• ঢাকা
  • শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩০, ২১ রমজান ১৪৪৬

কৃষ্ণবিষয়ক যত অপপ্রচার


নান্টু রায়
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২১, ০৫:৩৩ পিএম
কৃষ্ণবিষয়ক যত অপপ্রচার

সম্প্রতি এক বন্ধু ফেসবুকে কোনো এক একাদশীর পারণের বিবিধ চর্ব-চষ্য-লেহ্য-পেয়-র ছবিসংবলিত পোস্ট দিয়ে লিখলেন, ব্রজে প্রসিদ্ধং নবনীতচৌরং/ গোপাঙ্গনা নাং চ দুকূলচৌরং।// অনেক জন্মার্জিত পাপচৌরং/ চৌরাগ্র্যগণ্যং পুরুষং নমামি॥

আমি পাঠমাত্র প্রতিক্রিয়া জানালাম, এই শ্লোকটির রচয়িতা কে, এর মানে কী? বন্ধুর ত্বরিত জবাব, এটি বিল্মমঙ্গল ঠাকুরের কৃষ্ণপ্রণাম মন্ত্র, যার মানে হচ্ছে, ‘যিনি ব্রজে নবনীত চোর ও গোপাঙ্গনাদের বসন চোর বলে প্রসিদ্ধ ও যিনি স্বীয় ভক্তদের অশেষ জন্মার্জিত পাপসকল হরণ করেন, সেই চোর শিরোমণিকে প্রণাম করি।’ আমি বললাম, এ তো খুব সুন্দর কৃষ্ণপ্রণাম মন্ত্র! বাবাকে প্রণাম করে আপনি বললেন, ‘বাবা তুমি শুয়োরের বাচ্চা, বাবা তুমি কুত্তার বাচ্চা, কিন্তু যেহেতু তুমি আমার জন্মদাতা, তাই তোমাকে প্রণাম করি।’ বন্ধুটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমরা কৃষ্ণকে ভালোবেসে এমনই বলি। এ আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ।’ আর কথা চলে না। কৃষ্ণকে তারা ভালোবেসে চোর বলছেন, চোরশিরোমণি বলছেন—নবনীত চোর, গোপাঙ্গনাদের কূলচোর, বসনচোর, ভক্তদের পাপরাশি চোর, শেষে সেই চোর-অগ্রগণ্য পুরুষকে তারা প্রণাম করছেন। যাঁকে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’ বলে স্বীকার করছি, সেই ভগবানকে চোর বলছি, চোরশিরোমণি বলছি। ভাবুন, কী ধৃষ্টতা! এতে যে আমাদের পাপ হচ্ছে, ক্রমাগত পাপস্রোত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ বোধটুকুও নেই।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং—এই যদি বাঙালির বিশ্বাস, তবে সব সময়ে কৃষ্ণ আরাধনা, কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণকথা ধর্মেরই উন্নতিসাধক। সকল সময়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করার চেয়ে মানুষের মঙ্গল আর কী আছে? কিন্তু এঁরা ভগবানকে কী রকম ভাবেন? ভাবেন, ইনি বাল্যে চোর—ননী-মাখন চুরি করে খেতেন; কৈশোরে পারদারিক—অসংখ্য পতিব্রতার ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট করেছেন; পরিণত বয়সে বঞ্চক ও শঠ-বঞ্চনা করে দ্রোণ প্রভৃতির প্রাণহরণ করেছিলেন! ভগবৎচরিত কি এমন? যিনি শুদ্ধসত্ত্ব, যাঁর থেকে সব ধরনের শুদ্ধি, যাঁর নামে অশুদ্ধি ও পাপ দূর হয়, মানবদেহ ধারণ করে এ সমস্ত পাপাচরণ কি সেই ভগবৎচরিত্রে শোভা পায়?

ভগবৎচরিত্রের এমন কল্পনায় ভারতবর্ষের পাপস্রোত বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরাণ-ইতিহাস আলোচনা করে দেখেছি, কৃষ্ণসম্বন্ধীয় যেসব পাপ-উপাখ্যান জনসমাজে প্রচলিত, সবই অমূলক কুনাট্য ছাড়া কিছু নয়। এসব বাদ দিলে বাকি যা থাকে, তা অতি বিশুদ্ধ, পরম পবিত্র, অতিশয় মহৎ। তাঁর মতো সর্বগুণান্বিত, সর্বপাপসংস্পর্শশূন্য আদর্শ চরিত্র আর কোথাও নেই। কোনো দেশীয় ইতিহাসে না, কোনো দেশীয় কাব্যেও না।’
ননীচুরির ব্যাপারটা লঘু করে দেখা যেতে পারে, শিশু-বালকের কাজ। কিন্তু বসনচুরি, তাদের চরিত্রহরণ তো গুরুতর অপরাধ। এটা কি কৃষ্ণ করতে পারেন? দেখা যাক, পুরাণেতিহাসে কী আছে?

কৃষ্ণবিদ্বেষীরা কৃষ্ণচরিত্রে কলঙ্ক আরোপের জন্য ব্রজগোপীতত্ত্ব ফেনায়িত করেছেন, কিন্তু মহাভারতে ব্রজগোপীদের কথা কিছুই নেই। সভাপর্বে শিশুপালবধ পর্বাধ্যায়ে শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দার সবিস্তার বর্ণনার কোথাও ব্রজগোপীঘটিত কৃষ্ণের কলঙ্কের কথা উচ্চারিত হয়নি। যদি এ কলঙ্ক থাকত, তাহলে শিশুপাল কিংবা শিশুপালবধবৃত্তান্ত প্রণয়নকারী কবি কখনোই কৃষ্ণনিন্দাকালে হাতছাড়া করতেন না। শুধু সভাপর্বে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকালে দ্রৌপদী কৃষ্ণকে সকাতরে ডাকার সময় একবার ‘গোপীজনপ্রিয়’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সুন্দর শিশুর প্রতি স্ত্রীজনসুলভ স্নেহ থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিষ্ণুপুরাণে বিষয়টি পবিত্রভাবে উত্থাপিত হয়েছে। হরিবংশে কিছু বিলাসিতা দেখা যায়, ভাগবতে আদিরসের বিস্তার শুরু হয়েছে আর ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আদিরসের স্রোত বয়ে গেছে। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশের ত্রয়োদশ অধ্যায় ছাড়া ব্রজগোপীদের কথা আর কোথাও নেই। সেখানে রাসলীলার উল্লেখ আছে। রাস হলো নারী-পুরুষে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চক্রাকার ঘুরতে ঘুরতে নাচ-গান করা। বালক-বালিকারা এ রকম নাচ-গান করে থাকে। সদ্যকিশোর কৃষ্ণও গোপ বালক-বালিকাদের সঙ্গে এমন নাচ-গান করেছেন। সদা ক্রীড়াশীল বালকের এমন প্রমোদে আদিরস থাকতে পারে না। কেবল কৃষ্ণের মথুরা গমনকালে তাঁদের খেদোক্তি আছে। হরিবংশেও ব্রজগোপীদের কথা বিষ্ণুপর্বের ৭৭ অধ্যায় (গ্রন্থান্তরে ৭৬ অধ্যায়) ছাড়া আর কোথাও নেই। তবে হরিবংশে ‘রাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, তার পরিবর্তে ‘হল্লীষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই অধ্যায়ের নাম ‘হল্লীষক্রীড়নম্’। ‘হল্লীষ’ এবং ‘রাস’ একই কথা—নৃত্যবিশেষ। কবিত্বে, গাম্ভীর্যে, পাণ্ডিত্যে ও ঔদার্যে হরিবংশকার বিষ্ণুপুরাণকারের তুলনায় অনেক লঘু। তিনি বিষ্ণুপুরাণকারের রাসবর্ণনার নিগূঢ় তাৎপর্য ও গোপীদের ভক্তিযোগে কৃষ্ণে একাত্ম হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তাই বিষ্ণুপুরাণের চপলা বালিকা আনন্দে চঞ্চলা, হরিবংশে সেই গোপীরা বিলাসিনীর ভাব প্রকাশ করছে।
শ্রীমদ্ভাগবতে ব্রজগোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধ শুধু রাসলীলায় সীমাবদ্ধ নেই। ভাগবতকার গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলার বিশেষ বিস্তার ঘটিয়েছেন। সময়ে সময়ে তা আধুনিক রুচিবিরুদ্ধ। কিন্তু এসব বর্ণনার বহিরঙ্গ রুচিবিরুদ্ধ মনে হলেও অন্তরঙ্গে অতি পবিত্র ভক্তিতত্ত্ব নিহিত রয়েছে। হরিবংশকারের মতো ভাগবতকার বিলাসপ্রিয়তা-দোষে দূষিত নন। তাঁর অভিপ্রায় অতি নিগূঢ় ও বিশুদ্ধ। ভাগবতের দশম স্কন্ধের ২১ অধ্যায়ে প্রথমত গোপীদের পূর্বরাগ বর্ণিত হয়েছে। তারা কৃষ্ণের বাঁশি শুনে মোহিত হয়ে পরস্পরের কাছে কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ ব্যক্ত করছেন। সেই পূর্বানুরাগ বর্ণনায় কবি অসাধারণ কবিত্ব প্রকাশ করেছেন। আর সেটা ব্যাখ্যা করতে তিনি ‘বস্ত্রহরণ’ পালা ফেঁদেছেন, যার সারমর্ম হচ্ছে ভগবানকে পেতে সর্বস্ব ত্যাগ করা যায়, লজ্জা যে নারীর ভূষণ, তা-ও ত্যাগ করা যায়। বস্ত্রহরণের কোনো কথা মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ বা হরিবংশে নেই, এটি ভাগবতকারের একান্ত কল্পনাপ্রসূত।

