• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মা-বাবার হাত ধরে আমিও বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছি : মাহফুজ আনাম


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২, ০৮:১৩ পিএম
মা-বাবার হাত ধরে আমিও বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছি : মাহফুজ আনাম

ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর প্রকাশক ও সম্পাদক মাহফুজ আনাম। এর আগে তিনি দৈনিক ‘প্রথম আলো’র প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ছিলেন। একসময় তিনি ছিলেন বিনোদন পত্রিকা পাক্ষিক আনন্দধারা এবং সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার প্রকাশক। তাঁর বাবা স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ এবং সাহিত্যিক প্রয়াত আবুল মনসুর আহমেদ। মাহফুজ আনামের অগ্রজ মাহবুব আনাম ছিলেন দেশের একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক। বিশিষ্ট এই সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়েছেন সংবাদ প্রকাশ-এর প্রধান নির্বাহী বিধান রিবেরু। আলাপনে উঠে আসে মাহফুজ আনামের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে পেশাজীবনের অনেক অজানা কথা।


সংবাদ প্রকাশ : একসময় সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে সরে এলেন কেন?

মাহফুজ আনাম : আমি ছাত্ররাজনীতি করতাম, জাতীয় রাজনীতিতে হয়তো যেতাম এবং সেটার জন্য আমার আলাদা একটা পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা থাকত—এটাই ছিল আমার পরিকল্পনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যা আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং সে কারণে রাজনীতির প্রতি একটা অশ্রদ্ধা, অনীহা এবং বিরূপ মানসিকতার সৃষ্টি হয়।

সংবাদ প্রকাশ : তারপর?

মাহফুজ আনাম : জাতিসংঘে আমি চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে গেলাম। বিদেশে ছিলাম ১৪ বছর। কিন্তু ওই যে রাজনীতি করলাম না, বঙ্গবন্ধুর এ রকম নৃশংস হত্যা আমার মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল যে, এটা কেমন রাজনীতি, কেন এই লোকটাকে সপরিবার মারা হলো? আমি রাজনীতিতে তাঁর পাহাড়সমান অবদান ভুলেই গেলাম; কিন্তু তিনি তো একটা মানুষ, তাঁর তো একটা পরিবার আছে, তাঁর রাসেলের মতো একটা ছেলে আছে—এটা আমাকে খুব বেদনা দিয়েছে।

সংবাদ প্রকাশ : এ হত্যাকাণ্ডের পর আপনার বাবা আবুল মনসুর আহমেদের কী প্রতিক্রিয়া ছিল?

মাহফুজ আনাম : বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ওই সময় বাসায় বাবাকে দেখেছি কাঁদতে। একটা শোকের ছায়া বইত, আমরা অভয় দাস লেনের একটি বাসায় উঠলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। 

সংবাদ প্রকাশ :  বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার স্মৃতি শুনতে চাই।

মাহফুজ আনাম : ১৯৫৮ সালের অক্টোবরের দিকে আইয়ুব খানের মার্শাল ল হলো এবং প্রথম রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে বাবাকে গ্রেপ্তার করা হলো। মামলার তারিখ একই দিন পড়ত; বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো। বঙ্গবন্ধু বাবাকে ‘মনসুর ভাই’ বলে ডাকতেন এবং খুব বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতেন, ‘এই মনসুর ভাই, কেমন আছেন?’ মাকে বলতেন, ‘এই ভাবি, এত মজার খাবার খাওয়াইলেন, আমাদের একটু দেন।’ সেখানে ফজিলাতুন্ননেছা মুজিবও আসতেন, সবার সঙ্গে দেখা হতো। আমার মনে আছে, ধানমন্ডির বাসায় বঙ্গবন্ধু আসতেন এবং এসেই গেট থেকেই ‘মনসুর ভাই, মনসুর ভাই কোথাই আছেন, ভাবি কিছু খাইতে দেন—এসব বলতেন। তিনি খুব প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন এবং হেঁটে সোজা বেডরুম চলে যেতেন। বাবা অসুস্থ, বেডরুমেই কথা হতো। আমিও মা-বাবার হাত ধরে মাঝে মাঝে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছি। আমাদের বাসা ছিল তাঁর বাসার কাছাকাছি, এসব স্মৃতি খুব ভালো মনে আছে।

