• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সলিমুল্লাহ খান ও প্লেটোর গুহা


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৩, ১১:২৫ এএম
সলিমুল্লাহ খান ও প্লেটোর গুহা

প্রায়ই সলিমুল্লাহ খানের একটি কথা আমার কানে বাজে, সেটি হলো প্লেটোর গুহার দরজা ভেতর থেকেই খুলতে হয়। নানা প্রসঙ্গেই তিনি প্লেটোর গুহার কথাটি বলেন। এই প্লেটোর গুহা কী জিনিস? অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে এক গুহাবাসীর বাইরে বেরিয়ে এসে সূর্যালোকে আলোকিত হওয়া, বহির্জগৎকে অনুধাবন ও সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা, অতঃপর অপরাপর গুহাবাসী, যারা নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি, আলোর স্পর্শ পায়নি, তাদের দ্বারা নিঃগৃহীত হওয়া। প্লেটোর এই গল্প দুই হাজার বছরের পুরোনো হলেও, এর আবেদন এখনো ফুরোয়নি। আমাদের সমাজে যারা জ্ঞানের আলোকে দীপ্তিমান, তারা নানাবিধ আক্রমণের শিকার হন, হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারণ যারা আক্রমণ করেন, তারা আপন অজ্ঞতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। সক্রেটিসের মতো তারা বলতে পারবেন না, তারা যে জানেন না, সেটাই তারা জানেন না।


তবে আশার কথা হলো, প্লেটোর গুহায় থাকা সবাই সেই আলোকবর্তিকাকে যে অবিশ্বাস করে তা নয়, আমাদের মতো অনেকেই আস্থা রাখেন এবং সত্য ও জগৎকে অনুধাবনের চেষ্টা করেন। সলিমুল্লাহ খান জ্ঞানের রাজ্য পরিভ্রমণ শেষে যে উজ্জ্বল উদ্ধার আমাদের সামনে হাজির করেন, আমরা তাতে ঔজ্জ্বল্য পাই, নব আবিষ্কারের আনন্দ আমাদের উদ্বেলিত করে। অন্যদের কথা বলতে পারব না, তবে আমার বেলায় যা ঘটেছে, তা হলো স্যারের সঙ্গে পরিচয়ের পর আমি আমার আগের জ্ঞানকে একপাশে সরিয়ে রেখে, নতুন জ্ঞান যত্নাখরে লিখে রাখবার জন্য প্রস্তুত হয়েছি। এটা অনেকটা যেন বিপুল অনিবাধ শূন্য সর্বাধার tabula rasa প্রস্তুত করেছি। স্লেটের সবটা তো আর পরিষ্কার করা যায় না, তবে স্যারের জ্ঞানকে ধারণ করার জন্য যতটুকু পারা যায়, নিজের মনের খাতাকে ফাঁকা করেছি। গ্রহণ করেছি। তাতে যে বোধ জন্মেছে সেটা দিয়ে অন্তত আন্দাজ করতে পারি, গুহার বাইরে রূপ-রস-সুধাময় জ্ঞানের বিপুল ভান্ডার অপেক্ষমাণ। সেই ভান্ডারের কণা এখনো স্পর্শ করতে পারিনি। লাভের ভেতর এই—ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছি স্যারের কল্যাণে। সন্ধান জানা থাকলেই মানুষ খুঁজতে বেরোয়। আমিও খুঁজতে বেরিয়েছি।


