• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

বলিউডে হোলি উৎসবের পরম্পরা


তপন বকসি
প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৩, ০২:৫৩ পিএম
বলিউডে হোলি উৎসবের পরম্পরা

চারের দশকের শেষ দিকে বলিউডে যে হোলি উৎসব শুরু হয়েছিল, রঙের সেই জৌলুশ ফিকে হয়েছে ধীরে ধীরে। রাজ কাপুর থেকে অমিতাভ বচ্চন হয়ে শাহরুখ, কখনো মাঝখানে সুভাষ ঘাই, শাবানা আজমি-জাভেদ আখতার জুটি। বলিউডের পরম্পরা ধরে সেই হোলি কোনো এক অজানা কারণে আজ ম্লান। তবু হোলি এখনো খেলা হয় বলিউডে। একতা কাপুর, সঞ্জয় গুপ্তারা নিজেদের মতো হোলি আয়োজন করেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, অমিতাভ বা শাহরুখের সেই ঐতিহ্যের ধারায় এখন আর নেই।  

কে স্টুডিওর হোলিতে রাজ কাপুর এবং তার বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে মাঝখানে নার্গিসকে দেখা যাচ্ছে

রাজ কাপুর-নার্গিস মোট ১৪টি ছবিতে জুটি হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে আড়াই হাজার টাকার নিজের প্রথম ছবি ‘আগ’-এ রাজ কাপুর সাইন করিয়েছিলেন নার্গিসকে। তার পরের বছরই ‘বরসাত’ ছবি থেকে দুজনের প্রেম শুরু হয়। আর কী সর্বনাশ, এই সময়েই রাজ কাপুর শুরু করেছিলেন চেম্বুরের আরকে স্টুডিওতে হোলি খেলা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ থেকে চার বছর আগে ২০১৯-এর মে মাসে সেই স্টুডিওটি বিক্রি হয়ে যায় গোদরেজ প্রপার্টিজ লিমিটেডের কাছে। চেম্বুরের এই আরকে স্টুডিওতে অনেকবার গিয়েছি। স্টুডিওর দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বাঁ দিকে ঢুকে গ্যারেজের পাশেই ছিল এক বিশাল আকারের চৌবাচ্চা। আসলে সেই চৌবাচ্চা তৈরি হয়েছিল স্টুডিওর বাগান এবং অন্য কাজে জল দেওয়ার জন্য। হোলির দিন সেই চৌবাচ্চাকেই রঙের চৌবাচ্চা করে তুলতেন রাজ কাপুর। এ কথা জানিয়েছিলেন রাজ কাপুরের দীর্ঘদিনের সহযোগী বিশ্ব মেহরা বা মামাজি।

আর কে স্টুডিও হোলিতে বাঁ দিক থেকে প্রেম চোপড়া, রাজ কাপুর, প্রেমনাথ ও প্রেম কিষেন

তিন ফুট উঁচু ওই জলে রাজ ঢেলে দিতেন দামি ও সুগন্ধি রং। লাল গোলাপের পাপড়ি। আলাদা করে মেশানো হতো আরও সুগন্ধি। রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠত সেই জলাধার। বসন্তের মাঝ দুপুরের রোদের সেই ছটা এসে লাগত সবার চোখে-মুখে। আবিরের রঙের সঙ্গে চকমকি চুমকিতে গালের একপাশে ফাগুন খেলত নার্গিসের। নেচে  উঠতেন সিতারা দেবী, রাজ কাপুরের প্রথম ছবির পরিচালক কেদার শর্মারা। তাদের সঙ্গেই একে একে মাততেন কে আসিফ, দক্ষিণের পদ্মিনী, নলিনী জয়ওয়ন্ত, গীতা বালি, নিম্মি, প্রেমনাথ, প্রেম চোপড়ারা। চেম্বুরের ওই আরকে স্টুডিওতেই পরের দিকে অমিতাভ এসেছেন। রেখা তো আসতেনই।

জুহুতে অভিতাভর প্রতীক্ষা বাংলোয় হোলির দিন বাঁ দিক থেকে নিখিল নন্দা (জামাই), ফ্যাশন ডিজাইনার নন্দিতা মাহতানি, অভিতাভ বচ্চন ও একেবারে ডানে শ্বেতা বচ্চন

