• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫

যেভাবে এলো হোলি বা দোল পূর্ণিমা


ঝুমকি বসু
প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৩, ০৩:১১ পিএম
যেভাবে এলো হোলি বা দোল পূর্ণিমা

দৈত্যরাজ হিরণ্যকিশপুর কাহিনি অনেকেরই জানা। ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিয়েও পরম ধার্মিক ছিলেন। তাঁকে যখন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও হত্যা করা যাচ্ছিল না, তখন হিরণ্যকিশপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ হোলিকা এই বর পেয়েছিল যে আগুনে তার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্ত অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় প্রহ্লাদকে নিয়ে হোলিকা আগুনে প্রবেশ করলে বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুণ্ড থেকেও অক্ষত থেকে যায় আর ক্ষমতার অপব্যবহারে হোলিকার বর নষ্ট হয়ে যায়। সেই সঙ্গে হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, এই থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি। অন্যদিক বসন্তের পূর্ণিমার এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। কোথাও কোথাও অরিষ্টাসুর নামক অসুর বধের কথাও আছে। অন্যায়কারী, অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর সকলে আনন্দ করে। এই অন্যায় শক্তিকে ধ্বংসের আনন্দ মহাআনন্দে পরিণত হয়।

অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সংপৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু উদযাপনের রীতি এক। বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’, আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’। রং উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে। শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সুউচ্চ একটা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয়। পরের দিন রং খেলা। বাংলাতেও দোলের আগের দিন এইরকম হয়। যদিও তার ব্যাপকতা কম। আমরা বলি ‘চাঁচর’। এই চাঁচরেরও অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে। দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব। পাতাঝরার সময়, বৈশাখের প্রতীক্ষা। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। পুরোনো জঞ্জাল, রুক্ষতা, শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহ্বান হচ্ছে এই হোলি। বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেক ধর্মীয় উৎসবেই আঞ্চলিক লোক-সংস্কৃতি ও রীতির প্রভাব দেখা যায়, হোলিও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্য পায়। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রংয়ের উৎসব করতেন। হোলি অপভ্রংশটি এসেছে হোরি (তৎসম) বা দোল থেকে। হোলি থেকে হোলক, হোলক মানে হোলিকা, যার অর্থ ডাইনি। এর সঙ্গে অশুভকে ধ্বংস ও নতুনকে স্বাগত জানানোর বিষয়টি জড়িত। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন : ভারতের উড়িষ্যায় দোলোৎসব, উত্তর ও মধ্যভারতে হোলি বা হোরি, গোয়া ও কঙ্কণ অঞ্চলে শিমাগা, দক্ষিণ ভারতে কামায়ন। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়। বলা হয়, মধ্যযুগের কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রভাবেই হোলি ও দোলযাত্রা একাত্ম হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গানে দোল ও রাধা-কৃষ্ণের দোল লীলার তাৎপর্যও এসেছে। তাঁর ‘সোনারতরী’র ঝুলন, ‘কথা ও কাহিনী’র হোলি খেলাসহ অনেক কবিতায় এ প্রসঙ্গ এসেছে। দোলযাত্রা উৎসব শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব নামে পরিচিত। কবির জীবদ্দশা থেকে এ উৎসব নানা আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে হোলি বারবার এসেছে। এ ছাড়া ‘হোলি’ শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অর্থে ব্যবহৃত হয়। হিন্দু ধর্ম অনুসারে চারটি যুগ : সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ এবং কলিযুগ। বর্তমানে চলছে কলিযুগ। এর আগের দ্বাপরযুগ থেকে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা বা দোল উৎসব চলে আসছে। বলা হয়, শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে ফাল্গুনি পূর্ণিমায়। আবার ১৪৮৬ সালের এই পূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে একে গৌর-পূর্ণিমা নামেও অভিহিত করেন বৈষ্ণব বিশ্বাসীরা। তবে এর মূল তাৎপর্য হলো রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের উপাখ্যানে। ফাল্গুনি পূর্ণিমা তিথির এ দিনে বৃন্দাবনের নন্দন কাননে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে তার সখী রাধা ও তেত্রিশ হাজার গোপীর সঙ্গে রং ছোড়াছুড়ির খেলায় মেতেছিলেন। এর স্মরণে এ দিন সকালে ভগবানকৃষ্ণ ও রাধার বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নান করিয়ে দোলায় চড়িয়ে কীর্তন গানসহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর কৃষ্ণভক্তরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। এসব দিক থেকে দোল উৎসবকে দুইভাবে দেখা যায়— হিন্দুধর্মের পৌরাণিক উপাখ্যান ও শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব। পৌরাণিক উপাখ্যানের দুটি দিক— স্কন্ধপুরাণের ‘হোলিকা’ এবং রাধা-কৃষ্ণের কাহিনি। প্রথমটিতে স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুন মাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান জড়িত।

রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে যে কাহিনি বেশি প্রচলিত, সেটা হলো— শ্রীকৃষ্ণ এক দিন বৃন্দাবনে রাধা এবং তার সখীদের সঙ্গে খেলা করছিলেন। সে সময় হঠাৎ রাধা এক বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয়ে লজ্জিত হন। শ্রীকৃষ্ণ রাধার লজ্জা ঢাকতে এবং বিষয়টি তার সখীদের কাছ থেকে গোপন রাখতে, রাধা তার সখীদের সঙ্গে আবির খেলা শুরু করেন। তাদের সবাইকে আবির দিয়ে রাঙিয়ে দেন। এ আবির খেলার স্মরণে হিন্দু সম্প্রদায় এই হোলি উৎসব পালন করে থাকে বলে প্রচলিত আছে। এ ছাড়া বলা হয়ে থাকে, কৃষ্ণ নিজের কৃষ্ণ রং ঢাকতে বিভিন্ন ধরনের রং মাখিয়ে রাধার সামনে হাজির হন। সেই থেকে এ উৎসবের শুরু। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে দোল উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন : কোথাও কোথাও ফাল্গুন শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে দোল উদযাপন উপলক্ষে ‘বুড়িরঘর’ বা ‘মেড়া পোড়ানো হয়। সাধারণত বিষ্ণু বা কৃষ্ণমন্দির কিংবা ধামে খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এ বিশেষ বহ্নি-উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবটি ছোটদের কাছে বেশি রঙিন। তবে সব বয়সের নারী-পুরুষই একে অপরকে আবিরের রঙে রাঙিয়ে দেয়। কম বয়সীরা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। মন্দিরে-মন্দিরে রাধা-গোবিন্দের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা অনুষ্ঠানের সময় উলুধ্বনি, কাঁসার ঘণ্টা ও পুরোহিতের ঘণ্টা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংশা’য় রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল বেরুণীর বিবরণে জানা যায়, মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন।

Link copied!