অথর্ববেদের উপনিষদসমূহের মধ্যে গোপালতাপনী নামে অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপনিষদে কৃষ্ণকে গোপগোপীপরিবৃত দেখা যায়। কিন্তু এতে গোপগোপীর অর্থ প্রচলিত অর্থের থেকে আলাদা। এখানে গোপী অর্থে অবিদ্যা কলা। আর গোপীজনবল্লভ অর্থে ‘গোপীনাং পালনশক্তীনাং জনঃ সমূহঃ তদ্বাচ্যা অবিদ্যাঃ কলাশ্চ তাসাং বল্লভঃ স্বামী প্রেরক ঈশ্বরঃ।’ উপনিষদে গোপীর এমন অর্থ আছে, অথচ রাসলীলার কোনো কথাই নেই। রাধার নামমাত্র নেই। একজন প্রধানা গোপীর কথা আছে, তিনি রাধা নন, তাঁর নাম গান্ধর্বী। তাঁর প্রাধান্যও কামকেলিতে নয়, তত্ত্বজিজ্ঞাসায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর জয়দেবের কাব্য ছাড়া কোনো প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নেই।

ভাগবতের দশম স্কন্ধের ২৯-৩৩—এই পাঁচ অধ্যায়ের নাম রাসপঞ্চাধ্যায়। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে গোপাঙ্গনাদের কৃষ্ণদর্শনে ধাবিত হতে এবং কৃষ্ণের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত দেখা যায়। কিন্তু সেখানে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না। রাধা নাম বৈষ্ণবাচার্যদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে আছে। তাঁরা টিকাটিপ্পনীর ভেতর বারবার রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নেই। গোপীদের অনুরাগপ্রাবল্যজনিত ঈর্ষার প্রমাণস্বরূপ কবি লিখেছেন যে, তারা পদচি‎হ্ন দেখে অনুমান করেছিল যে, কোনও একজন গোপীকে নিয়ে কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু তাও গোপীদের ঈর্ষাজনিত ভুলমাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন, এ কথাই আছে, কাউকে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন, এমন কথা নেই এবং রাধার নামগন্ধও নেই।

রাসপঞ্চাধ্যায় কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নেই। ভাগবত কেন, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নেই। অথচ এখন কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ছাড়া এখন কৃষ্ণনাম নেই। রাধা ছাড়া বাংলায় কৃষ্ণের মন্দির নেই, মূর্তি নেই। বৈষ্ণবদের অনেক রচনায় কৃষ্ণের চেয়েও রাধা প্রাধান্য লাভ করেছেন। যে রাধাকে নিয়ে ভারতবর্ষ বিশেষত বাঙলা মাতোয়ারা, সেই রাধার উল্লেখ মহাভারতে নেই—বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, এমনকি ভাগবতেও নেই। তাহলে এ রাধা এলেন কোথা থেকে? 
রাধাকে প্রথম দেখতে পাই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে। আদিম ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বিলুপ্ত, এখন যেটা পাওয়া যায়, তা পুরাণসমূহের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলে বোধ হয়। এর রচনাপ্রণালি এখনকার ভট্টাচার্যদের রচনার মতো। এতে ষষ্ঠী মনসার কথাও আছে। এখনকার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এক নতুন দেবতত্ত্ব হাজির করা হয়েছে। আমরা চিরকাল জানি, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। অথচ এখানে বলা হচ্ছে, কৃষ্ণই বিষ্ণুকে সৃষ্টি করেছেন। বিষ্ণু থাকেন বৈকুণ্ঠে, কৃষ্ণ থাকেন গোলোকে রাসম-লেÑ বৈকুণ্ঠ তার অনেক নীচে। ইনি কেবল বিষ্ণুকে নন, ব্রহ্মা, রুদ্র, লক্ষ্মী, দুর্গা প্রভৃতি সমস্ত দেবদেবী, দানব ও জীবের সৃষ্টি করেছেন। গোলকধামে গো, গোপ ও গোপিনীরা বাস করে। তারা দেবদেবীর ওপর। সেই গোলকধামের অধিষ্ঠাত্রী কৃষ্ণবিলাসিনী দেবীই রাধা। রাধার আগে রাসমণ্ডল, রাসমণ্ডলে ইনি রাধাকে সৃষ্টি করেন। গোপীদের বাসস্থান গোলোকধাম বৃন্দাবনের অবিকল নকল। এখানে কৃষ্ণযাত্রার চন্দ্রাবলীর মতো রাধার প্রতিযোগিনী গোপীর নাম বিরজা। মানভঞ্জন যাত্রায় যেমন যাত্রাওয়ালারা কৃষ্ণকে চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে নিয়ে যায়, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণকারও তেমনি কৃষ্ণকে গোলোকধামে বিরজার কুঞ্জে নিয়ে গেছেন। তাতে যাত্রার রাধিকার মনে যেমন ঈর্ষা ও কোপের সৃষ্টি হয়, ব্রহ্মবৈবর্তের রাধিকার মনেও তেমনি ঈর্ষা ও কোপের সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে আরেক মহা গোলযোগ ঘটে যায়। রাধিকা কৃষ্ণকে হাতেনাতে ধরার জন্য রথে চড়ে বিরজার মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে বিরজার দ্বার রক্ষা করছিলেন শ্রীদামা বা শ্রীদাম। শ্রীদাম রাধিকাকে দ্বার ছাড়ে না। এদিকে রাধিকার ভয়ে বিরজা গলে জল হয়ে নদীতে রূপান্তরিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাতে দুঃখিত হয়ে তাঁকে পুনর্জীবন ও পূর্বরূপ প্রদান করলেন। বিরজা গোলোকনাথের সঙ্গে নিত্য আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। ক্রমে তার সাতটি পুত্র জন্মাল। কিন্তু পুত্ররা আনন্দ অনুভবের বিঘ্ন, তাই মা তাদের অভিশাপ দিলেন, তারা সাত সমুদ্র হয়ে রইল। এদিকে রাধা কৃষ্ণবিরজা-বৃত্তান্ত জানতে পেরে কৃষ্ণকে যারপরনাই ভর্ৎসনা করলেন, এবং অভিশাপ দিলেন যে তুমি পৃথিবীতে গিয়ে বাস কর। অপর দিকে কৃষ্ণসখা শ্রীদাম রাধার এহেন দুর্ব্যবহারে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করলেন। শুনে রাধা শ্রীদামকে গালমন্দ করে শাপ দিলেন, তুমি পৃথিবীতে গিয়ে অসুর হয়ে জন্মগ্রহণ কর। শ্রীদামও কম যান না। তিনিও রাধাকে শাপ দিয়ে বললেন, তুমিও পৃথিবীতে গিয়ে রায়ানপত্নী (যাত্রার আয়ান ঘোষ) হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কলঙ্কিনীরূপে খ্যাত হবে।

