গঠনতন্ত্র উপেক্ষা, স্বেচ্ছাচারিতা আর ব্যক্তিগত রেষারেষি নিয়ে কুড়িগ্রামে গত ৮ বছর ধরে চলছে বিএনপির জেলা কমিটি। জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপের যাঁতাকলে পড়েছেন সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা।
জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা নির্বাচিত হন। ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি ২ বছরের জন্য গঠন করা হয়। কিন্তু এই কমিটি গঠনের কিছুদিন যেতে না যেতেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় দলের মধ্যে বিভক্তি। যা গত ৮ বছর ধরে চলমান। জেলার এই গ্রুপিং জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে তৃনমূলের ওয়ার্ড পর্যায়েও এর প্রভাব পড়ে।
সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম বকসী বলেন, “১৫ সালের কমিটি হবার পর দুই বছর পার হয়ে বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ এই কমিটি ৮ বছর ধরে কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে দুই গ্রুপে আবার অর্ন্তকলহ। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাধারণ কর্মী হিসেবে দ্রুত একটি নতুন কমিটি চাই।”
পৌর বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফারুক হোসেন বলেন, “সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কারণে প্রকৃত কর্মী-সমর্থকদের ছোট ছোট প্রোগ্রামগুলোতে আসতে দেখা যায় না। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নতুন করে গঠন হলে হয়তো তাদের পুনরায় দলের প্রোগ্রামে পাওয়া যাবে।”
জেলা কমিটির কার্যকরী সদস্য সাইদ আহমেদ বাবু বলেন, “দুই গ্রুপের গ্রুপিংয়ের জন্য আমরা কোনো প্রোগ্রামে যেতে পারি না। বিতর্ক এড়ানোর জন্য আমার মতো আরও দলের সদস্যরা নিয়মিত প্রোগ্রামে আসেন না। আমরা গ্রুপিং নিরসনে একটি নতুন কমিটির দাবি জানাই।”
দলটির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়াদ পার হওয়ার পরও জেলা কমিটির দুইটি গ্রুপ নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের ১৯ আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরের ভেলাকোপা এলাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সামনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ওই সময় সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমানসহ ১০ জন মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনায় কেন্দ্র থেকে সাইফুর রহমান গ্রুপের সাইফুর রহমানকে ও তাসভীর গ্রুপের যুগ্ম সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদকে শোকজও করা হয়।
পরবর্তীতে দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানার নেতৃত্বে জেলা শহরের পোস্ট অফিস পাড়ায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় জেলা কার্যালয়টি নিজের নিয়ন্ত্রনে নেন। অন্যদিকে সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম আমিন শহরের মোক্তার পাড়ায় আলাদা একটি নতুন জেলা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে দুই গ্রুপের দায়সারাভাবে চলছে বিএনপির নানা কার্যক্রম।
কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, “গঠনতন্ত্র মোতাবেক দুই বছরের মেয়াদের কমিটি প্রায় ৮ বছর ধরে চলছে। কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি দুই বছর পর পর কমিটি গঠিত হলে দলের মধ্যে এই বিভাজন থাকতো না। জেলা কমিটির ১৫১ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন সক্রিয় থাকলেও গ্রুপিংয়ের কারণে কমিটির বড় অংশ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এর মধ্যে আবারও সদর উপজেলায় পুরনো কমিটি থাকার পর নতুন কমিটি দেওয়ায় গ্রুপিং আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। তৃণমূলের অভিমত দ্রুত কমিটি গঠন করলে গ্রুপিং নিরসন সম্ভব হবে।”
জেলা কমিটির সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম আমিন বলেন, “বিএনপির ৯০ভাগ নেতাকর্মী আমাদের সঙ্গে রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কিছু লোক বিরোধিতা করতেই পারে। সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের বিষয়টি কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামে থাকায় ওভাবে শুরুতে সময় দিতে পারেনি। সম্প্রতি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা বিএনপি কমিটি সাধারণ সম্পাদক একক সিদ্ধান্তে দিয়েছেন যা গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। সাধারণ সম্পাদক এহেন কার্যক্রম করায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহাসচিব বরাবর পত্র দেব।”
এ বিষয়ে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা বলেন, “কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এটা ঠিক। আমরা কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে বসছি। নতুন কমিটির বিষয়টা চলমান প্রক্রিয়া।”
গ্রুপিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সভাপতি কমিটি হবার পর থেকে কোন প্রোগ্রামে ঠিক মতো আসেন না। তাকে পাওয়া যায় না। এ জন্য আমি কেন্দ্রের মহাসচিবকে অবগত করে নতুন নতুন কমিটি দিচ্ছি। দলের সাংগঠনিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
এ বিষয়ে বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, “কুড়িগ্রাম জেলা কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে একটা সমস্যা ছিল। এটা অনেকটা নিরসন হয়েছে। আর আমাদের জেলায় ১২টি ইউনিটের মধ্যে ৬টির কমিটি হয়েছে বাকিগুলো চলমান প্রক্রিয়া এরপর নতুন জেলা কমিটি গঠন করা হবে।”