কত অজানা চিন্তাবিদ, দার্শনিক, কবি, গদ্যকার ও তাদের বইয়ের খোঁজ পেয়েছি স্যারের কাছ থেকে, তার ইয়ত্তা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খোঁজের নাম জাক লাকাঁ। আজ আমি চলচ্চিত্রকে মনোবিশ্লেষণের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে পারি বা স্লাভয় জিজেকের বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারি, তার পুরোপুরি কৃত্বিত্ব স্যারের। সলিমুল্লাহ খান যদি আজ থেকে কুড়ি-একুশ বছর আগে এ দেশে লাকাঁচর্চা শুরু না করতেন, তবে হয়তো আমার অর্ধেক লেখাই সূর্যালোকের দেখা পেত না। আমার মনে আছে, স্যার কেবল লাকাঁ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেছেন। আমি সেসব বক্তৃতার অধিকাংশই বুঝি না। তারপরও মাটি কামড়ে পড়ে থাকি। বিষয়টি আকর্ষণীয় এবং আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। বুঝতে আমাকে হবেই। এখনো যে পুরোপুরি বুঝে উঠেছি, তা নয়। বোঝার অবিরত প্রচেষ্টা বা বোঝা আমাদের বহন করতেই হয়। তাতে আনন্দও আছে। তো আমার সেই আনন্দ ও মুগ্ধতার কথা পরিচিত এক লেখককে বলছিলাম, তার সিদ্ধেশ্বরীর অফিসে বসে। বলছিলাম সলিমুল্লাহ খানের পাণ্ডিত্যের কথা। স্যারের বোঝাপড়া অন্যদের মতো নয়। তিনি বিষয়টিকে নিজে পাটিগণিতের মতো করে বোঝেন, তারপর অন্যদের সামনে বীজগণিতের (seminar কথাটি এসেছে semen থেকে, যার অর্থ বীজ) মতো করে ছড়িয়ে দেন। তো স্যারের সেমিনারে অনেকেই যেতেন, আবার অনেকে শুধু ওনাকে পছন্দ না করার কারণে নতুন জ্ঞানপ্রাপ্তি থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতেন। তো সে রকমেরই একজন ছিলেন সেই লেখক, তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলে বসলেন, সলিমুল্লাহ খান তো খালি লাকাঁর ঠ্যাং ধরে টানাটানি করেন। পরে অবশ্য আহমদ ছফা স্মরণে করা একাধিক অনুষ্ঠানে সেই লেখক উপস্থিত ছিলেন। ভুল ভেঙেছিল বোধ হয়।  


বহু বছর পর এক বক্তৃতায় স্যার বলছিলেন, শুধু সলিমুল্লাহ খানকে পছন্দ করেন না বলেই লাকাঁ মিথ্যা হয়ে যায় না। শুধু লাকাঁ কেন, মার্কস, গ্রামশি, ফানোঁ, বেনিয়ামিন, বোদলেয়ারসহ বহু মনীষীর চিন্তাবীজ যেভাবে তিনি অকাতরে ছড়িয়ে গেছেন, তা অতুলনীয়। বছরের পর বছর সেমিনার করে স্যার বীজ ছিটানোর চেষ্টাই করেছেন। তিনি যেন বাইবেলে বর্ণিত সেই কৃষক। তার ছিটানো বীজের কিছু অংশ পড়েছে উর্বর জমিনে, কিছু কাঁটা-ঝোপঝাড়ে ঢাকা জমিনে, আর কিছু পাথরের ওপর। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম না হলে, তার দায় সেই কৃষকের নয়। আমি নিজেকে পাথর মনে করি না, ঝোপঝাড়ও পরিষ্কার করে রাখি, ট্যাবুলা রাসা, শুদ্ধ নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য। 


