• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

ভিনদেশি ফুল টিউলিপের রাজ্য এবার তেঁতুলিয়া


সোহাগ হায়দার, পঞ্চগড়
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২২, ০১:২৩ পিএম
ভিনদেশি ফুল টিউলিপের রাজ্য এবার তেঁতুলিয়া

বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা হিমালয়ের কন্যাখ্যাত পঞ্চগড়ে সমতল ভূমিতে চা, কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ফল, সূর্যডিম আম চাষের খ্যাতি অর্জনের পর এবার খামার পর্যায়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ভিনদেশি ফুল ‘টিউলিপ’ চাষ শুরু হয়েছে। এতে করে ‘টিউলিপের’ রাজ্যে পরিণত হচ্ছে হিমালয় কন্যাখ্যাত তেঁতুলিয়া। দেখা গেছে সারি সারি গাছে ছয় রঙের টিউলিপ ফুটতে শুরু করেছে। আর কয়েক দিনের মধ্যে পুরো বাগানে ফুলে ছেয়ে যাবে বলে মনে করছেন চাষিরা।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি টিউলিপ চাষে পরীক্ষামূলকভাবে বীজ (বাল্ব) বপন করা হয় সীমান্ত উপজেলা তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া এলাকার ৪০ শতক জমিতে। বীজ বপনের ২৫ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফুটেছে ফুল। টিউলিপের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ও হাসি দেখে অভিভূত কৃষকরা। কৃষকদের ক্ষেতে শোভা পাচ্ছে লাল, সাদা, হলুদ, কমলাসহ বিভিন্ন রঙের টিউলিপ ফুলের। আর এই ফুল চাষ দেখে স্থানীয় কৃষকরা যেমন টিউলিপ ফুল চাষে আগ্রহী অনুপ্রাণিত হচ্ছে, তেমনি দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদেরও নজর কাড়ছে।

তবে হিমালয় কন্যাখ্যাত এই উপজেলা তেঁতুলিয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি টিউলিপ ফুলে ইতিমধ্যে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ফুলটি একপলক দেখতে তেঁতুলিয়া আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অনেক পর্যটক।

টিউলিপ ফুল পাত্রে চাষাবাদের উপযোগী এক প্রকার পুষ্পজাতীয় উদ্ভিদ। এছাড়া এটি বাগানে কিংবা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জমিতেও চাষ করা হয়ে থাকে। এটির প্রায় ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়। গৃহের অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধিকারী ফুল হিসেবে এর সুনাম রয়েছে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রথম ও দেশের দ্বিতীয়বারের মতো এবার খামার পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে শীতপ্রধান দেশের নজড়কারা ও সবচেয়ে দামি ফুল এই টিউলিপ। শীতের মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও পরিমিত তাপমাত্রা বিরাজ করায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি জাতের ফুল টিউলিপ চাষ করে সফলতা পেয়েছে বেশ কয়েকজন কৃষক।

তেঁতুলিয়ার সদর ইউনিয়নের দর্জিপাড়া ও শারিয়ালজোত এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা তাদের টিউলিপ ফুল ক্ষেতে পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এদিকে তেঁতুলিয়ার মাটিতে এই ফুল হওয়ায় ফুল দেখতে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ করা গেছে বাগানগুলোতে।

কথা হয় উপজেলার সারিয়ালজোত এলাকার টিউলিপ ফুলচাষি মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। 

মনোয়ারা বেগম বলেন, “ইউএসডিও অফিস আমাদের টিউলিপ ফুলের বীজ, সার দিয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা করছে। আমি ৫ শতক জমিতে এই ফুলের চাষ প্রথমবারের মতো করেছি। আমি বীজ বপনের কয়েক দিনের মাথায় বাগানে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। একই কথা জানান অন্য চাষিরা।”

চাষি আয়েশা বেগম বলেন, “আমি টিউলিপ ফুলের চাষ করে সফলতা পেয়েছি। বাগান থেকে প্রতিটি ফুল ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। আশা করি বাগানে যে ফুল আছে, তা বিক্রি করে আমি আমার খরচ তুলে বাড়তি আয় করতে পারব। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ বাগানে এসে ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এবার লাভ হয়, তাহলে আগামীতে বেশি করে টিউলিপ চাষ করব।”