অতঃপর দুজনেই কৃষ্ণের কাছে এসে কেঁদে পড়লেন। কৃষ্ণ শ্রীদামকে বর দিয়ে বললেন যে তুমি অসুরেশ্বর হয়ে জন্মাবে, কেউ তোমাকে পরাজিত করতে পারবে না। শেষে শঙ্করের শূলের স্পর্শে মুক্ত হবে। রাধাকেও আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘তুমি যাও; আমিও যাচ্ছি।’ শেষে পৃথিবীর ভার লাঘবের জন্য তিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন।

এসব কথা নতুন এবং সব শেষে প্রচারিত হলেও এই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বাঙলার বৈষ্ণবধর্মের ওপর অতিশয় প্রভাব বিস্তার করেছে। জয়দেব প্রভৃতি বাঙালি বৈষ্ণবকবি, বাঙলার জাতীয় সংগীত, বাঙলার যাত্রা মহোৎসবাদির মূল ব্রহ্মবৈবর্তে। তবে ব্রহ্মবৈবর্তকারকথিত একটা বড় মূল কথা বাঙলার বৈষ্ণবেরা গ্রহণ করেননি, অন্তত সেটা বাঙালির বৈষ্ণবধর্মে তেমনভাবে পরিস্ফুট হয়নি, রাধিকা রায়ানপত্নী বলে পরিচিতা, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্তের মতে তিনি কৃষ্ণের বিধিসম্মত বিবাহিতা পত্নী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের ১৫ অধ্যায়ে বিবৃত সেই বিবাহবৃত্তান্ত জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘একদা কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে নন্দ বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। সেখানকার ভাণ্ডীরবনে গরু চরানোর সময় সরোবরের স্বাদু জল তিনি গোরুদের পান করালেন, নিজেও পান করলেন। এবং বালককে বুকে নিয়ে বটমূলে বসলেন। হে মুনে! তারপর মায়াতে শিশুশরীরধারণকারী কৃষ্ণ অকস্মাৎ মায়ার দ্বারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করলেন, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কাননান্তর শ্যামল; ঝঞ্ঝাবাত, মেঘশব্দ, দারুণ বজ্রশব্দ, অতিস্থূল বৃষ্টিধারা এবং বৃক্ষসকল আন্দোলিত হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল, দেখে নন্দ ভয় পেলেন। ‘বাছুরগুলোকে ছেড়ে কীভাবেই-বা নিজের আশ্রয়ে যাই, যদি গৃহে না যাই, তবে এই বালকেরই-বা কী হবে’, নন্দ এমন বলছেন, শ্রীহরি তখন কাঁদতে কাঁদতে মায়াভয়ে ভীত হয়ে বাপের গলা জড়িয়ে ধরলেন। এমন সময় রাধা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।’

রাধার অপূর্ব লাবণ্য দেখে নন্দ বিস্মিত হলেন, তিনি রাধাকে বললেন, ‘আমি গর্গমুখে জেনেছি, তুমি পদ্মারও অধিক হরির প্রিয়া; আর ইনি পরম নির্গুণ অচ্যুত মহাবিষ্ণু; তথাপি আমি মানব, বিষ্ণুমায়ায় মোহিত আছি। হে ভদ্রে! তোমার প্রাণনাথকে গ্রহণ কর; যেখানে খুশি যাও। পরে মনোরথ পূরণ করে আমার পুত্র আমাকে দিও।’

এই বলে নন্দ কৃষ্ণকে রাধার হাতে সমর্পণ করলেন। রাধাও কৃষ্ণকে কোলে করে নিয়ে গেলেন। দূরে গেলে রাধা রাসমণ্ডল স্মরণ করলেন, তখন মনোহর বিহারভূমি সৃষ্টি হলো। কৃষ্ণকে সেখানে নেওয়া হলে তিনি কিশোরমূর্তি ধারণ করে রাধাকে বললেন, ‘যদি গোলকের কথা স্মরণ হয়, তবে যা স্বীকার করেছি, তা পূর্ণ করব।’ তাঁরা এমন প্রেমালাপে লিপ্ত ছিলেন, এমন সময় সেখানে ব্রহ্মা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রাধাকে অনেক স্তবস্তুতি করলেন। শেষে নিজে কন্যাকর্তা হয়ে যথাবিহিত বেদবিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করলেন। তাঁদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রায়াণের সঙ্গে রাধিকার যথাশাস্ত্র বিয়ে হয়েছিল কিনা, যদি হয়ে থাকে, তবে তা আগে না পরে, তা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পেলাম না। রাধাকৃষ্ণের বিয়ের পর বিহারবর্ণন। বলা বাহুল্য যে ব্রহ্মবৈবর্তের রাসলীলাও অনুরূপ।

পাঠক দেখবেন যে, ব্রহ্মবৈবর্তকার সম্পূর্ণ নতুন বৈষ্ণবধর্ম সৃষ্টি করেছেন। সে বৈষ্ণবধর্মের নামগন্ধ বিষ্ণু বা ভাগবত বা অন্য পুরাণে নেই। রাধাই এই বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রস্বরূপ। কবি জয়দেব গীতগোবিন্দ কাব্যে এই নতুন বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বন করেই গোবিন্দগীতি রচনা করেছেন। এই ধর্ম অবলম্বন করেই শ্রীচৈতন্য কান্তরসাশ্রিত অভিনব ভক্তিবাদ প্রচার করেছেন।