কিন্তু এটা সবাই করেন না, বা করতে চান না। সলিমুল্লাহ খানের বক্তৃতায় আসা বহু ব্যক্তিকে দেখেছি ঈর্ষায় নীল হয়ে যেতে। আবার এ-ও দেখেছি, ফ্রয়েডীয় বা লাকাঁনীয় চিন্তার বহু তরজমা, যা স্যার স্বকীয়ভাবে বাংলায় উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো নির্দ্বিধায় নিজেদের কবিতা ও গদ্যে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ঋণ স্বীকার দূরে থাক, প্রকাশ্যে তারা সলিমুল্লাহ খানের নিন্দা করতে কসুর করেননি। অথচ একদা তারাও ছাত্র হয়েছেন স্যারের। সেমিনারে বসে শেখা মানে তো ছাত্রত্ব গ্রহণ করাই। এখন মানুষ মাত্রই ভুল-ত্রুটি থাকে। সলিমুল্লাহ খান আর সবার মতোই মানুষ। তবে যারা তাঁর ছাত্র হয়েছেন, তাদের অনেকেই আর ‘ছাত্র’ শব্দটির মূল অর্থ মনে রাখেননি। ‘ছাত্র’ শব্দের মূল অর্থ: যে গুরুর দোষ ঢেকে রাখে, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে ছাতার মতো। তবে প্রশ্ন আসে, সলিমুল্লাহ খানের দোষটা কী? দোষ হলো, তিনি বড় বড় মানুষের দোষ ধরিয়ে দেন। স্যার নিজেই বলেন, আমি ছোট মানুষ হয়ে যখন বড় মানুষের দোষ ধরি, তখন লোকে বলে ছোটমুখে এত বড় কথা? লোকে তখন আর তাঁকে পছন্দ করতে চায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নোম চমস্কি কিংবা অমর্ত্য সেন প্রমুখের কাজ নিয়ে বলার কারণে একধরনের আক্রমণের শিকার হন সলিমুল্লাহ খান। কিন্তু কেউ খতিয়ে দেখেন না, যে কাজ নিয়ে সমালোচনা সেটা ঠিক না বেঠিক। আমি মনে করি, শিক্ষক যদি কোনো যুক্তিযুক্ত বক্তব্যের কারণে সমালোচিত হন, তাহলে ছাত্র হিসেবে সেই বক্তব্যকে আরও জোরালো করে নিজের মতো করে শিক্ষকের সপক্ষে হাজির করা উচিত। স্যারের একজন অকিঞ্চিৎকর ছাত্র হিসেবে সেটা আমি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে করার চেষ্টা করি।


সলিমুল্লাহ খান আমাদের সমাজে যে নানাবিধ দার্শনিক জ্ঞানের সন্ধান দিয়েছেন, তাতে আমি মানুষ ও বিশ্বজগতের প্রকৃত সম্পর্কের স্বরূপ দেখার প্রয়াস পেয়েছি। এটা অনেকটা ‘ব্যবহারিক সত্তা’র উচ্চতর অনুভূতির স্পর্শ পেয়ে ‘পারমার্থিক সত্তা’য় প্রবেশ করার মতোই। আমার সীমিত জ্ঞানকে তিনি প্রসারিত করেছেন। কখনোবা সংশোধিত করেছেন। দেখতে পারার মতো দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছেন। এই সম্প্রদানের কোনো প্রতিদান হয় না। কৃতজ্ঞতা বা দু-চার কলম লিখে এর দায় শোধ করা একেবারেই অসম্ভব। সলিমুল্লাহ খান যে তরিকায় জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলেন, তা ভূ-ভারতে বিরল। আমি কলকাতায় গিয়েও, সেখানকার পণ্ডিতদের মুখে স্যারের নাম শুনেছি। একবার ফরাসি বিপ্লব নিয়ে কথা বলবার জন্য ওপার বাংলার ফরাসি বিশেষজ্ঞ চিন্ময় গুহকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এক অনুষ্ঠানে। তিনি তৎক্ষণাৎই বলেছিলেন সলিমুল্লাহ খানের কথা। 


আমরা অনেক সময় আমাদের আটপৌরে জীবনের ভেতর দিয়ে দেখা, আমাদের সামনে দিয়ে চলাফেরা করা বড় চিন্তাবিদ, লেখক ও দার্শনিকদের চিনতে পারি না। সেই ব্যর্থতা আমাদের। আমরা আমাদের গুহা থেকে বেরোনোর ইচ্ছা পোষণ করা তো দূর-কি-বাত, আলোকবার্তা নিয়ে আসা লোকটাকে পর্যন্ত উন্মাদ ঠাওরে তাকে তাড়িয়ে দিতে, এমনকি নিকেশ করতে উদ্যত হই। স্যারের ওই কথা দিয়েই শেষ করি, প্লেটোর গুহার পাথর ভেতর থেকেই সরাতে হয়। অর্থাৎ আমাদের যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা, তা অন্য কেউ এসে ঘোচাতে পারবে না। অগ্রবর্তী মানুষটি আলো জ্বেলে পথ দেখাতে পারবেন মাত্র। সলিমুল্লাহ খান মশাল ধরে পথ দেখাচ্ছেন, এখন আমরা আমাদের অন্ধত্ব দূর করব কি না, তা নির্ভর করছে আমাদেরই ওপর।  
 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!