সংবাদ প্রকাশ : আপনার স্মৃতিতে বাবার জেলজীবনের বিষয়টি যদি একটু বিস্তারিত বলতেন…

মাহফুজ আনাম : বাবার সঙ্গে দেখা করতে জেলগেটে যেতাম, ওই স্মৃতিগুলো খুব মনে আছে। এখন তো কোর্টে অনেকগুলো অট্টালিকায় ভরে গেছে। তখন মূল কোর্টের পাশেই বেশ খোলা ছিল, ঠিক বলতে পারছি না ওখানে বিল্ডিং হয়ে গেছে ওই জায়গাটা। ওখানে পুলিশের থাকার ব্যারাকের মতো ছিল, তো বাবার যখন কেসের তারিখ হতো, তাঁরা আসতেন। সারা দিন লেগে যেত। পুলিশরা রাজনৈতিক নেতাদের অনেক সম্মান করত। পুলিশদের ওই বড় একটা হলের কোনায় তারা পরিষ্কার করে দিত; ওখানে খাটিয়ায় বাবা বসতেন। আমরা সারা দিন ওখানেই থাকতাম। ঠিক কী হচ্ছে বুঝতাম না। কিন্তু আমার কাছে দিনটি ছিল ভিন্ন ধরনের। মা খুব মজার মজার খাবার তৈরি করে বাবার জন্য নিয়ে যেতেন, সেই সুবাদে আমিও মজার মজার খাবার খেতাম। খুব মনে পড়ে যে বাবা কবে আবার কোর্টে আসবেন, সেদিন মা গিয়ে মজার মজার খাবার খাওয়াবেন, সেটা আকর্ষণীয় দিক ছিল। সেখানে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও আসতেন। সবার সঙ্গে দেখা হতো। এ তো ছিল প্রথমবার গ্রেপ্তার ৫৮ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত। এই কেস থেকে বাবা মুক্তি পেলেন ১৯৬০ সালে। সেটা আবার আমাদের আনন্দের ব্যাপার, পরিবারের সবাই আবার একসঙ্গে হলাম। ৬১ সালে বাবাকে আবার গ্রেপ্তার করা হলো। তখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হচ্ছে। সেবার হঠাৎ বাবার শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেল, জেলে থাকতে থাকতে উনি অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে পড়ে গেলেন এবং এক বছর বা দেড় বছরের মাথায় সরকার বাবাকে ছেড়ে দিল ভয়ে যে, উনি যদি জেলে মারা যান, তাহলে এ তো একটা বিরাট রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে। তারপর উনি বাসাতেই থাকতেন। আর ওকালতি করতে পারেননি। কর্মজীবন এবং রাজনীতিতে আর প্রবেশ করলেন না, তবে তিনি পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। আমাদের বাসায় সারাক্ষণ রাজনীতিবিদরা আসতেন এবং বাবার কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন।

সংবাদ প্রকাশ : আপনার বাবার জেলে থাকার সময় আপনার পরিবার কীভাবে চলতো?

