• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পাঁচ দশকে দেশের স্বাস্থ্য খাত


নাজিয়া আফরীন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২১, ০৫:০০ পিএম
পাঁচ দশকে দেশের স্বাস্থ্য খাত

একসময় কলেরা বা ডায়রিয়ায় দেশে মহামারি লেগে যেত। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত সাধারণ এই রোগটিতে। অথচ ডায়রিয়ার চিকিৎসায় মামুলি যে খাবার স্যালাইন ব্যবহার করার যুগান্তকারী সাফল্য বাংলাদেশ দেখাল, তাতে এই রোগের গা থেকে মহামারি শব্দটি হারিয়েছে চিরকালের মতো। গুটিবসন্ত অথবা পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক ছিল দেশজুড়েই। বাংলাদেশে সর্বশেষ গুটিবসন্তের রোগী ছিলেন ভোলার রহিমা বানু। ১৯৭৫ সালের ১৬ অক্টোবরে রহিমা শনাক্ত হন, এরপর ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশকে গুটিবসন্তমুক্ত ঘোষণা করা হয়।

২০১৪ সালের ২৭ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও ১১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও পোলিওমুক্ত হয়। এভাবেই ফাইলেরিয়া, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, ধুষ্টংকার, হাম, কুষ্ঠ, জলাতঙ্ক এই রোগগুলো দেশের স্বাস্থ্য খাতের ইতিহাসের পাতায় তুলে রাখার পথে বাংলাদেশ। সংক্রামক রোগসহ অজানা রোগ শনাক্তে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর। সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ ভাইরাসের মতো অজানা রোগ শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। তবে এখন পর্যন্ত গবেষণাকাজে পর্যাপ্ত লোকবল ও অর্থবল সংকট একটা বড় বাধা।

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ রোগ নির্মূল ও রোগনিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে রোগ নিয়ন্ত্রণে এই সাফল্যের পেছনে জাতীয় কর্মসূচিগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের সাফল্যের ৩০ থেকে ৫৫ শতাংশ নির্ভর করে আর্থসামাজিক বিষয়ের ওপর। স্বাধীনতার পর থেকে সরকার যোগাযোগ, অবকাঠামো নির্মাণ, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, খাদ্যসহ নানা খাতে পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তবে সেই তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে এ ধরনের সরাসরি কোনো পরিকল্পনা ছিল না কোনো সরকারের আমলেই। কিন্তু নানান খাতের প্রকল্পের সুফল পরোক্ষভাবে পেয়েছে স্বাস্থ্য খাত।

চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ২০১৩ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে একটি সিরিজ প্রকাশ করে, যাতে নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে কীভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশ স্বাস্থ্য খাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তা তুলে ধরা হয়। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের বিস্ময়, বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)। দেশের শূন্য থেকে ১৮ মাস বয়সী শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত নারীদের টিকাদান কর্মসূচি বিনা মূল্যে বিস্তৃত সারা দেশে। ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো, সংক্রামক রোগ ও পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি মিলেছে বাংলাদেশের। টিকাদান কর্মসূচির এই বিরাট সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মানিত হয়েছেন ভ্যাকসিন হিরো হিসেবে। আর ইপিআই কর্মসূচির এই শক্তিশালী নেটওয়ার্কের সুফল আমরা পেলাম করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে। সারা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশই যখন করোনার ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করতেই পারেনি, তখন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে আমাদের পক্ষে।

গত পাঁচ দশকে নিবেদিতপ্রাণ কিছু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্র্রমে কিছু যুগান্তরী উদ্যোগ বা প্রকল্প বা পরিকল্পনা মোটাদাগে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কমিউনিটি ক্লিনিক, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে সাফল্য, দেশজুড়ে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত হাসপাতাল, স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং অবশ্যই ওষুধশিল্পের বিকাশ। সব কটি বিষয় নিয়ে আলাদা করে বলার আছে অনেক কিছু। তবে এখানে স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য বিগত সরকারগুলোর সদিচ্ছা থাকলে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত। এখন পর্যন্ত দেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশেরও কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ৭০ শতাংশের বেশি নিজের পকেট থেকে খরচ করেন এ দুই দেশের নাগরিক। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণাতেও দেখা যায়, এই চিত্র এখনো খুব বেশি বদলায়নি। সরকারি হাসপাতালে ফ্রিতে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও সিন্ডিকেটবাজির খপ্পরের ভয়ে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে। ফলে দেশে খুব দ্রুতই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রসার পেয়েছে।

ওষুধশিল্পে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে দেশে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ওষুধ আমদানি করতে হতো। বর্তমানে ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন হয়। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৪৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। গত ছয় বছরে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৫ থেকে ৩১ বিলিয়নে। তবে একসময় দেশে ৭টি টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল। গত দশ বছরে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানটি নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিয়ম দুর্নীতিতে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। আর করোনাকালে এটাই মোক্ষম সুযোগ।

৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে যদি দেশের নারী ও শিশুস্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথা না বলা হয়। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যু কমাতে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারের মিডওয়াইফ ট্রেনিংসহ জরুরি প্রসব সেবা দেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। বর্তমানে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের পুষ্টি উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখছে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের বিশাল স্বাস্থ্য অবকাঠামো।

গত ৫০ বছরের স্বাস্থ্য খাতের অর্জনে বড় দুর্বলতা হচ্ছে দুর্নীতি ও অনিয়ম, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। আনুপাতিকহারে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংখ্যা না বাড়ানো স্বাস্থ্য বিভাগের একটি বড় ব্যর্থতা। আর স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণের দাবি প্রতিটি জনমানুষের। বর্তমান সরকার দেশজুড়ে আরও ৪০টি বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মতো পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও বাড়ালে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী লাভবান হতো। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আরও ফোকাস হয়ে এগোতে হবে। গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বিশাল অর্জন রয়েছে। দেশে গড় আয়ু ৪০ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ বছর হয়েছে। আর সাফল্যের এই ধারা ধরে রাখতে স্বাস্থ্যসেবা খাত সঠিক পথেই এগোবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

 

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!