইভাবে। বেশির ভাগ ঘটনায় দেখা গিয়াছে-প্রথম দিকে-তদন্ত কর্মকর্তাদের সামনে অপরাধী ব্যক্তি সহজেই নিজের অপরাধটা স্বীকার করিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি যে অপরাধটা সংঘটন করিয়াছেন তাহার কারণ আর যেভাবে ঘটনাটা ঘটাইয়াছেন তাহার বিবরণ-এমন কি ঘটনাপরম্পরার একটা ধারাবাহিক বয়ানও-পেশ করিতে কসুর করেন নাই। তদন্ত যতদিন চলিতেছিল ততদিন দৃশ্যত তাহার মনোভাবও তেমন একটা বদলায় নাই।
কিন্তু একসময় (সচরাচর বন্দীত্ববরণের এক কি দুই মাসের মধ্যে) অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বীকারোক্তিটা প্রত্যাহার করিয়া লইতেন। তাহার আগেকার স্বীকার করা একটি কথাও তিনি এতক্ষণে আর সত্য বলিয়া স্বীকার করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলেন, পুলিশের চাপে-অর্থাৎ নির্যাতনের ভয়ে-দোষ-স্বীকার করিয়াছিলেন তিনি। এই অস্বীকৃতিটা যখন প্রবল হইতে প্রবলতর হইয়া উঠিত-তখন তাহাকে বলা হইত, ‘প্রমাণ করুন, আপনি নির্দোষ’। বিস্ময়ের বিষয়, তখন তাহা করারও কোন বিশেষ উদ্যোগ দেখা যাইত না ঐ ব্যক্তির পক্ষে। শুদ্ধমাত্র দাবি করিতেন তিনি নির্দোষ। প্রমাণের দায় তাহার নয়। তিনি তো আইনের হাতে সোপর্দই হইয়াছেন। আইনে যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন তো তাহাকে তাহার প্রাপ্য দণ্ডই দেওয়া হউক। সবকিছুই মানিয়া লইতে প্রস্তুত তিনি। কারণ সকলই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহু আকবর। আল্লাহ সকলের বড়।
ফ্রানৎস ফানোঁ বলিতেছেন, এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অবস্থা কাহিল। দেখা যাইতেছে, অপরাধী বলিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিটি ষোল আনাই সুস্থ। তাহার মাথায় কোন ছিট নাই। মাথা একদম ঠাণ্ডা।
ফানোঁ জানেন, কোন অপরাধীকে শাস্তি দিতে হইলে দোষ-স্বীকার তাহার করিতেই হইতে হইবে-এমন কোন ধরাবাঁধা কথা কিন্তু নাই। দোষ প্রমাণের জন্য খোদ অভিযুক্তের দোষ-স্বীকারটা মোটেও অপরিহার্য নহে। অবশ্য এহেন অস্বীকৃতিকে হালকাভাবে নিতে পারেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। একজন সম্পূর্ণ সুস্থ সপ্রতিভ মানুষ একমুখে দুই কথা বলিতেছেন। নথিতে আছে তিনি একদা দোষ-স্বীকার করিয়াছিলেন আর এক্ষণে তিনি-আদ্যোপান্ত সেই জীবন্ত মানুষটাই-বলিতেছেন, তিনি বিন্দুমাত্র অপরাধ করেন নাই। ইহা একটা বস্তুজগত অতিক্রান্ত দার্শনিক সমস্যা বটে। শাস্তি দেওয়াটাই শেষ কথা নহে। কিন্তু অপরাধটা কি কারণে ঘটিয়াছিল তাহা তো আর বোঝা যাইতেছে না অর্থাৎ অপরাধীরও যে একটা সত্যকাহিনী আছে তাহা জানা সুদূরপরাহত হইয়াছে।
ফ্রানৎস ফানোঁ জিজ্ঞাসা করিতেছেন, যে রাষ্ট্রশক্তি এই স্থানীয় মুসলমান লোকটিকে গ্রেপ্তার করিয়াছে, সেই লোকটি কি আদপেই এই রাষ্ট্রশক্তির কর্তৃত্ব মানিয়া লইয়াছিলেন? তিনি কি আদৌ তাহাদের সহিত কোন সমাজ-বন্ধনের চুক্তি সম্পাদন করিয়াছিলেন? কোন মানুষ যখন কোন অপরাধ সংঘটন করেন তখন তিনি শুদ্ধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেন না, গোটা সমাজ সংগঠনের বিরুদ্ধেই তাহার অপরাধ সংঘটিত হয়। এই লোকটির কি সমাজের কাছে তেমন কোন দায় আছে? যদি থাকে তবে সেই দায়টাই বা কাহার কাছে? দখলদার এয়ুরোপিয়া সমাজের কাছে? না, পরাধীন আরব সমাজের কাছে? এই অবস্থায় তাহার কৃত অপরাধের অর্থটা কি দাঁড়াইতেছে? কি অর্থ দাঁড়াইতেছে ফরাশি পুলিশের তদন্তকর্মের-আর পরিশেষে কি অর্থই বা আছে আদালত কর্তৃক তাহাকে দণ্ড দেওয়ার?
