পঞ্চাশের দশকে দোকানটির নাম ছিল ‘রানীবাজার রেস্টুরেন্ট’। কয়েক বছরের মধ্যে সাইনবোর্ডটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর কোনো সাইনবোর্ড লাগানো হয়নি। দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে ‘বাটার মোড়ের জিলাপির দোকান’ হিসেবে। দোকানের ম্যামোতেও এখন লেখা ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। নামহীন এই দোকানটির জিলাপির সুনাম তিন প্রজন্ম ধরে। দোকানটির অবস্থান রাজশাহী শহরের বাটার মোড় এলাকায়।
রমজানের সময় বাটার মোড়ের জিলাপি ছাড়া ইফতার ভাবতেই পারেন না অনেকে। বছরের পর বছর দোকানটিতে একই স্বাদের জিলাপি তৈরি হয়। এখানকার কারিগররাও দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন। সাধারণ সময়ে দোকানটিতে রোজ ৮০ থেকে ৯০ কেজি জিলাপি বিক্রি হয়। রোজায় তা ২০০ কেজি পর্যন্ত হয়। আসরের নামাজের পর লোকজন এখানে জিলাপি কিনতে রাস্তার ওপর রীতিমতো লাইনে দাঁড়ান। ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খান কারিগররা।
জানা গেছে, দোকানটির যাত্রা শুরু ১৯৬০ সালে। তখন এর মালিক ছিলেন সোয়েব উদ্দিন। তার একমাত্র কারিগর ছিলেন জামিলী সাহা। শুরু থেকেই এই জিলাপি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে জামিলী সাহার জিলাপির প্যাঁচ দেওয়া শিখে যান তার ছেলে কালিপদ সাহা। ১৯৮০ সালে জামিলী সাহা মারা গেলে প্রধান কারিগর হন কালিপদ সাহা। কালিপদের কাছ থেকে শেখেন সাফাত আলী আর শফিকুল ইসলাম। জিলাপির সুনামের সঙ্গে সঙ্গে সারা শহরের মানুষের কাছে ‘কালিবাবু’ নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠা কালিপদ সাহা মারা যান ২০১৭ সালে। এখন প্রধান কারিগর তার শিষ্য সাফাত আলী। সঙ্গে আছেন শফিকুল ইসলাম।
সাফাত আলী দোকানটিতে যোগ দেন ১৯৮২ সালে। আর শফিকুল এসেছেন ১৯৭৬ সালে। সাফাত আলী বলেন, “মাসিক ৩০ টাকা বেতনে এখানে এসেছি। এখন বেতন পাই ১৫ হাজার টাকা। জীবনের বাকিটা সময়ও এই দোকানেই কাটিয়ে দিতে চাই।”
ক্রেতারা মনে করেন, এই দোকানের কারিগরদের হাতেই আসে সুস্বাদু জিলাপি। কীভাবে এটি সম্ভব হয়—জানতে চাইলে শফিকুল বললেন, “আসলে কারিগর কিছু না। মহাজন যদি চান, তাহলেই খাবার সুস্বাদু হবে। এ জন্য লাভের আশা কম করতে হবে। এই দোকানের ক্ষেত্রে তাই। মহাজন কয়েক ধরনের ময়দা, ভাল তেল দিয়ে জিলাপি তৈরি করেন। ভাল খাওয়ান। এই ইচ্ছাটা থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ, জিলাপি ভাল করতে ভাল পরিশ্রমও করতে হয়।”
শফিকুল যেখানে রসে টইটুম্বুর আর মচমচে জিলাপি বানাচ্ছিলেন, সেখানেই বিক্রি হচ্ছিল। জিলাপি কিনতে এসে আব্দুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি বললেন, “আমার বয়স ৪৫। ২০ বছর বয়স থেকে এই জিলাপি খাই। এখন ডায়াবেটিসের ভয়ে কম খাই। কিন্তু ইফতারে এই জিলাপি থাকায় লাগে। তা না হলে মনে হয় ইফতারিটা পরিপূর্ণ হলো না।”
দোকানের প্রতিষ্ঠাতা সোয়েব উদ্দিন মারা যাওয়ার পর তার চার ছেলে এর মালিকানা পান। এর মধ্যে সোহেল খান দোকানটি চালাতেন। তিনি মারা গিয়েছেন।
রাজশাহীর সাধারণ দোকানগুলোতেই এ বছর ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে জিলাপি বিক্রি হচ্ছে। অথচ এত নামডাকের বাটার মোড়ের জিলাপি বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০ টাকায়। দোকানটি এখন চালাচ্ছেন মো. শামীম ও হাসিমুদ্দিন নাইট। হাসিমুদ্দিন নাইট বললেন, “আমরা দাম বাড়াতে চাই না। রোজার সময় তো দাম বাড়ানোর কথা চিন্তাই করি না। দোকানের ইতিহাসে কখনও রোজায় দাম বাড়ানো হয়নি। এখন ময়দা, তেল, গ্যাস, চিনি—সবকিছুর দাম বেশি। তা-ও রোজার মধ্যে জিলাপির দাম বাড়ানো হয়নি।”