পাঠকের অবগতির জন্য কৃষ্ণজীবনী অতি সংক্ষেপে বিবৃত করি। জন্মমুহূর্তে গোকুলে যশোদার শূন্যবক্ষে আশ্রয় পেলেন, পরে গোকুলের অধিবাসীদের নতুন বাসস্থান বৃন্দাবনে নীত হলেন, দশ বছর আট মাস বয়সে কংসবধে মথুরায় আনীত হলেন, জীবনে আর বৃন্দাবনে ফেরেননি। অধুনা মধ্যপ্রদেশের ক্ষিপ্রা (উচ্চারণগত কারণে শিপ্রা) নদীতীরবর্তী উজ্জয়িনীতে অবস্থিত সান্দিপনী মুনির আশ্রমে চৌষট্টি দিন অস্ত্রশিক্ষা শেষে কৃষ্ণ-বলরাম মথুরায় ফিরে আসেন। অসামান্য শারীরিক বলে বলীয়ান কৃষ্ণের কৈশোরক ক্ষিপ্রতায় কংসকে বধ করার পরিণাম হলো ভয়াবহ। সাম্রাজ্য-অভিলাষী জরাসন্ধের জামাতা কংসকে বধ করে হয়তো তিনি খুব চাপে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি চলে গেলেন হিমালয়ে—আঙ্গিরসবংশীয় ঘোর ঋষির কাছে একাদিক্রমে দশ বছর বেদ অধ্যয়ন ও যোগাভ্যাস করলেন। ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে এমন প্রমাণ পেয়েছি। মথুরায় ফিরে তিনি আবার জরাসন্ধের বিদ্বেষের মুখে পড়লেন। ক্রমে যাদবদের নেতৃত্ব তাঁর বৃষস্কন্ধে এসে পড়ল। পৌনঃপুনিক আক্রমণে দিশেহারা যাদবদের জন্য কৃষ্ণ রৈবতক পর্বতকে সামনে রেখে দুর্গ নির্মাণ করে সেখানে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে দ্বারকাদ্বীপে নতুন পুরী নির্মাণ করে যাদবেরা সেখানে নিরাপদ হলেন। এবার কৃষ্ণ জরাসন্ধবধে তৎপর হলেন। কৃষ্ণদ্বেষীরা বলেন, জরাসন্ধবধে তিনি কপটতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি নিজে যেহেতু জরাসন্ধের সঙ্গে বলে-বুদ্ধিতে এঁটে উঠতে পারেননি, তাই ভীমার্জুনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে জরাসন্ধপুরে ঢুকে অপকৌশলে তার প্রাণহানি ঘটান।

পাঠক আসুন, জরাসন্ধপুরে উঁকি মেরে দেখি, সেদিন কী ঘটেছিল! তাঁরা তিনজন জরাসন্ধের রাজধানীতে উপস্থিত হয়ে, তার প্রাসাদের ঢাক-প্রাচীরস্থাপত্য প্রভৃতি ভেঙে ফেলে সরবে তার সভায় উপস্থিত হয়ে তাঁদের অভিপ্রায় জানালেন। জরাসন্ধ সেদিন প্রস্তুত ছিলেন না। রাত্রে তাঁরা জরাসন্ধের প্রাসাদে অবস্থান করলেন। নিশীথকালে যজ্ঞাগারে জরাসন্ধ তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের পূজা করতে উদ্যত হলে কৃষ্ণ বললেন, হে বৃহদ্রথনন্দন, বীর ব্যক্তিগণ শত্রুগৃহে অপ্রকাশ্যভাবে এবং সুহৃদগৃহে প্রকাশ্যভাবে প্রবেশ করে থাকেন। হে রাজন! আমরা নিজেদের উদ্দেশ্যসাধনে শত্রুগৃহে এসে তার পূজা গ্রহণ করি না। এই আমাদের নিত্যব্রত।

জরাসন্ধ বললেন, আমি কোনো সময়ে তোমাদের সঙ্গে শত্রুতা করেছি, এমন স্মরণ হয় না। তাহলে কিসের জন্য বিনা অপরাধে আমাকে শত্রুজ্ঞান করছ?
কৃষ্ণ বললেন, তুমি রাজাদের মহাদেবের কাছে বলি দেওয়ার জন্য বন্দী করেছ। তাই যুধিষ্ঠিরের নিয়োগক্রমে আমরা তোমার প্রতি সমুদ্যত হয়েছি। তোমার পাপে আমাদেরও পাপ। যেহেতু আমরা ধর্মচারী ও ধর্মরক্ষায় সমর্থ, তাই এই অন্যায়ের প্রতিকার করতে এসেছি। আমরা ক্ষত্রিয়—যুদ্ধ প্রার্থনা করি, অন্য কিছু নয়।’
জরাসন্ধ বললেন, ‘দেখ, ধর্ম ও অর্থের উপঘাতে মনঃপীড়া জন্মে। কিন্তু যে ব্যক্তি ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করে ধর্মজ্ঞ হয়েও নিরপরাধ লোকের ধর্মার্থে উপঘাত করে, তার ইহকালে অমঙ্গল ও পরকালে নরকগমন হয়।’
ধর্মের রক্ষা অর্থাৎ নির্দোষ অথচ প্রপীড়িত রাজাদের উদ্ধার করাই কৃষ্ণের উদ্দেশ্য। তিনি জরাসন্ধকে অনেক বোঝালেন। তারপর বললেন, ‘আমি বাসুদেবনন্দন কৃষ্ণ, আর এই দুই বীরপুরুষ পাণ্ডুতনয়। আমরা তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি, এখন হয় ভূপতিদের পরিত্যাগ কর, নয় যুদ্ধ করে যমালয়ে যাও।’
জরাসন্ধ দ্বৈরথে সমাধান খুঁজলেন। পাছে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়, সে কথা ভেবে জরাসন্ধ তাঁর পুত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তারপর পৌরবর্গ ও মগধবাসীদের সমক্ষে দ্বৈরথ শুরু হল। একে একে ১৪ দিন যুদ্ধ হলো। যুদ্ধকালে জরাসন্ধের পুরোহিত যুদ্ধজাত অঙ্গবেদনানাশক ওষুধাদি নিয়ে কাছাকাছি রইলেন। ভীমার্জুন-কৃষ্ণের জন্য অবশ্য সে রকম ব্যবস্থা হলো না।
যুদ্ধের জন্য ভীমকে মনোনীত করে জরাসন্ধ যশস্বী ব্রাহ্মণকে দিয়ে স্বস্ত্যয়ন করে ক্ষত্রধর্ম অনুসারে বর্ম ও কিরীট ত্যাগ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে জনতার ঢল নামল। বর্ণনির্বিশেষে যাবতীয় পুরবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তাঁদের সংগ্রাম দেখতে সেখানে উপস্থিত হলেন। বিনা ভোজনে ও বিনা বিশ্রামে তারা একটানা ১৩ দিন যুদ্ধ করলেন। চতুর্দশ দিনে বাসুদেব জরাসন্ধকে ক্লান্ত দেখে ভীমসেনকে সম্বোধন করে বললেন, ‘কৌন্তেয়! ক্লান্ত শত্রুকে পীড়ন করা উচিত নয়; অধিকতর পীড়িত হলে জীবন ত্যাগ করে। অতএব ইনি তোমার পীড়নীয় নহেন। হে ভারতর্ষভ, এঁর সঙ্গে বাহুযুদ্ধ কর।’ কিন্তু ভীম সে কথা শুনলেন না। তিনি শ্রান্ত ও বয়োবৃদ্ধ জরাসন্ধকে পীড়ন করেই হত্যা করলেন। তারপর তাঁরা কারারুদ্ধ মহীপালদের বিমুক্ত করলেন এবং জরাসন্ধপুত্র সহদেবকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। এখানে কপটতার আশ্রয় তিনি কখন কোথায় নিলেন, ঠিক বোঝা গেল না।

