• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

একটামাত্র বন্দুক দিয়ে লেফট-রাইট করতাম : দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২২, ০৩:২৫ পিএম
একটামাত্র বন্দুক দিয়ে লেফট-রাইট করতাম : দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ও প্রথম নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং জাতিসংঘ কার্যালয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। যোগদানের এক বছর পর ‘নৈতিক ও নৈতিক ভিত্তি’ উল্লেখ করে পদত্যাগ করেন। তিনি দক্ষিণি ভয়েসের (থিঙ্কট্যাংক নেটওয়ার্ক) চেয়ারম্যান।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বাবা দেবেশ ভট্টাচার্য ছিলেন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও বিচারপতি। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মা চিত্রা ভট্টাচার্য ছিলেন ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। এ সময় তিনি সংসদের অর্থবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি প্রগতিশীল নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলনসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্মৃতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ-এর সঙ্গে একান্ত আলাপনে এই অর্থনীতিবিদ বলেন তাঁর সেই সব না-বলা কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা শম্পা

 

সংবাদ প্রকাশ : আপনার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা শুনতে চাই।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : ১৯৭১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো আমি উদ্বাস্তু হয়েছিলাম। এখন চারপাশে রোহিঙ্গাদের দেখে মনে হয় ওদের যে কষ্ট, অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ এবং বেড়ে ওঠার যে প্রতিবন্ধকতা, সেটা আমি আমার জীবনে দুইবার উদ্বাস্তু হয়ে দেখেছি।
১৯৬৪ সাল থেকে ৩ বছর আমি কলকাতায় পড়েছি। পরে বাবা-মা ফেরত নিয়ে আসেন। কিন্তু আমার বোনকে আনার সাহস পাননি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। সেই আমলে এটাও একটা বাস্তবতা। তখন কন্যাশিশুদের পাকিস্তানে রাখার ব্যাপারে নিরাপদ বোধ করেননি অনেকে।

সংবাদ প্রকাশ : সে সময় আপনার পরিবারের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলুন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : স্বাধীনতাসংগ্রামের মার্চ মাস থেকেই টাঙ্গাইলের এলেঙ্গাতে ছিলাম আমরা। তখন বাবা-মা আমাদের রেখে ঢাকায় এসেছিলেন। কারণ, তখন তারা ভেবেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটা আলোচনা শুরু হবে, মিলমিশ হবে। স্বাধীনতা আসবে। সেই কারণে বাবা তখন ঢাকায় থাকার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। বাবা যেদিন ঢাকায় চলে এসেছিলেন, সেদিনই জয়দেবপুর অস্ত্রাগারে বিদ্রোহ হয়েছিল। সে সময়ই বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তারপর তো তারা ঢাকায় ছিলেন। ২৬ মার্চে ওনারা শুধু গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ি নিয়ে গেলেও সবকিছু রয়ে গিয়েছিল। তখনই বাড়িতে লুট হয়েছিল। জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিল। আলমারি ভেঙে সোনাদানা নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের নিজেদের লাইব্রেরির বইগুলো লুট করে ওজন ধরে বিক্রি করেছিল। তখন প্রতিবেশীরাও কিছু বই নিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরে তারা বইগুলো ফেরত দেন। বাবার ওকালতির চেম্বার থেকে ফাইলগুলো নিয়েছিলেন অন্য উকিলেরা।

সংবাদ প্রকাশ : আপনি নিজে কীভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : এ সময় কলকাতায় ছিলাম, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর মাসে। মার্চ থেকে আগস্ট প্রায় ৬ মাস পর্যন্ত আমরা কিন্তু একরকম স্বাধীন বাংলাতেই ছিলাম। সে সময় টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকী এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ ব্যূহ করেন, যাতে ওই এলাকাটা নিরাপদ থাকে। আমরা ওখানেই থাকতাম। আমার তখন অনেক বন্ধু ছিল। তখন একটামাত্র বন্দুক ছিল, সেটা দিয়ে লেফট-রাইট করতাম মার্চের শেষ বা এপ্রিল মাসে। আমার মনে আছে, মিছিল নিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রোডে এসেছি বেশ কয়েকজন।