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেদারল্যান্ডস, কাশ্মীর, সুইজারল্যান্ড ও তুরস্কের মতো শীতপ্রবণ দেশে এ ফুলের ‘টিউলিপ’ চাষ হয়ে থাকে। পঞ্চগড় শীতপ্রবণ জেলা হওয়ায় টিউলিপ পরীক্ষামূলকভাবে চাষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় তেঁতুলিয়ার মাটিতে প্রথমবারের মতো চাষ শুরু করা হয়েছে এই ফুলের। ইতিমধ্যে অনেকটাই সাফল্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে উদ্যোক্তা ও চাষিরা।


কথা হয় ঠাকুরগাঁও থেকে টিউলিপ ফুল দেখতে আসা পর্যটক হাবিবা, জাহিদা ও আমিরুলের সঙ্গে। তারা বলেন, “আমরা এই ফুল আগে দেখিনি। ফুলটি দেখার জন্য পঞ্চগড় থেকে এসেছি। বাগানে এই ফুলগুলো দেখে অনেক ভালো লাগছে। বাড়ির জন্য কয়েকটি ফুল ৮০ থেকে ১০ টাকা দরে কিনে নিলাম। কয়েক দিন ধরে টেলিভিশন বা ইউটিউবে টিউলিপের বিষয়টি দেখানো হচ্ছে। আমরা টিভি ও ইউটিউবে এই ফুলটি দেখেছি। কিন্তু এভাবে কখনো টিউলিপ ছুঁয়ে দেখিনি। সত্যিই টিউলিপ একটা আকর্ষণীয় ফুল। তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ চাষ হচ্ছে, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে।”

এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাজারজাত করতে পারলে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে, তেমনি এই অঞ্চলের পর্যটনে নতুন মাত্রা পাবে।

উদ্যোক্তারা আরও জানান, ৬টি প্রজাতির ১২ রঙের টিউলিপ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্ট্রাকটিকা (হোয়াইট), ডাচ সানরাইস (ইয়েলো), পারপেল প্রিন্স (পারপেল), টাইমলেস (রেড হোয়াইট শেডি), মিল্কসেক (লাইট পিংঙ্ক), বারসেলোনা (ডার্ক পিঙ্ক) নামে রংবেরঙের টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। এছাড়া অ্যাড রেম (অরেঞ্জ), লালিবেলা (রেড), দি ফ্রান্স (রেড), রিপ্লে (অরেঞ্জ), ডেনমার্ক (অরেঞ্জ), স্ট্রং গোল্ডসহ (ইয়েলো) বিভিন্ন প্রজাতির টিউলিপ কলিতে ভরে গেছে, প্রতিদিনই নতুন নতুন ফুল ফুটছে বাগানগুলোতে। আশা করা যায় আবহাওয়া ঠিক থাকলে কিছুদিনের মধ্যে বাগানের সব ফুল ফুটবে। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই ফুল চাষ সহনশীল।

ইএসডিওর সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (এপিসি) ও টিউলিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী আইনুল হক বলেন, “আমরা ইউএসডিও পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে আটজন কৃষকের মাধ্যমে টিউলিপ চাষ করার কয়েক দিনের মধ্যে ফুল ফোটেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন রঙের ফুল ফুটছে। আশা করছি চাষিরা টিউলিপ চাষ করে লাভবান হবেন। বীজ যেহেতু বাইরের দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয়, যে কারণে খরচ বেশি। বীজ যদি আমাদের দেশে উৎপাদন বা সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে এতে উৎপাদন খরচ যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি স্বল্প মূল্যে কিনতে পারবেন চাষিরা।

এ বিষয়ে ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, টিউলিপ ফুল চাষের মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক আয় এবং সম্ভাবনা যেমন অনেকাংশে বেড়ে যাবে, তেমনিভাবে পর্যটনশিল্পেও তেঁতুলিয়ার যে বিদ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের যে একটি আধার, সেটি আরও সম্প্রসারিত হবে। এটি এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতে টিউলিপ চাষ আরও বড় আকারে সম্প্রসারিত করার ইচ্ছা রয়েছে। টিউলিপের বাজারজাতকরণের জন্য আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে ফুল ব্যবসায়ীদের প্রকল্প এলাকায় নিয়ে এসে ফুল কেনার বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলার বিষয়েও বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
 
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “তেঁতুলিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপ চাষ হয়েছে। এই ফুল চাষে আমরাও কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের সহযোগিতা কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছি। তেঁতুলিয়ায় প্রথমবারেরই টিউলিপের ফুল ফুটেছে।”

Link copied!