• ঢাকা
  • বুধবার, ০১ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’


তপন বকসি
প্রকাশিত: মে ১, ২০২৩, ০৫:০৩ পিএম
‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’

গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে যেদিন আত্মহত্যা করলেন, সেদিনই আমি মান্না দেকে ফোনে ধরেছিলাম। পুলক বাবুর কথা উঠতেই “পুলক যে এমনটা কেন করল?” এ টুকু বলেই সেই যে কাঁদতে শুরু করলেন মান্নাদা, তারপর ফোন কানে আমি দশ মিনিট বসেছিলাম। সেই ১০ মিনিট তিনি একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারেননি কান্নার জোয়ারে। এরপর অপ্রস্তুত হয়ে ফোনটি কেটে দেন। এর দশ মিনিট পর খানিকটা ধাতস্থ হয়ে আবার ফোন করলেন আমাকে। তখনো কান্না পুরোপুরি তার গলা থেকে যায়নি। কান্না জড়ানো গলায়  বললেন, "পুলক যে এমনটা কেন করল, আমি সত্যিই তার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না। পুলকের লেখা কথা আর আমার সুর করা গানের যে পৃথিবীর জন্ম দিয়েছিলাম আমরা দুজনে, সেই পৃথিবীটা আজ ধ্বংস করে দিয়ে গেল পুলক।"

শিল্পী মাত্রই সংবেদনশীল হন। এ কথা আমরা লোকমুখে শুনেছি। কিংবা শিল্পীরা নরম মনের মানুষ হন। কিন্তু মান্না দের মতো বাঙালি মানসে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা শিল্পীর সঙ্গে মানুষ হিসেবে কথা বলতে গিয়ে প্রথমবার বুঝলাম তিনি কতটা সংবেদনশীল। কিছুক্ষণ থেমে মান্নাবাবু বললেন, "পুলক মুম্বাইয়ে আমার বাড়িতে যখন তখন চলে আসত কলকাতা থেকে ফ্লাইট ধরে। ও বাড়িতে এলেই আমার আনন্দের সীমা থাকত না। নিজেই কিচেনে গিয়ে শুরু করে দিতাম রান্না। একবার পুলক এলো। আমি ব্যস্ত হয়ে রান্না শুরু করেছি। সেই সময় ও রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে বলল, “মান্নাদা, আপনি যেভাবে রান্না করছেন মনে হচ্ছে আমরা দুজনে মিলে কোথাও পিকনিকে এসেছি। তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে বলল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান! মাথায় গান আসছে। আমার ড্রয়িংরুমে গিয়ে একটা সাদা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে সেখানেই লিখতে বসে গেল। তারপর রান্নাঘরে এসে আমাকে দু‍‍`চারটে লাইন শোনাল। ও লিখেছিল, "আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না...ইস্তাম্বুল গিয়ে... জাপান কাবুল গিয়ে... শিখেছি সহজ এই রান্না....আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না....।" পরে হলো কি জানেন? গানটা আমারই গলায় ‍‍`প্রথম কদম ফুল‍‍` ছবিতে সুধীন দাশগুপ্ত সুর দিয়ে লাগিয়ে দিলেন অভিনেতা শমিত ভঞ্জের লিপে।”

মান্না দে মানে একদিকে ইতিহাস সৃষ্টি করে চলা এক দরদী মনের বিশুদ্ধ রোমান্টিক গায়ক আর তার পাশাপাশি সেই গান এবং গায়কের জীবনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গল্প। পুলক বাবুর অসময়ের অকাল মৃত্যু নিয়ে মান্নাদা যখন আমাকে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, সেটি ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। নিজের আত্মজীবনী ‍‍`জীবনের জলসাঘরে‍‍` লেখার অন্তত ছয় বছর আগে। মুম্বাইয়ে আসার পর মান্নাদার সঙ্গে যখন নতুন করে আবার কথাবার্তা শুরু করলাম, তারও  বছর সাত-আটেক আগে কলকাতায় বাঙালির জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্রের অফিসে তরুণ সাংবাদিক হিসেবে প্রথম মুখোমুখি হয়েছিলাম মান্নাবাবুর। রাত তখন প্রায়  আটটা। ঘটনাচক্রে সেই মুহূর্তে দপ্তরের বাকি সবাই চলে গিয়েছিলেন। কেউ ছিলেন না। বসে ছিলাম শুধু আমি আর আমাদের দপ্তরের সবার প্রিয়, সবার দেখভাল করা কালিবাবু। আমাদের কাছে যিনি ‍‍`কালিদা‍‍`। মান্নাবাবুকে দেখলাম কালিদাকেও চেনেন। দপ্তরে কালিদাকে দেখেই বললেন, "কলকাতায় খুব ঠান্ডা। কালি, তুমি এক কাপ গরম চা নিয়ে এসো তো দেখি।" তখন ডিসেম্বর মাসের শেষাশেষি। কনকনে শীত তখন কলকাতায়। সে রকম সন্ধ্যায় মান্নাদা মুম্বাই থেকে উড়াল দিয়ে আসেন। পরের দিন কলকাতার রবীন্দ্রসদনে জলসায় অংশ নিতে। ফুলপ্যান্ট, ঘন মেরুন রঙের জহর কোট আর মাথায় সাদা পশমের টুপি। কথায় কথায় বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটান আমার মতো সম্পূর্ণ অচেনা, অখ্যাত এক তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে। 

Link copied!