আমরা আগেই দেখিয়াছি, পুলিশ-সাধারণের অভিমত আর ভদ্র জনসাধারণের মতামত-অর্থাৎ লোকটা কি কারণে মিছাকথা কহিতেছে এই অনুমানটা-এই ক্ষেত্রে কোন সাহায্য করিবে না আর ফানোঁর প্রশ্নের উত্তরও মিলিবে না ইহাতে। মানুষ মিথ্যা বলে কেন? কোন একটা গোটা জাতিই বা এমন বেদম মিথ্যা বলিবে কেন? কোন কোন জাতি সত্য বলিতে অক্ষম বা সত্য হইতে মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করিতে পারে না কারণ তাহাদের মগজের গঠন ভিন্ন-তাহাদের মগজ এক জায়গায় আর কাজ করে না-এই জাতীয় কথা বলিয়াও তো সত্যের পক্ষে কোন লাভ নাই।
অপরাধী অপরাধ-স্বীকারের মধ্যস্থতায় আবার আপন সমাজে ফিরিয়া আসিবার কোশেস করিয়া থাকেন। প্রশ্ন হইতেছে-তিনি ফিরিয়া আসিবেন কোন সমাজে? যে সমাজ গঠিতই হয় নাই সে সমাজে ফিরিয়া যাইবার তো কোন অর্থ হয় না। এই প্রশ্নটা অপরাধ তদন্তকারী দলের প্রস্তুত করা প্রশ্নের তালিকায় স্থানও পায় নাই। যে সকল দেশ পরাধীন অর্থাৎ বিদেশি দখলদারদের পদানত হইয়াছে সে সকল দেশের মানুষ বিদেশিদের দখল মানিয়া লইলেও অন্তর হইতে তাহাদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নাই। ফলে সেই সকল দেশে-কোন আদত সমাজচুক্তি সম্পাদিত হয় নাই-সেখানে সিবিল সোসাইটি বা স্বাধীন জাতীয় সমাজই গঠিত হয় নাই। এই কারণেই সেখানকার লোকে হয়তো দণ্ড মানিয়া লয়, কিন্তু দণ্ড দাতার কর্তৃত্ব মানিয়া লইতে প্রস্তুত নয়।
বর্তমানে আমাদের দেশে সুশাসন বলিতে কিছু সত্য সত্য আছে কিনা তাহাও এই প্রস্তাবের আলোকে বিচার করা যায়। আমাদের এই ভাগ্যবান দেশে দুই দুইবার স্বাধীনতার সংগ্রাম হইয়াছে কিন্তু এখনও স্বাধীন জাতীয় সমাজ গঠিত হয় নাই। এখানে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তাই সবসময় আদালতের দ্বারস্থও হইতে হয় না আর অপরাধীও দায়স্বীকারের দায় অনুভব করেন না।
৩.