‘মাহনীয় ক্যাটারারার’ কাছ থেকে আসত শিঙাড়া ও জিলিপি। চলত কয়েক ঘণ্টা রং খেলা আর হুল্লোড়। একবার দেবেন বর্মাকে চৌবাচ্চায় ডুবিয়ে দিয়েছিলেন রাজেশ খান্না। অনেক নায়িকাকে শাম্মী কাপুর পাঁজাকোলা করে চৌবাচ্চায় ডুবিয়েছেন। ১৯৫৫-৫৬ সালে অভিনেতা প্রাণের অনুরোধে আরকের হোলি পার্টি হয়েছিল প্রাণের পশ্চিম খার রোডের অ্যাপার্টমেন্টের টেরেসে। আসলে সে দিনের হোলি শুরু হয়েছিল আরকে স্টুডিওতেই। সেখান থেকে ঢোল, সানাই বাজাতে বাজাতে অভিনেতা প্রাণের পশ্চিম খার রোডের ছাদে গিয়ে শেষ হয়েছিল উৎসব। এসবই রাজ কাপুরের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধু মামাজি গল্পের মতো বলে গিয়েছিলেন।

জহুর জানকি কুটিরে হোলির দিন শাবানা ও জাভেদ

১৯৪৯-৫০ সাল থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত আরকে স্টুডিওর এই হোলি চলেছিল। তারপর আরকে স্টুডিওতে হোলি খেলা আর হয়নি। কেন বন্ধ হল? রণবীর কাপুর বলেছিলেন, “কেন আবার? কেউ খেলতে আগ্রহী নয়। আমার মেয়েরা, আমার ভাইয়েরা, তাদের বউ ছেলেমেয়েরা, কাউকেই উৎসাহী দেখলাম না। ওদের ধারণা, এতে যদি ওদের নেলপলিশ খারাপ হয়ে যায়, যদি চুলে, ত্বকে কোনো ইনফেকশন হয়। এসব আরকি।”

জহুর জানকি কুটিরে হোলির দিন শাবানা ও জাভেদ

রণবীরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এত দিনের এই হোলি খেলা বন্ধ করে দেওয়ায় আফসোস হয় না?” ডাব্বুর উত্তর ছিল, “আফসোস করে কী হবে? তব পাপা জিন্দা থা না? সেই ভয়ে সবাইকে অংশ নিতে হতো। এখন কে কাকে চাপাচাপি করবে?”

১৯৮৮ সালের ২ জুন রাজ কাপুর মারা যান। সেই বছরের মার্চ মাসের হোলিই ছিল রাজ কাপুরের আরকে স্টুডিওর শেষ হোলি।

জহুর জানকি কুটিরে হোলির দিন শাবানা ও জাভেদ

১৯৭০-এর সময় থেকেই জুহুতে অমিতাভ বচ্চনের ‘প্রতীক্ষা’ বাংলাতে ছোট আকারের হোলি শুরু হয়েছিল। এরপর ১৯৭৩ সালের মে মাসে ‘জঞ্জির’ হিট হওয়ার পর বলিউডে জন্ম নিলেন আর এক সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন। বিবাহিত রাজ কাপুর যেমন মেতেছিলেন নার্গিসে, তেমনই অমিতাভের বিয়ের পরও তার জীবনে প্রণয়িনী হয়ে এসেছিলেন রেখা। রাজ-নার্গিসের পর অমিতাভ-রেখার রোমান্টিসিজম কম আলোচনার বিষয় ছিল না। যা এখনও আছে ধিকি ধিকি। বাবা হরিবনশ রাইয়ের লেখা গীতিকবিতায় সিদ্ধি মেশানো তরলে, লাড্ডু, মন্ডামিঠাই খেয়ে অমিতাভের জুহুর বাংলো ‘প্রতীক্ষা’য় নেশায় আচ্ছন্ন হয়েছেন মেহমুদের ভাই আনোয়ার আলী, মেহমুদের বোন মিনু মুমতাজ, প্রকাশ মেহরা, মনমোহন দেশাইরা। পরের দিকে ‘প্রতীক্ষা’র এই হোলিতে যোগ দিয়েছেন করিশমা কাপুর, প্রীতি জিনতা, রানি মুখোপাধ্যায়, শাহরুখ খান, গৌরি খান, সমাজবাদী পার্টির অমর সিংহ, সঞ্জয় খান, হৃত্বিক রোশন, সঞ্জয় লীলা বনশালি, করণ জোহরের মত অনেকেই।

