সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন স্কিম এনেছে সরকার। ‘প্রত্যয়’ নামেই এই স্কিমের আওতায় বাধ্যতামূলকভাবে আসতে হবে দেশের চার শতাধিক স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের। তবে নতুন এই স্কিমের বিরোধিতা করে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
নতুন স্কিম নিয়ে কেন বিরোধিতা, আগের স্কিমের সঙ্গে কোথায় গরমিল তা নিয়ে নানা বক্তব্য তুলে ধরছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, আগের পেনশন স্কিমের চেয়ে নতুন স্কিমে সুযোগ, সুবিধা ও অর্থের পরিমাণ কমানো হয়েছে। এতে বঞ্চিত হবেন শিক্ষকরা। যে কারণে প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডের বাস্তবায়ন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে তারা আন্দোলনে নেমেছেন।
মূলত, আগের পেনশন স্কিমের সঙ্গে বর্তমান প্রত্যয় স্কিমের যে পার্থক্য তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখেন। যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন সিপিএফে। পেনশনে যাওয়ার পর তারা এই টাকা পেয়ে থাকেন।
অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। প্রত্যয় কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ১০ শতাংশ। বিদ্যমান সিপিএফ–ব্যবস্থা থেকে তা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। প্রত্যয় কর্মসূচিতে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে ওই কর্মচারী মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।
প্রত্যয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা—এ দুয়ের মধ্যে যেটা কম তা তাদের বেতন থেকে কাটা হবে। একইসঙ্গে সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ জমা হবে পেনশন কর্তৃপক্ষের তহবিলে। এভাবে ৩০ বছর ধরে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে চাঁদা জমা হবে ৯ লাখ টাকা। আর সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা।
অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর মোট চাঁদা হবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।
অর্থ বিভাগ বলছে, পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এ অংক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বৃদ্ধি পেলে মাসিক পেনশনের পরিমাণও বাড়বে। পেনশন কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ এবং পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত।
এ স্কিমে নিবন্ধিত কর্মচারীরা পেনশন পাওয়ার উপযুক্ত হওয়ার পরের মাস থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের ব্যাংক হিসাবে মাসিক পেনশনের অর্থ পেয়ে যাবেন। মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তাদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। পেনশন পেতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো দপ্তরে যাওয়ার বা কোনো ধরনের প্রমাণ দেখানোরও প্রয়োজন হবে না।
তবে প্রত্যয় স্কিম ঘোষণার পর থেকেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এটি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন, অর্ধদিবস কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন তারা। তবে শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে গত ১ জুলাই থেকে ‘প্রত্যয় স্কিম’ চালু করেছে সরকার। প্রতিবাদে এ দিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে রয়েছে। বন্ধ লাইব্রেরিও। ফলে অচলাবস্থায় পড়েছে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তারা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। তবে শিক্ষকরা বলছেন, তারা পরবর্তীতে বিশেষ ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আরও বলছেন, প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। যেটা আগে কাটা হতো না। এ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন।
বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। সব থেকে বড় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বৈশাখি ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না।
শিক্ষকরা আরও বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না। আর তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন তারা। ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
এদিকে, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংবিধিবদ্ধ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর যোগ দেবেন, সরকার তাদের সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করবে।
স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৪০০ সংস্থা রয়েছে। যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৪ লাখের বেশি। এ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
বলা হচ্ছে- বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোনো অধ্যাপক পদ থেকে অবসরে গেলে গ্র্যাচুইটি পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, নতুন স্কিমে সেটি পাওয়া যাবে না। অবসরে গেলে অধ্যাপকরা এখন মাসিক পেনশন পান ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা, যার বিপরীতে বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হবে না। প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে বেতন থেকে কেটে ও প্রতিষ্ঠানের টাকায় পেনশন পাওয়া যাবে মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এককালীন কোনো টাকা পাবেন না পেনশনাররা।
এছাড়াও বর্তমানে প্রতি বছর পেনশনে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট হলেও প্রত্যয় স্কিমে সেটি বাড়বে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছরে, কর্মকর্তারা ৬২ এবং কর্মচারীরা ৬০ বছরে অবসরে যান। নতুন ব্যবস্থায় সবাইকে অবসরে যেতে হবে ৬০ বছর বয়সে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পেলেও সেই ব্যবস্থা নেই নতুন পেনশন স্কিমে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ও বৈশাখী ভাতা কিংবা এলপিআর সুবিধা পান। কিন্তু নতুন পেনশন স্কিমে সেটি থাকবে কিনা সেটি স্পষ্ট করা নেই।
 
                
              
 
																



 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    -20251027102457.jpeg) 
                                                     
                                                    




































