• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২, ২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

মে দিবস: শ্রমক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য কেন


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২৫, ১১:১৫ পিএম
মে দিবস: শ্রমক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য কেন
ছবি: সংগৃহীত

মে দিবস, যাকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসও বলা হয়। প্রতি বছর ১লা মে তারিখে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দিবসটি বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। এ দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের আত্মত্যাগ, অধিকার অর্জনের সংগ্রাম এবং ন্যায্য মজুরির দাবিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে আজকের এই আধুনিক সময়েও শ্রমক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য বিদ্যমান, তা সমাজের একটি গভীর সমস্যা হয়েই রয়ে গেছে। মে দিবসের আদর্শের সঙ্গে এই বৈষম্যের বিষয়টি একেবারেই সাংঘর্ষিক হলেও তা এখনও ভাবিয়ে তোলে গোটা বিশ্বকে।

নারী শ্রমিকের অবদান ও বাস্তবতা
নারীরা যুগে যুগে বিভিন্ন শ্রমক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন— চাষাবাদ, গার্মেন্টস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা, এমনকি নির্মাণশিল্পেও। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পে শতকরা ৮০ শতাংশের বেশি শ্রমিক নারী, যারা দিনের পর দিন স্বল্প মজুরিতে কঠোর পরিশ্রম করছেন। কিন্তু সেই পরিশ্রমের সঠিক মূল্য তারা অনেকেই পাচ্ছেন না। একই কাজ করলেও পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা কম মজুরি পান। এটা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য।

বেতন বৈষম্য
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও গবেষণায় দেখা গেছে, একই যোগ্যতা, দক্ষতা ও কাজের সময়সীমা থাকা সত্ত্বেও নারীরা গড়ে পুরুষদের তুলনায় প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কম বেতন পান। এর পেছনে যে কুসংস্কার ও লিঙ্গভিত্তিক ধ্যানধারণা কাজ করে, তা আজও অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রথাগতভাবে প্রচলিত। অনেক নিয়োগকর্তা মনে করেন, নারীরা দায়িত্ব পালন ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মক্ষেত্র স্থায়িত্বের দিক থেকে  পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি শ্রমক্ষেত্রে নারীদের প্রতি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য তৈরি করে।

পদোন্নতি ও নেতৃত্বে বৈষম্য
নারীরা প্রায়ই নিচু পর্যায়ের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকেন। উপরের পদ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে নারীর উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। কর্মদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও অনেক নারীকে শুধুমাত্র লিঙ্গগত কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এমনকি নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতে করে নারীরা প্রেরণা হারান এবং কর্মক্ষেত্রে মনোবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কাজের পরিবেশ ও হয়রানি
শ্রমক্ষেত্রে নারীরা অনেক সময় যৌন হয়রানির শিকার হন। গার্মেন্টস কারখানা থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিস পর্যন্ত সর্বত্রই এই সমস্যাটি বিদ্যমান। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নারীর অধিকার হলেও বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ করার সুযোগ বা ন্যায্য বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এর ফলে নারীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন।

কাজ ও পারিবারিক ভারসাম্য
নারীদের ক্ষেত্রে কর্মজীবনের পাশাপাশি পারিবারিক দায়িত্ব বহনের চাপ পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। মা, স্ত্রী, কন্যা হিসেবে একজন নারীকে প্রতিদিন বহু ভূমিকা পালন করতে হয়। কর্মস্থলে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবার ও সমাজের মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। যাতে নারী শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পেশাগত জীবনেও পূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারেন।

আইন ও বাস্তবতা
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই শ্রম আইনে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন। অনেক সময় এই আইন বাস্তবায়নে গাফিলতি দেখা যায়। একদিকে নিয়োগদাতাদের অসচেতনতা, অন্যদিকে নারীদের অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা উভয়ই এই বৈষম্য টিকিয়ে রাখে।

বৈষম্য দূরীকরণে করণীয়
মে দিবস শুধুমাত্র শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন নয়; এটি সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় ন্যায্যতা, সমতা ও মর্যাদার কথা। এই দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত, আমরা যেন শ্রমক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন দূর করতে কাজ করি। নিয়োগকর্তাদের উচিত নারী শ্রমিকদের সমান সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ প্রদান করা। একইসঙ্গে পুরুষ সহকর্মীদেরও নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রশাসনের উচিত নারী শ্রমিকদের জন্য কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।  নারী কর্মীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের পক্ষে কথা বলতে পারেন।

মে দিবসের মূল বার্তা হলো, শ্রমিকের অধিকার সকলের জন্য সমান। তাই লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করা ছাড়া মে দিবসের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

Link copied!