দ্রোণবধে যুধিষ্ঠির উচ্চারিত ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ নাকি কৃষ্ণের শেখানো হীনকৌশল, তার সারবত্তা কতটুকু এবার তলিয়ে দেখা যাক। যুদ্ধকালে গুজব ছড়ানো একপ্রকারের রণ-কৌশল। তাই মহাভারতকার এক কৌশল অবলম্বন করলেন। অশ্বত্থামা হত্যাসংক্রান্ত গুজব সেই রকম একটা কৌশল। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সত্যবাদী বলে সর্বজনবিদিত। যুধিষ্ঠির যদি বলেন অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন, তাহলে পিতার মনোবলে চিড় ধরতে পারে; তিনি রণেভঙ্গ দিতে পারেন। যুধিষ্ঠির বললেন, অশ্বত্থামা কুঞ্জর মরেছে, কিন্তু কুঞ্জর শব্দটা অব্যক্ত রইল। মহাভারতে এতদ্সংক্রান্ত শ্লোকটি এ রকম: 
তমতথ্যভয়ে মগ্নো জয়ে সক্তো যুধিষ্ঠিরঃ।/ অব্যক্তমব্রবীদ্বাক্যং হতঃ কুঞ্জর ইত্যুত ॥ 

‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ বলে বহুল প্রচলিত যে কথাটা আছে, তা মহাভারতের নয়। বোধ হয় কথকঠাকুরদের তৈরি। যাহোক, তাতেও কাজ হলো না। বৃদ্ধ ক্ষণকাল বিমনা হলেন বটে, তারপর বিপুলবিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তিনি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে অন্যায়ভাবে অসংখ্য সৈন্য বধ করতে লাগলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ দ্রোণের দিকে ধেয়ে গেলেন। মহাভারত থেকে পুনরায় উদ্ধৃত করছি: ‘মহারথ দ্রোণও মরণে কৃতসংকল্প হয়ে সমাগত বীরদের দিকে সবেগে ধাবিত হলেন। তাঁর গমনবেগে এমনভাবে মাটি কেঁপে উঠল ও প্রবলবেগে বাতাস বইতে লাগল যে, সৈন্যরা ভয় পেয়ে গেল। সূর্য থেকে উল্কাবৃষ্টি হতে লাগল, তার বিদ্যুৎপ্রভায় দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশস্ত্র ঝলসে উঠল। রথের ভীষণ শব্দ হতে লাগল, কষ্টে ঘোড়ার চোখ থেকে জল ঝরতে লাগল। তখন মহারথ দ্রোণ নিতান্ত নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। তাঁর বাঁ চোখ ও বাঁ হাত কাঁপতে লাগল। তিনি সামনে ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে নিতান্ত উন্মনা হলেন এবং ব্রহ্মবাদী ঋষিদের কথা স্মরণ করে ধর্মযুদ্ধ অবলম্বন করে প্রাণত্যাগ করতে মনস্থ করলেন।’ পাঠক দেখবেন, এখানেও দ্রোণের প্রাণত্যাগের অভিপ্রায়ের মধ্যে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পরিগণিত হয়নি। তিনি ধর্মাত্মা, কিন্তু অধর্মযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। বুঝলেন, তিনি অন্যায়ভাবে প্রাণিসংহার করে চলেছেন। তিনি নিতান্ত নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। তবু তিনি যুদ্ধে বিমুখ হতে পারেন না। অপটুতা এবং দুর্যোধনকে বিপৎকালে ত্যাগ করা তাঁর মতো বীর ব্রাহ্মণের কাজ নয়। তাই মৃত্যুই স্থির করলেন। তিনি অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে শমভাব অবলম্বন করে বিষ্ণুর ধ্যান করতে লাগলেন। মুখ সামান্য নামানো, বক্ষস্থল স্তিমিত—দুচোখ বন্ধ করে বিষয়বাসনা ত্যাগ ও সাত্ত্বিকভাব অবলম্বন করে তিনি একাক্ষর বেদমন্ত্র ওঁকার এবং বারবার বাসুদেবকে স্মরণ করে সাধুজনের দুর্লভ স্বর্গলোকে গমন করলেন। ওই সময় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তরবারি হাতে দ্রোণর দিকে ছুটে গেলেন এবং মৃতদেহের মাথা কেটে আনলেন। এভাবে দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নর বশীভূত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে হাহাকার পড়ে গেল।

দ্রোণ নিহত হলে অর্জুন গুরুর শোকে অত্যন্ত কাতর হলেন। মিথ্যা বলে গুরুকে হত্যা করার জন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার এবং ধৃষ্টদ্যুম্নর নিন্দা করলেন। যুধিষ্ঠির ভালো মানুষ, কিছু উত্তর দিলেন না। কিন্তু ভীম অর্জুনকে কিছু কড়া কথা শোনালেন। ধৃষ্টদ্যুম্নও অর্জুনকে আরও কড়া কথা শোনালেন। তখন অর্জুন-শিষ্য যদুবংশীয় সাত্যকি অর্জুনের পক্ষ নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে খুব গালিগালাজ করলেন। ফলে উভয়ে রেগে গিয়ে একে-অপরকে বধ করতে উদ্যত হলেন। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম ও সহদেব তাদের থামালেন। মিথ্যা কথা বলে দ্রোণহত্যা উচিত কি অনুচিত—এই বিতর্কে দুই পক্ষে বাদানুবাদ চলতে লাগল। কিন্তু কেউই কৃষ্ণকে ভালো-মন্দ কিছুই বললেন না, এমনকি তাঁর নামও নিলেন না। কৃষ্ণ জড়িত থাকলে মহাভারতের কবি নিশ্চয়ই নীরব থাকতেন না।

এবার আসা যাক কর্ণবধ প্রসঙ্গে। অন্যায় যুদ্ধে কৃষ্ণ তাঁকে নিধন করিয়েছেন বলে ব্যাপক প্রচার। কর্ণ মহাবীর, কুন্তীর কুমারীকালীন সন্তান, সে-অর্থে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব, এ কথা কৃষ্ণ তাঁর অলোকসামান্য বুদ্ধিবলে আগে থেকেই জানতেন। সেই কর্ণ যখন কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে কৌরবদের অন্যতম কান্ডারি, কৃষ্ণ চেয়েছিলেন, জ্যেষ্ঠতার যাবতীয় প্রাপ্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁকে পাণ্ডবপক্ষে টানতে। কিন্তু কর্ণ ফিরলেন না, ফিরতে পারেন না বলেই, মায়ের প্রতি তীব্র অভিমান, অর্জুনের প্রতি অসুয়া, দুর্যোধনের প্রতি আনুগত্য, পালক মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে কর্ণ কৃষ্ণের প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন। কৃষ্ণ একান্তই যুদ্ধ এড়াতে চাইছিলেন, কিন্তু তাঁর কূটনীতি ব্যর্থ হলো।

কর্ণ-অর্জুনে যুদ্ধ শুরু হলো। কর্ণের সর্পবাণ অর্জুন নিবারণ করতে পারেননি, কৃষ্ণ পদাঘাতে অর্জুনের রথ মাটিতে কিছুটা বসিয়ে দিলেন, ঘোড়াগুলো হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। অর্জুনের মাথা বেঁচে গেল বটে, তবে কিরীট কাটা পড়ল। যুদ্ধের শেষভাগে কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। কর্ণ তা তোলার জন্য অর্জুনের কাছে সময়ভিক্ষা করে বললেন, ‘অসহায়কে বধ করা বীরের ধর্ম নয়।’