মাহফুজ আনাম : আমরা অভয় দাস লেনের একটা বাসায় উঠলাম ১৯৫৮ সালের অক্টোবরের দিকে। আইয়ুব খানের মার্শাল ল হলো। পাকিস্তানে মার্শাল ল আগে হয়নি; মার্শাল ল নিয়ে তো কারও কোনো ধারণ নেই। এই যে একটা বিরাট পরিবর্তন হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ, সমস্ত মতপ্রকাশ, সমস্ত কিছু একটি মিলিটারি রিজিম। আমার বাবা জেলে, আমাদের যত রকম অ্যাকাউন্ট ছিল সবকিছু ফ্রিজ করে দিল এবং আমি হঠাৎ করেই দেখলাম যে, কেউ আর আমাদের বাসায় আসে না। আমরা পাঁচ ভাই জীবিত ছিলাম, আমার যে সবচেয়ে বড় ভাই উনি ময়মনসিংহে ছিলেন, মেজ ও সেজ ভাই মাহবুবা এবং মতলুবা। মাহবুবা ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন গেছেন। আর মতলুবা ডেন্টিস্টি পড়তে জাপানে গিয়েছিলেন। এ সময় মেজ ভাই আমাদের পরিবারের হালটা ধরেন। উনি লন্ডন থেকে চলে আসেন এবং আমাদের গোটা পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতা ও বলিষ্ঠতায় আমাদের আঁকড়ে রেখেছেন। আমি মনে করি আমাদের পরিবারের একটা অসাধারণ অবদান তার, সেটা হলো একে তো আমাদের ধরে রাখা, আরেকটা হলো বাবার বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা মামলা হলো, তাকে যে জেলে রাখল, এটার জন্য যে আদালতে যাওয়া এবং বাবার উকিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব আদালতে লড়াই করলেন, উনাকে সহযোগিতা করা। উকিল হিসেবে আতাউর রাহমান সাহেবও ছিলেন। উনি খুব দক্ষ এবং গুড অর্গানাইজার ছিলেন।

সংবাদ প্রকাশ : পরিবারে আপনার মায়ের অবদান অনেক। সেটা শুনতে চাই।

মাহফুজ আনাম : শেরেবাংলার বাড়ি অভয় দাস লেনের পাশেই ছিল কে এম দাস লেন। কে এম দাস লেনে কিন্তু শেরেবাংলার একটা বাসা ছিল। সেখানে আমি বাবার সঙ্গে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি। উনি যে বিশাল ব্যক্তিত্ব, অত বুঝিনি। কিন্তু বাবার সঙ্গে কথা হতো; আমি গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এবং আমার অনেক স্মৃতি আছে ওখানে শেরেবাংলার বাসাতে। বাবার  রাজনীতিতে যেটা শেষ, সেটা আমার মনে পড়ে আইয়ুববিরোধী ফাতেমা জিন্নাহ ইলেকশনে একজন বিপরীতপন্থী হিসেবে। পাকিস্তানের সব দল কম্বাইন্ড অপজিশন নাম করে ফাতেমা জিন্নাহ প্রতি সমর্থন দিলেন, ওটাই বাবার ছিল শেষ। আমার জীবনে তাঁর প্রভাব বিসৃত সর্বোপরি, মায়ের প্রভাবও ছিল, মা কীভাবে যে পরিবারটা ধরে রাখতেন। বাবা তাঁর দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর’ ও ‘আত্মকথা’তে উনি আমার মায়ের সম্পর্কে লিখেছেন যে, তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কটি সিদ্ধান্ত আমার মায়ের দ্বারা প্রভাবিত এবং মায়ের কথাতেই উনি চলতেন। মজার বিষয়, আমার বাবা-মায়ের বয়সের ব্যবধান ছিল ১৮ বছর। আমরা নিজেরাও জানতাম মায়ের সঙ্গে একটা জায়গা অতিক্রম করা অসম্ভব। আর একটা বিষয় হলো, মা যদি কখনো কিছু পছন্দ না করতেন, একদম চুপ হয়ে যেতেন। উনি কথা বলতেন না, ধমক দিতেন না এবং ওই চুপ হয়ে যাওয়াটা এত কঠিন একটা শাসনের মতো আমাদের জীবনে এলো, মা চুপ হয়ে গেছেন মানেই আর আমরা ওদিক যেতে পারতাম না। আরেকটা বিষয় ছিল যে, স্ত্রীর প্রতি সম্মানের একটা দৃষ্টান্ত, যেটা চেষ্টা করেছি নিজের জীবনে আনতে।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!