• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাধীনতা দিবসে নজরুল ইসলাম বাবু


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৩, ১০:৫১ এএম
স্বাধীনতা দিবসে নজরুল ইসলাম বাবু

বত্রিশ বছর আগে চলে যাওয়া একটা লোককে নিয়ে লিখতে ভালো লাগছে। যখন সমাজের সব জায়গা থেকেই দাবি উঠছে গানে গীতিকার ও সুরকার সবাইকে প্রাপ্য মর্যাদা ও রয়্যালটি দিতে হবে, তখন আমার সবাইকে জানাতে হচ্ছে নজরুল ইসলাম বাবুকে নিয়ে। সবাই বলে কালোত্তীর্ণ হলেই সেই শিল্প সার্থক। মণীন্দ্র গুপ্ত তার প্রবন্ধে বলছিলেন, যার সারমর্ম হলো এই, যে কবিতা এখনো পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পাঠকদের কাছে সমান আবেদন রাখে, তাই সফল কবিতা। সফল গানের ব্যাপারও তাই। যে গান একটা সময় পার করেও সবাইকে বারবার সেই গানের কাছে আসতেই হয়, তাই তো সার্থক গান।

নজরুল ইসলাম বাবুর বাড়ি জামালপুর, মাদারগঞ্জ উপজেলায়। যারা জামালপুর নিয়ে জানেন, তারা জানবেন জামালপুরের এক প্রত্যন্ত চরাঞ্চল হলো এই উপজেলা। নদীভাঙন ও বসতি পরিবর্তন যাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তারা খুব মাইগ্রেশনে থাকে, যেমন রংপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, বগুড়া সব দিকেই আপনি টুকটাক পাবেন মাদারগঞ্জের লোক। সেখানে মধ্যম শ্রেণি এক পরিবারে জন্ম নিয়ে নজরুল ইসলাম বাবু পড়াশোনা করেছেন, ডানপিটে এক শৈশব কাটিয়েছেন। কিছুদিন বরিশালেও ছিলেন বাবার চাকরির কারণে। কলেজে ভর্তি হয়ে রাজনীতি ও লেখালেখি একসঙ্গেই করতেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তার নামে পুলিশ ওয়ারেন্ট হয়। তারপর তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ট্রেনিং শেষে ১১ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন, খুবই দক্ষ ছিলেন মেশিনগান চালানোয়। এসব বীরত্বই তাকে মনে রাখার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু তিনি তো আর আর দশটা মানুষের মতো নন। যুদ্ধ শেষে জামালপুর ফিরেছেন। আশেক মাহমুদ কলেজে বিএসসি ডিগ্রি শেষ করেছেন। তারপর কবি হওয়ার নেশায় চলে যান ঢাকায়।

ঢাকায় গিয়ে তিনি কাউকেই চিনতেন না। বিটিভি আর রেডিওর আশপাশে ঘুরতেন। এভাবেই আবুল মিয়ার ক্যান্টিনে তার সঙ্গে পরিচয় হয় শেখ সাদী খানের। শেখ সাদী খান তাকে জানান তিনি গান লিখতে পারবে কি না। মুহূর্তেই লিখে দেখান। শেখ সাদী খান আরেক রোববার আসতে বলেন। কাজ শুরু হয়ে যায় তার। বিটিভি ও বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হন। গানবাজনা সম্পর্কিত একটা সংগঠনেরও নেতৃত্ব দেন পরে। অদ্ভুত এক প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন। আড্ডায়, চা খেতে খেতে, রিকশায়—সব ভাবে গান লিখতে পারতেন। যেমন ধরুন দুই ভুবনে দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল/ রেললাইন বহে সমান্তরাল। এই গান তিনি লিখেছেন মালিবাগ ক্রসিংয়ে জ্যামে আটকে থেকে। বন্ধু শাহনেওয়াজ ছিল সুরকার। পাশে বসেই হয়ে যায় সুর। তখন কাজ হতো এভাবেই। সিনেমায় গান লিখে তিনি কিছু টাকার মুখ দেখে মালিকানায় একটা প্রেস ছিল তার। সেটাও লাটে ওঠে, কারণ তিনি শিল্পী সুরকার গানবাজনা এসব নিয়েই থাকতেন। শেখ সাদী খানের সঙ্গেই ছিল তার জুটি। তবু গান লিখে দিতে কারও জন্য কার্পণ্য করতেন না। এক হাতে তিনি লিখেছেন ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল’, ‘কথা বলব না বলেছি, শুনব না শুনেছি’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয় আর কয়লা পুড়লে ছাই’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে’, ‘আমার মন কান্দে ও আমার প্রাণ কান্দে’সহ অনেক গান। তার গান গেয়েছেন বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আশা ভোসলে, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, শাম্মী আখতার, দিলরুবা খান, বেবী নাজনীন, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অ্যান্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, শুভ্র দেব, কুমার শানুসহ অনেকেই।