কৃষ্ণ কথাটা ধরলেন। বললেন, ‘সূতপুত্র! তুমি এখন বিপদে পড়ে ধর্ম স্মরণ করছ। নীচাশয়রা দুঃখে পড়ে প্রায়ই দৈবের নিন্দা করে; নিজের অপকর্মের প্রতি দৃক্পাত করে না। দুর্যোধন দুঃশাসন ও শকুনি যখন তোমার মত নিয়ে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে কৌরবসভায় নিয়ে এসেছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন দুষ্ট শকুনি দুরভিসন্ধিমূলকভাবে তোমার মত নিয়ে পাশা খেলায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠিরকে হারিয়ে দিয়েছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন রাজা দুর্যোধন তোমার মত নিয়ে ভীমসেনকে বিষমিশ্রিত ভাত খেতে দিয়েছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি বারণাবত নগরে জতুগৃহে ঘুমন্ত পা-বদের পুড়িয়ে মারার জন্য আগুন দিয়েছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? তুমি সভামধ্যে দুঃশাসনের হাতে নিগৃহীত রজস্বলা দ্রৌপদীকে ‘পাণ্ডবরা বিনষ্ট হয়ে শাশ্বত নগরে গমন করেছে, এখন তুমি অন্য কাউকে পতিত্বে বরণ কর’ বলে উপহাস করেছিলে এবং অনার্য ব্যক্তিরা তাঁকে বিনা অপরাধে নির্যাতন করেছিল, তুমি তা উপেক্ষা করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি রাজ্যলোভে শকুনির সঙ্গে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আহ্বান জানিয়েছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি মহারথ পরিবেষ্টিত হয়ে বালক অভিমন্যুকে হত্যা করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? তুমি তখন একের পর এক অধর্মানুষ্ঠান করেছ, আর এখন অর্জুনকে ধর্মজ্ঞান দিচ্ছ। তুমি এখন ধর্মপরায়ণ হলেও জীবনসত্ত্বে মুক্তিলাভ করতে পারবে, এমন ভেব না। পূর্বে নিষধ দেশের রাজা নল যেমন পুষ্কর দিয়ে পাশা খেলায় হেরে গিয়ে আবার রাজ্যলাভ করেছিলেন, এখনো তেমনি ধর্মপরায়ণ পাণ্ডবেরা বাহুবলে শত্রুদের বিনাশ করে রাজ্যলাভ করবেন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা অবশ্যই ধর্মরক্ষক পাণ্ডবদের হাতে নিহত হবে।’

কৃষ্ণের কথা শুনে কর্ণ লজ্জায় মাথা নত করলেন। ততক্ষণে তাঁর রথের চাকা তোলা হয়ে গেছে। তিনি আবার রথে উঠে আগের মতো যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং একসময় অর্জুনের বাণে তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘শরতের আকাশ থেকে স্খলিত সূর্যের মতো’ মাটিতে পড়ে গেল।

আঠারো দিন যুদ্ধ হয়েছে। ভীম ও দুর্যোধনের মধ্যেই সব সময় যুদ্ধ হয়েছে। গদাযুদ্ধও অনেকবার হয়েছে এবং বরাবরই দুর্যোধন গদাযুদ্ধে ভীমের কাছে পরাজিত হয়েছেন। সভাপর্বে যখন পাশা খেলায় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে জিতে নিলেন, তখন দুঃশাসন একবস্ত্রা রজস্বলা দ্রৌপদীর চুল ধরে সভামধ্যে টেনে এনে বিবস্ত্রা করছিল, সে সময় ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আমি দুঃশাসনকে হত্যা করে তার বুক চিরে রক্ত পান করব। ভীম মহাশ্মশানের মতো বিকট রণক্ষেত্রে দুঃশাসনকে হত্যা করে রক্তপান করে বলেছিলেন, ‘আমি অমৃত পান করলাম।’ দুর্যোধন সেই সভামধ্যে হাসতে হাসতে দ্রৌপদীর দিকে চেয়ে কাপড় তুলে অশ্লীলভাবে নিজের ঊরু দেখিয়েছিলেন। তখন ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘আমি মহাযুদ্ধে গদাঘাতে ওই উরু যদি না ভাঙি, তবে যেন নরকে যাই।’
কিন্তু গদাযুদ্ধের নিয়ম এই যে, নাভির নিচে আঘাত করা যাবে না। কিন্তু ভীম প্রবল আক্রোশে গদার আঘাতে দুর্যোধনের ঊরু ভেঙে তাকে মাটিতে ফেলে দিলেন।

যুদ্ধকালে দর্শকদের মাঝে বলরাম উপস্থিত ছিলেন। ভীম ও দুর্যোধন উভয়েই গদাযুদ্ধে তাঁর শিষ্য। তবে দুর্যোধনই প্রিয়তর। অন্যায় যুদ্ধে দুর্যোধনকে নিপাতিত হতে দেখে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে লাঙল উঁচিয়ে ভীমকে মারতে গেলেন। কৃষ্ণ অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে নিরস্ত করলেন। বলরাম কৃষ্ণের কথায় সন্তুষ্ট হলেন না, রাগ করে সেখান থেকে চলে গেলেন।

ভীম নিপাতিত দুর্যোধনের মাথায় লাথি মারছিলেন। যুধিষ্ঠিরের বারণ সত্ত্বেও ভীম ক্রমাগত লাথি মেরেই চলছিলেন। তখন কৃষ্ণ ভীমকে না ঠেকানোর জন্য যুধিষ্ঠিরকে ভর্ৎসনা করলেন। এদিকে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ দুর্যোধনের নিপাতে তার নিন্দা এবং ভীমের প্রশংসা করতে লাগলেন। কৃষ্ণ তাতে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মৃতকল্প শত্রুর প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করা উচিত নয়।’ দুর্যোধনের প্রাণবায়ু তখনো নির্গত হয়নি। এ সময় অশ্বত্থামা তাকে দেখতে এলেন। কাতর দুর্যোধন তাঁকে বললেন, ‘আমি অমিততেজা বাসুদেবের মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত। তিনি আমাকে ক্ষত্রিয়ধর্ম থেকে বিচ্যুত করেননি। আমার জন্য শোক কোরো না।’

এদিকে কৃষ্ণের বিদায়কালে যুধিষ্ঠির তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন যে অশ্বমেধ যজ্ঞকালে আবার আসতে হবে। এখন সেই যজ্ঞের সময় হয়েছে। কাজেই তিনি যাদবদের নিয়ে পুনরায় হস্তিনায় গমন করলেন।