ফরাশি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের লেখা একটা নাটকের নাম ‘নোংরা হাত’। সেই নাটকের প্রধান চরিত্রের নাম উগো। তিনি সর্বহারা পার্টির সদস্য। পার্টির আদেশ হইয়াছে একজন পার্টি-নেতাকে হত্যা করিতে হইবে, তাঁহার অপরাধ তিনি কয়েকটি বুর্জোয়া দলের সহিত সর্বহারা পার্টির ঐক্য বা পপুলার ফ্রন্ট গড়ার প্রস্তাব সমর্থন করিতেছেন। এই আদেশ যথারীতি পালন করিলেন উগো। কিছুদিন পর সর্বহারা বিপ্লবের কেন্দ্র মস্কো শহর হইতে আদেশ জারি হইল-পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে-বুর্জোয়া দলগুলির সহিত ঐক্যটা গড়িতেই হইবে। পার্টির নীতি পরিবর্তিত হইল। কিন্তু নিহতকে তো আবার জীবনদান করা যাইবে না। এক্ষণে হত্যার দায়ে উগোকে দায়ী করা ছাড়া উপায় রহিল না, তাহাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইল। উগো বলিতেছেন, এতদিনে পার্টি আর তাহার সঙ্গে নাই, তাহাকে ছাড়িয়াই দিয়াছে, কিন্তু তাহার করা হত্যাকাণ্ডটি তাহাকে আর ছাড়িল না। এই হত্যার দায় এখন দলের নহে-এই দায় তাহার একার। সার্ত্রের মতে, এই একাকিত্বই উগোর মনুষ্যত্বের প্রমাণ।
নিজের কৃতকর্মের দায়স্বীকার করিয়াই মাত্র মানুষ বাঁচিতে পারে-এমনকি মৃত্যুদণ্ডের পরও মানুষ নিজের যাপিত জীবনের একটা না একটা অর্থ খুঁজিয়া পায়। এই অর্থ মানুষ খুঁজিয়া পায় যে সমাজ হইতে সে আসিয়াছে সে সমাজের মধ্যে। নিজের কৃতকর্মের বা অপরাধের দায় লওয়ার মধ্যেই মাত্র মানুষ বাঁচিয়া থাকে অর্থাৎ আপন সমাজের সহবতে ফিরিয়া আসে। এই সত্যে সন্দিগ্ধ ছিলেন না বলিয়া সার্ত্রের উগো নিজের দায় শেষ পর্যন্ত মানিয়া লইয়াছিলেন। একই কারণে ফিওদর দস্তয়েবস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’ উপন্যাসের নায়ক রাসকলনিকবও আপনকার সমাজে ফিরিয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন। ফরাশি দার্শনিক অঁরি বের্গসঁ অন্তত ঘটনাটা এইভাবে দেখিতেন। পরাধীন দেশে এহেন ফিরিয়া যাওয়ার জায়গা থাকে না। বলা বাহুল্য, ফরাশি দখলদারদের অধীনস্ত আলজিরিয়ায়ও তেমন ফিরিয়া যাইবার জায়গা ছিল না।
এই সত্যের অন্ধকারেই শুদ্ধ দেখা যায়, আমাদের দেশ কতটা স্বাধীন হইয়াছে বা আজও কতটা পরাধীন রহিয়া গিয়াছে। আমাদের এই ভাগ্যবান দেশে অপরাধী যেমন নিজের বিবেক বা রাষ্ট্র কোথায় তাহা দুই চোখে দেখিতে পায় না, খোদ রাষ্ট্রও তেমনি অপরাধীকে ফিরাইয়া আনিবার জায়গা খুঁজিয়া পায় না। রাষ্ট্র মানুষকে বলির পাঁঠার অধিক বিবেচনা করে না।
৮ ডিসেম্বর ২০১৯
দোহাই
১. Frantz Fanon and Raymond Lacaton, ‘Conducts of Confession in North Africa (1)’, Frantz Fanon, Alienation and Freedom, edited by Jean Khalfa and Robert J. C. Young, trans. by Steven Corcoran (London: Bloomsbury Academic, 2018), pp. 409-412.
২. Frantz Fanon, ‘Conducts of Confession in North Africa (2)’, Frantz Fanon, Alienation and Freedom, edited by Jean Khalfa and Robert J. C. Young, trans. by Steven Corcoran (London: Bloomsbury Academic, 2018) pp. 413-416.
৩. Nigel C. Gibson and Roberto Beneduce, Frantz Fanon, Psychiatry and Politics (London: Rowman and Littlefield, 2017).