তবু তিনি নজরুল ইসলাম বাবু হতেন না যদি না তিনি দেশের গান না লিখতেন। সব কটা জানালা খুলে দাও না, আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার। এত আকুল করা সব দেশের গান তার লেখা। তিনি ছিলেন জাত কবি এবং নিজের সৃষ্টির ব্যাপারে শতভাগ কনফিডেন্ট। তিনি কখনোই সুরকারদের বা প্রযোজকদের কথায় নিজের লেখা গানের কথা পাল্টাতেন না। অকালে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ওপর বিরক্ত ছিলেন, কেন তিনি দরজার জায়গায় সব কটা জানালা বসিয়েছে। যদিও বুলবুলের যুক্তি ছিল এখানে জানালাটাই যথার্থ, তাই জানালাই গাইয়েছেন। বাবু ছাড়া বাংলাদেশের আর কেউ লিখেননি, ‘মায়ের মাথার সিঁথির মতো লম্বা সাদা পথ’, ‘হৃদয়ের চেয়ে ভালো কোনো ফুলদানি নেই’; লিখেছিলেন ‘ওই কালো কেশ তুমি ছড়ালে যখন মেঘেরা পেল যেন লজ্জা’, এমন সুন্দর সব শব্দ নিয়ে বাক্যগঠন।

এ রকম একজন সেলিব্রেটেড গীতিকার অকালে চলে যাওয়ার পরে কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ২০২২ সালের আগে। আমাদের ক্রমাগত লেখালেখির কারণে গত বছর পেয়েছেন একুশে পদক। বেঁচে থাকতে একটা মাত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। যদি মোটামুটি আরও দশ বছরও বাঁচতেন তাহলেও পুরস্কার হয়তো পেতেন আরও। কিন্তু একচল্লিশ বছরের জীবন শেষে গত ত্রিশ বছরে তার কথা কেউ মনে রাখেনি। তার স্মৃতি রক্ষায় জামালপুরে খোলা স্কুল এমপিওভুক্ত হয় না, দরজা-জানালা ঠিক করেন তার স্ত্রী, বাবুর মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণের পাওয়া মাসিক ভাতা দিয়ে। দিবসকেন্দ্রিক উপলক্ষে তার গান গাওয়া হয়, রাস্তায় বাজানো হয়, কিন্তু তাকে কেউ মনে রাখে না। নজরুল ইসলাম বাবু নিয়ে সার্চ দিলে গুগলে আসে একজন সাবেক সংসদ সদস্যর নাম। কী লজ্জা! এমন না যে নজরুল ইসলাম বাবুর পরিবারের খুব স্বীকৃতি দরকার, মানুষটাই তো নাই। কিন্তু তার স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে বানানো স্কুল ঠিকমতো চালানো, তার লেখা শ খানেকের ওপর গান ও স্মৃতি সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব। আজ তার মৃত্যু বা জন্মদিন না। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস তাই বীর মুক্তিযোদ্ধা এই গীতিকবিকে স্মরণ করলাম। যিনি দেশকে নিয়ে লিখেছেন, ‘জেনেছি তুমি জীবন মরণে বিমুগ্ধ চেতনার।’

Link copied!