হস্তিনায় এলে অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরা একটি মৃত সন্তান প্রসব করলেন। কৃষ্ণ তাকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। এর মধ্যে কোনো ঐশী শক্তির প্রয়োগ ছিল, এমন না-ও হতে পারে। এখনকার অনেক চিকিৎসকই মৃত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন এবং করে থাকেন এবং কীভাবে করে থাকেন, তা আমরা অনেকেই জানি। এ ঘটনায় প্রমাণ হয়, তখনকার লোক জানতেন না, এমন অনেক জিনিস কৃষ্ণের জানা ছিল। তিনি আদর্শ মানুষ, এ জন্য সব ধরনের বিদ্যা ও জ্ঞান তাঁর অধিকারে ছিল। উত্তরার এই সন্তানই পরীক্ষিত। পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জনমেজয় সম্রাট হন। জনমেজয় একদা ব্রহ্মহত্যাজনিত মহাপাপ খণ্ডনের জন্য সর্পযজ্ঞের আয়োজন করেন। সেখানে ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নের কাছে বেদব্যাস রচিত মহাভারতের কাহিনি শ্রবণ করেন। সেই কাহিনিই পরে উগ্রশ্রবা সৌতি নৈমিষারণ্যে শৌনক প্রভৃতি ঋষিদের কাছে কীর্তন করেন।

কুরুক্ষেত্রের মহারণের পর সারা ভারত কৃষ্ণের পদতলে এসেছিল—পল্লব, বিদেহ, মিথিলাম মৎস্য, চক্র, অবন্তী, আভির, অটবী, বহুমান্য, ত্রিপুরা, উত্তরজ্যোতিষ সমস্ত রাজ্য বাসুদেবকে ‘রাজার রাজা’ বলে স্বীকার করে নেয়।

যা হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো। যজ্ঞ সমাপনে কৃষ্ণ আবার দ্বারকায় ফিরে গেলেন। তারপর পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি।

কৃষ্ণ যদুবংশের ধ্বংস নিবারণে কোনো উদ্যোগ নেননি। তিনি মানবকুলের আদর্শ। তাঁর কাছে আত্মীয়-অনাত্মীয় নেই। তিনি ধর্মের রক্ষক। অধর্মের পক্ষাবলম্বন তিনি কখনোই করতে পারেন না। যদুবংশীয়রা তখন অধার্মিক হয়ে উঠেছিল, কাজেই আত্মীয় হলেও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা কৃষ্ণ করতে পারেন না।

কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণ কতকটা অনিশ্চিত থেকে গেল। তিনি যোগাবলম্বনে দেহত্যাগ করেছিলেন বলেই মনে হয়। যারা যোগাভ্যাসকালে নিশ্বাস অবরুদ্ধ করার অভ্যাস করেছেন, তাঁরা নিশ্বাস বন্ধ করে নিজের মৃত্যু সম্পাদন করতে পারেন না, এমন কথা আমি সাহস করে বলতে পারি না। প্রাচীন বয়সে জীবনের সব কাজ শেষ হলে ঈশ্বরে লীন হওয়ার জন্য মনোমধ্যে তন্ময় হয়ে শ্বাসরোধ করাকে আমি ‘ঈশ্বরপ্রাপ্তি’ বলেই মনে করি। এ সময় কৃষ্ণের বয়স শতবর্ষের অধিক হয়েছিল। জরা ব্যাধের শরাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বলে বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে। এ জরাব্যাধ, জরাব্যাধি নয় তো? এটি হয়তো সাধারণ জৈব বার্ধক্যের একটি রূপকমাত্র।

যতটুকু সত্য পুরাণেতিহাসে পাওয়া যায়, তার আলোকে কৃষ্ণচরিত্র কেমন প্রতিপন্ন হলো। দেখেছি, শৈশবে কৃষ্ণ শারীরিক বলে অতিশয় বলবান। তাঁর অমিত বলপ্রভাবে বৃন্দাবনে হিংস্র জীবজন্তু পরাভূত হতো—কংসের মল্ল প্রভৃতিও নিহত হয়েছিল। গোচারণকালে খেলাধুলা ও ব্যায়াম করায় তিনি শারীরিক বলে বলীয়ান হয়ে উঠেছিলেন। দ্রুতগমনে তিনি কালযবনকেও পরাভূত করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর রথচালনার বিশেষ প্রশংসা দেখা যায়।

প্রশিক্ষিত শারীরিক বলে তিনি সে সময়ের ক্ষত্রিয়সমাজে সর্বপ্রধান অস্ত্রবিদ বলে গণ্য হয়েছিলেন। কেউ তাঁকে হারাতে পারেননি। তিনি কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি সে সময়ের প্রধান প্রধান যোদ্ধা এবং অন্যান্য বহুতর রাজাদের সঙ্গে—কাশী, কলিঙ্গ, পৌণ্ড্রক, গান্ধার প্রভৃতি রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত হয়ে তাঁদের সবাইকেই পরাভূত করেন। তাঁর যুদ্ধশিষ্যরা, যেমন সাত্যকি ও অভিমন্যু যুদ্ধে প্রায় অপরাজেয় হয়ে উঠেছিলেন। স্বয়ং অর্জুনও কোনো কোনো বিষয়ে যুদ্ধ সম্বন্ধে তাঁর শিষ্যত্ব স্বীকার করেছিলেন।

কেবল শারীরিক বল ও শিক্ষার ওপর যে রণনৈপুণ্য নির্ভর করে, পুরাণেতিহাসে তারই প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু সে ধরনের রণনৈপুণ্য একজন সামান্য সৈনিকেরও থাকতে পারে। সেনাপতিত্বই যোদ্ধার প্রকৃত গুণ। এই সেনাপতিত্বে সে সময়ের যোদ্ধারা তেমন পটু ছিলেন না। কৃষ্ণের সেনাপতিত্বের বিশেষ গুণ প্রথম জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর সেনাপতিত্বের গুণে ক্ষুদ্র যাদবসেনারা জরাসন্ধের সংখ্যাতীত সেনাকে মথুরা থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল। সেই অগণনীয় সেনার ক্ষয় যাদবদের পক্ষে অসাধ্য জেনে কৃষ্ণের মথুরা পরিত্যাগ করে নতুন নগরী নির্মাণের জন্য সাগরদ্বীপ দ্বারকার নির্বাচন এবং তার সামনে অবস্থিত রৈবতক পর্বতমালায় দুর্ভেদ্য দুর্গশ্রেণি নির্মাণে যে রণনীতিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমন পরিচয় পুরাণেতিহাসে আর কোনো ক্ষত্রিয়েরই পাওয়া যায় না। পুরাণকার ঋষিরাও তা জানতেন না, এতেই প্রমাণিত হয় কৃষ্ণেতিহাস তাঁদের কল্পনাপ্রসূত নয়।

কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তির প্রভূত পরিচয় আমরা পেয়েছি। তিনি অদ্বিতীয় বেদজ্ঞ, এটিই ভীষ্ম তাঁর অর্ঘ্যপ্রাপ্তির অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছিলেন। শিশুপাল সে কথার কোনো উত্তর দেননি, কেবল বলেছিলেন, তবে বেদব্যাস থাকতে কৃষ্ণের পূজা কেন?

কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তির চরম উৎকর্ষের পরিচয় শ্রীশ্রী গীতা। এখানে তিনি এক অতুল্য ধর্মকথার প্রবর্তন করেছেন। তবে এই ধর্মকথা যে শুধু গীতাতেই পাওয়া যায়, এমন নয়, মহাভারতের অন্য স্থানেও পাওয়া গেছে। কৃষ্ণ-কথিত ধর্মের চেয়ে উন্নত, সর্বলোকের পক্ষে মঙ্গলকর, সর্বজনের আচরণীয় ধর্ম পৃথিবীতে আর কখনো প্রচারিত হয়নি। এই ধর্মে যে জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়, তা প্রায় মনুষ্যাতীত। কৃষ্ণ মানুষী শক্তির দ্বারা সব কাজ করেছেন, আমি তা বারবার বলেছি, প্রমাণ করেছি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত জ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছেন।

সর্বজনীন ধর্মপ্রচারের পর রাজধর্ম বা রাজনীতিতেও তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্ভ্রান্ত রাজনীতিজ্ঞ বলেই যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবের পরামর্শ পেয়েও কৃষ্ণের পরামর্শ ব্যতীত রাজসূয় যজ্ঞে হাত দেননি। অবাধ্য যাদবেরা এবং বাধ্য পাণ্ডবেরা তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে কোনো কাজ করতেন না। জরাসন্ধকে হত্যা করে কারারুদ্ধ রাজাদের মুক্ত করা উন্নত রাজনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ, সাম্রাজ্য স্থাপনের অল্প আয়াসসাধ্য অথচ পরম ধর্মসিদ্ধ উপায়। ধর্মরাজ্য সংস্থাপনের পর ধর্মরাজ্য শাসনের জন্য রাজধর্ম নিয়োগে ভীষ্মের দ্বারা রাজব্যবস্থা সংস্থাপন করানো, রাজনীতিজ্ঞতার দ্বিতীয় উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

কৃষ্ণের বুদ্ধি লোকাতীত, তা সর্বব্যাপী, সর্বদর্শী, সকল প্রকার উপায়ের উদ্ভাবিনী। মনুষ্য শরীর ধারণ করে যত দূর সর্বজ্ঞ হওয়া যায়, কৃষ্ণ তত দূর সর্বজ্ঞ। অপূর্ব অধ্যাত্মতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব, যার ওপরে আজও মানুষের বুদ্ধি যায়নি, তা থেকে চিকিৎসাবিদ্যা, সংগীতবিদ্যা, এমনকি অশ্বপরিচর্যা পর্যন্ত তাঁর আয়ত্ত ছিল। উত্তরার মৃত পুত্রের পুনর্জীবন এর প্রথম উদাহরণ; বিখ্যাত বংশীবিদ্যা দ্বিতীয় এবং জয়দ্রথবধের দিন অশ্বের শরীরে বেঁধা তীর-উদ্ধার তৃতীয় উদাহরণ।

কৃষ্ণের কার্যকারিণী বৃত্তিসমূহের তুলনা চলে না। তাঁর সাহস, ক্ষিপ্রতা এবং সকল কাজে তৎপরতার অনেক পরিচয় দিয়েছি। তাঁর ধর্ম ও সত্য যে অবিচলিত, এ জীবনচরিতে তার অনেক প্রমাণ দেখেছি। সর্বজনে দয়া এবং প্রীতি এ জীবনালেখ্যে পরিস্ফুট হয়েছে। বলবানদের চেয়ে বলবান হয়েও মানুষের কল্যাণে তিনি শান্তির জন্য দৃঢ়যত্ন ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সকলের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, শুধু মানুষ নয়, ইতর প্রাণীর প্রতিও তাঁর অসামান্য দয়া। গিরিযজ্ঞে তা পরিস্ফুট। তিনি আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেমন হিতৈষী, তা দেখেছি, আবার এ-ও দেখেছি, আত্মীয় পাপাচারী হলে তিনি তার শত্রু। তাঁর অপরিসীম ক্ষমাগুণ দেখেছি, আবার এ-ও দেখেছি, কার্যকালে লৌহহৃদয়ে অকুণ্ঠিতভাবে তিনি দণ্ড বিধান করেন। তিনি স্বজনপ্রিয়, কিন্তু মানুষের কল্যাণে স্বজনের বিনাশেও তিনি কুণ্ঠিত নন। কংস মাতুল, পাণ্ডবেরা যা, শিশুপালও তা, উভয়েই পিসির পুত্র; উভয়কেই দণ্ডিত করলেন; তারপর, পরিশেষে স্বয়ং যাদবেরা সুরাপায়ী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠলে তিনি তাদেরকেও রক্ষা করলেন না।

এসব শ্রেষ্ঠ বৃত্তি কৃষ্ণচরিত্রে চরমভাবে বিকশিত হয়েছিল বলে, লোকচিত্তরঞ্জিণী বৃত্তির অনুশীলনে তিনি অমনোযোগী ছিলেন, এমন নয়। যে জন্য বাল্যে বৃন্দাবনে ব্রজলীলা, পরিণত বয়সে সেই উদ্দেশ্যে সমুদ্রবিহার, যমুনাবিহার, রৈবতক বিহার।

কেবল একটা কথা এখনো বাকি আছে। আমার ধর্মতত্ত্ব নামক বইয়ে বলেছি, ভক্তিই মানুষের প্রধান বৃত্তি। কৃষ্ণ আদর্শ মানুষ, মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচারের জন্য তিনি অবতীর্ণ, তাঁর ভক্তির প্রকাশ তেমন দেখলাম কই? যদি তিনি ঈশ্বরাবতার হন, তবে তাঁর এই ভক্তির পাত্র কে? তিনি নিজে! নিজের প্রতি যে ভক্তি, সে কেবল নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন ভাবলেই আসে। এই ভাবনা জ্ঞানমার্গের চরম। একে আত্মরতি বলে। ছান্দোগ্য উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে, ‘য এবং পশ্যন্বেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দঃ স স্বরাড়্ ভবতীতি।’ অর্থাৎ ‘যে এ দেখে, এ ভেবে এ জেনে আত্মায় রত হয়, আত্মাতেই ক্রীড়াশীল হয়, আত্মাই যার মিথুন (সহচর), আত্মাই যার আনন্দ, সে স্বরাট্।’
এই কথাই গীতায় কীর্তিত হয়েছে, কৃষ্ণ আত্মারাম; আত্মা জগন্ময়; তিনি সেই জগতে প্রীতিবিশিষ্ট।

উপসংহারে বক্তব্য এই যে কৃষ্ণ সব জায়গায় সব সময় সব রকম গুণের অভিব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল। তিনি অপরাজেয়, অপরাজিত, বিশুদ্ধ, পুণ্যময়, প্রীতিময়, দয়াময়, অনুষ্ঠেয় কাজে সদা তৎপর—ধর্মাত্মা, বেদজ্ঞ, নীতিজ্ঞ, ধর্মজ্ঞ, লোকহিতৈষী, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, শাস্তিদাতা, নির্মম, নিরহংকার, যোগযুক্ত, তপস্বী। তিনি মানুষী শক্তি দিয়ে কার্যনির্বাহ করেন, কিন্তু তাঁর চরিত্র মনুষ্যাতীত। এ রকম মানুষী শক্তির দ্বারা অতিমানবীয় চরিত্রের বিকাশ থেকে তাঁর মনুষ্যত্ব বা ঈশ্বরত্ব অনুমান করা উচিত কি না, তা পাঠক নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুসারে স্থির করুন। যিনি মীমাংসা করবেন কৃষ্ণ মানুষ ছিলেন মাত্র, তিনি স্বীকার করবেন, কৃষ্ণ হিন্দুদের মধ্যে পরম জ্ঞানী এবং মহত্তম ছিলেন। আর যিনি বুঝবেন, এই কৃষ্ণচরিত্রে ঈশ্বরের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়, তিনি এই বই পাঠ করে দুই হাত জোড় করে বিনীতভাবে আমার সঙ্গে বলুন—নাকারণাৎ কারণাদ্বা কারণাকারণান্ন চ।/শরীরগ্রহণং বাপি ধর্মত্রাণায় তে পরম্’॥

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!