সুভাষ ঘাইয়ের হোলি পার্টিতে শাহরুখ-গৌরী 

১৯৮৮ সালে মার্চ মাসের পর থেকে আরকে স্টুডিওর হোলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হোলির ফোকাস সরে এসেছিল ‘বচ্চন বাংলো’য়। ২০০৩ সালে হরিবংশ রাই বচ্চন মারা যাওয়ায় সেই বছর ‘প্রতীক্ষা’ হোলি হয়নি। অমিতাভ কোনো কাজে দেশের বাইরে থাকলে, কোনো বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি ঘটলে সেই বছরগুলোয় ফাঁকা চলে গিয়েছে বচ্চন বাংলোর হোলি। অথচ টানা ৩৮ বছরে আরকে স্টুডিওর হোলিতে কখনও ছেদ পড়েনি। এমনকি ৭২ সালেও পৃথ্বিরাজ কাপুর মারা গিয়েছিলেন হোলি খেলেই। তিনি ১৯৭২ সালেল ২৯ মে মারা যান।

সুভাষ ঘাইয়ের হোলি পার্টিতে শাহরুখ-গৌরী 

শাহরুখ খান বান্দ্রার ব্যান্ডস্ট্যান্ডে তার বাংলো ‘মান্নাত’-এ হোলি শুরু করেন ২০১১ সালে। হোস্ট হিসেবে আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন শাহরুখ-গৌরি। অন্যদের মিশিয়ে দেওয়া ভাং খেয়ে উদ্বেল হয়েছেন। মগরার মালা পড়েছেন গলায়। কিন্তু খুব বেশি দিন এই হোলি খেলাকে নিয়ম মেনে টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৯৫ সালে সুভাষ ঘাইয়ের দেওয়া হোলি পার্টিতে গৌরিকে রংয়ের চৌবাচ্চায় ফেলে দিয়েছিলেন শাহরুখ। সেই স্মৃতি এখনও চোখের সামনে ভাসে অনেকের।

একতা কাপুরের হোলি পার্টিতে একতা কাপুর ও গুলশান গ্রোভার

বিখ্যাত উর্দু কবি, চিত্রনাট্যকার, লেখক কায়েফি আজমি বেঁচে থাকতেই শাবানা আর জাভেদ আখতার জুহুতে জানকি কুটিরের প্রাঙ্গণে নিজেদের কটেজের বাগানে হোলি খেলা শুরু করেছিলেন। এখনও শাবানা আর জাভেদ হোলির আয়োজন করেন। কিন্তু অতিথিদের সেই তালিকা যেন ক্রমশই ওজন হারিয়ে ফেলছে।

এখন হোলির আয়োজন করেন জিতেন্দ্রর মেয়ে একতা কাপুরও। মূলত তার টেলিভিশন সিরিয়ালের লোকজন এতে অংশ নেন। তার মধ্যে স্বয়ং জিতেন্দ্র থাকেন। এক দুজন বড় পর্দার তারকা তাতে আসেন।

একতা কাপুরের হোলি পার্টিতে প্রযোজক-পরিচালক সঞ্জয় গুপ্তা ও তার স্ত্রীর সঙ্গে একতা কাপুর 

কিন্তু আজকেও হোলি এলে রাজ-নার্গিস আর চেম্বুরের আরকে স্টুডিওর কথাই মনে পড়ে বেশি করে। অত দিন আগে এক জীবনরসিক মানুষ জীবনকে মৃত্যুহীন করে যাওয়ার পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। তাই জীবনের এরকম বর্ণময় উৎসবে তার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো বার বার মনে পড়ে। যিনি জীবনকে আঁকড়ে রাখার মন্ত্র শেখাতে পারেন, তার কি কখনো মৃত্যু হতে পারে?
 

Link copied!