কোরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি মূলত তাকওয়া, ত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতীক। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর মহান ত্যাগের স্মরণে প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করে থাকেন।
কোরআনের আলোকে কোরবানির গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা বলেন: "তাদের মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।"
— (সূরা হজ: ৩৭)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য পশু জবাই নয়, বরং আত্মত্যাগ ও আল্লাহভীতি প্রকাশ।
আরও বলা হয়েছে, "প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া পশু জবাইয়ের মাধ্যমে তাঁর নাম স্মরণ করে।"— (সূরা হজ: ৩৪)
এ আয়াতে কোরবানিকে এক বিশুদ্ধ ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হাদিসে কোরবানির ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "কোরবানির দিনে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো পশু কোরবানি করা। কিয়ামতের দিন এই পশু তার শিং, খুর ও লোমসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। তাই খুশিমনে কোরবানি করো।" — (তিরমিজি: ১৪৯৩)
আরেক হাদিসে আছে, "যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।" — (ইবনে মাজাহ: ৩১২৩) এটি নির্দেশ করে যে কোরবানি সামর্থ্যবান মুসলিমদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
কোরবানির অন্তর্নিহিত শিক্ষা ও তাৎপর্য
তাকওয়া (আল্লাহভীতি) প্রকাশ
কোরবানি একটি পরীক্ষা, কে আল্লাহর আদেশে নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে। এটি প্রমাণ করে মুসলমান কেবল মুখে নয়, কাজেও আল্লাহর জন্য ত্যাগে প্রস্তুত।
ত্যাগের চর্চা
আমরা সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ (পশু) আল্লাহর নামে উৎসর্গ করি। এই চর্চা আমাদের জীবনেও ত্যাগ, ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়।
সমাজে সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ
কোরবানির মাংস গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করে সমাজে সহমর্মিতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়। এতে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমে।
সুন্নত প্রতিষ্ঠা
কোরবানি করা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। এই সুন্নতকে জীবিত রাখাই একজন প্রকৃত মুসলমানের দায়িত্ব।
কার জন্য কোরবানি ওয়াজিব?
কোরবানি ওয়াজিব হয় তার ওপর—যিনি মুসলিম ও প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান (আকিল-বালেগ), নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, স্থায়ীভাবে বাস করে এমন ব্যক্তি (মুসাফির নয়)। এসব শর্ত পূরণ হলে, ঈদুল আজহার ১০-১২ তারিখের মধ্যে একবার কোরবানি করা ফরজের কাছাকাছি ওয়াজিব ইবাদত।
কোরবানির নির্দিষ্ট সময়
কোরবানির সময় শুরু হয় ঈদুল আজহার নামাজের পর থেকে চলে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে পশু জবাই না করলে কোরবানি শুদ্ধ হয় না
কোরবানি করার নিয়ম
পশু কোরবানি নিজ হাতে করাই উত্তম। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণও নিজ হাতে কোরবানি করতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন। প্রতিবছরই তিনি কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৪৪৯)।
কোরবানি ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও যারা কোরবানি করে না, আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের ভর্ৎসনা করেছেন।
আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তার কোরবানির পশুর উপর পা দিয়ে চেপে ধরে নিজ হাতে কোরবানি করতে দেখেছি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৫৫)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) (কোরবানির আগে) ছুরি ধারালো করতে এবং তা পশুর দৃষ্টির অগোচরে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।’ ছুরি পশুর সামনে আনলে পশু ভয় পেয়ে যায়। এটি পশুকে কষ্ট দেওয়ারও শামিল। ‘তোমাদের কেউ জবাই করার সময় যেন তা দ্রুত সম্পন্ন করে (যাতে পশু অধিক পরিমাণে কষ্ট না পায়)।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৭২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা যখন জবাই করবে, কষ্ট না দিয়ে জবাই করো, আর তোমাদের ছুরিগুলো খুব ভালোভাবে ধারালো করে নাও, যাতে তোমরা তোমাদের জবাইকৃত পশুকে আরাম দিতে পারো।’ (সহীহ মুসলিম)।
জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) কোরবানির দিন (প্রথমেই) নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি খুতবা দেন। এরপর (কোরবানির পশু) জবাই করেন। তিনি ঘোষণা দেন—নামাজের আগে যে ব্যক্তি পশু জবাই করবে, তাকে নামাজের পর আরেকটি পশু জবাই করতে হবে…।’ (বুখারি, হাদিস : ৯২৮, ৬৮৮৪)।
পশুকে কোরবানি করার স্থানে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া অন্যায়। একটি পশুকে আরেকটি পশুর সামনে জবাই করা যাবে না। পশুকে কঠোরভাবে শোয়ানোর বিষয়েও নিষেধ রয়েছে।
কোরবানি করার সময় পশুকে বাম পাজরের উপর, দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে। এভাবেই পশুকে শোয়ানো উত্তম। পশুটিকে এমনভাবে ধরতে বা বেঁধে নিতে হবে যেন জবাইয়ের সময় সে পাগুলো বারবার ছুড়তে না পারে।
পশু জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ছুরি চালানো শুরু করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যেন পশু জবেহ করা না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য।
পশু জবাই করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী আর দুইপাশে থাকা দুটি নালী কেটে দেওয়া হয়। এ নালীগুলো কাটা হয়ে গেলেই পশু জবাই বিশুদ্ধ হয়ে যায়।
কোরবানির মাধ্যমে পাওয়া নেয়ামত
কোরবানির মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়, জান্নাত লাভের পথ প্রশস্ত হয়, মানুষের মাঝে সহানুভূতি তৈরি হয়, আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, ঈমান মজবুত হয়।