সংবাদ প্রকাশ : নিজে থেকে উদ্বুদ্ধ হলেন নাকি পারিবারিক উৎসাহ?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : না, সামগ্রিকভাবে পরিবেশ তখন এটার মধ্যে ছিল। যেহেতু ঢাকায় থেকেছি, বড় হয়েছি, একটা পারিবারিক পরিচয় আছে আমার। স্বভাবত সে কারণে আমার হাতে নেতৃত্ব চলে আসে। আবার অন্য অনেকের থেকে দুঃসাহস হয়তো বেশি ছিল। আমার মনে আছে, আমরা যখন বড় একটা মিছিল নিয়ে এসেছি, তখন ব্রিজগুলো উড়িয়ে দেবো নাকি দেবো না, সেটা নিয়ে একরকম কথা হচ্ছিল। তখন একদল বলছে, দেশ তো স্বাধীন হয়ে যাবে। আমাদের নিজেদের সম্পদ কেন নষ্ট করব? আরেক দল বলছে, দেশ বাঁচলে তো সম্পদ। এখন তো পাকিস্তানি বাহিনী এটা দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করবে। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছি অপর দিকে নিজেদের সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে হবে—এই দুটো ভারসাম্য রক্ষা করা বেশ কঠিন। সেদিনই আমাদের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর দেখা হয়। তো সারা রাত ধরে পাহারা দিতাম। কারণ তখন ডাকাত আসে কি না?

সংবাদ প্রকাশ : ডাকাত? সেটা কেমন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : পাকিস্তানি বাহিনীর সম্পর্কিত ডাকাত দল ছিল টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গাতে। ভোরবেলা তারা আক্রমণ করত। সারা রাত পাহারা দিতাম এলাকার ছেলেমেয়েরা মিলে, শুরু হতো সন্ধ্যার সময়। স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার জন্য চারপাশে সবাই মিলে বসত। একটাই ট্রানজিস্টর ছিল। তারপর সারা রাত পাহারা দিতাম। ভোরে ঘুমাতে গিয়ে দুপুরে উঠতাম। সেবার লিচু-আম বেশি হয়েছিল। আম-লিচু খেয়ে ঘুম হয়, নয়তো খেলাধুলা।

সংবাদ প্রকাশ : যুদ্ধের সময় আপনার পরিবার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন। সেই অভিজ্ঞতাটুকু শুনতে চাই।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : আমার বাবা-মা দীর্ঘ চার মাস কেমন আছে, কীভাবে আছে, সেটা আমরা জানতাম না। তবে তখন যাদের কাছে ছিলেন, তাদের নাম না নিলেই নয়। তারা তখন থাকতেন ড. আলীম-আল- রাজীর বাসায়। তিনি ছিলেন ঢাকা বারের আইনজীবী। অত্যন্ত প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। উনিই ৬৪ সালে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং ৭১-এ উনিই বাবা-মাকে আশ্রয় দেন। সেই সময় তো বাবা-মাকে উদ্ধার করাই বড় ব্যাপার ছিল। সে সময় বাবার এক জুনিয়র কলিগ কীভাবে আমাদের গাড়িতে অন্য লোক বসিয়ে টাঙ্গাইলের সীমানা পার করেছেন, সেটা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তারপর আমরা গ্রামের চরের মধ্যে থাকতাম। কারণ, আমাদের বাড়ি তো পুড়িয়ে দিয়েছিল, শান্তি বাহিনী সেখানে অফিস করেছিল। 
এ সময়ে একটা বড় কাজ ছিল আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া। আমাদের এলাকা থেকে তরুণ ও যুবকদের যারা আগ্রহী, তাদের উৎসাহ দিয়ে মধুপুর জঙ্গলে কাদের সিদ্দিকীর দলে পাঠানো অনেকটা বড় কাজ ছিল। এদের অনেকের ভেতরে একধরনের প্রত্যাশা এবং হতাশার দোলাচল ছিল।

সংবাদ প্রকাশ : যে কারণে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই প্রাপ্তির জায়গাটা এখন এ সময়ে এসে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : প্রত্যাশাটা অনেক উঁচুতে ছিল। তখন ছোটখাটো বিচ্যুতি বড়ভাবে আঘাত দিত। কারণ, আমাদের এমন একটা আদর্শ চিন্তা ছিল, এমন একটা বাংলাদেশ হবে, যেখানে সাম্য থাকবে, বঞ্চনা থাকবে না। অনেক ভাবাবেগের ব্যাপার ছিল। পেছন ফিরে দেখলে মনে হয়, কীভাবে আমরা কেমন করে এত আবেগপূর্ণভাবে আদর্শবাদী ছিলাম। সেই স্বপ্ন আর কতখানিই-বা পূরণ হলো?

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!