কালের পরিক্রমায় মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সঙ্গে মানুষ নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে শিখেছে। পরিবার-সমাজের গণ্ডি ভেদ করে মানুষ আত্মমর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। ফলে সামাজিকভাবে কিছু জটিলতাও বেড়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে বিবাহবিচ্ছেদের খবর। কিন্তু এই বিচ্ছেদ বা সংসার ভাঙার দায় আসলে কার? নারীর একার, নাকি পুরুষেরও; নাকি ক্ষেত্রবিশেষে কখনো নারীর, কখনো বা পুরুষের?
দুজন মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধনে সৃষ্টি হয় দাম্পত্য জীবনের। কিন্তু বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদ এতটা বেড়ে গেছে, তার প্রধান কারণ তবে অবশ্যই ভালোবাসাহীনতা। অবিশ্বাস। অশ্রদ্ধা। একজনের প্রতি অন্যজনের অতিরিক্ত অবহেলা। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে অনেকগুলো বিষয়, যেগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো এক পক্ষের অতিরিক্ত লোভ কখনো কখনো দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরায়। সেই লোভ হতে পারে পুরুষ কিংবা নারীর। পুরুষের ক্ষেত্রে নারীর পৈতৃক সম্পত্তির ওপর ঝোঁক বেশি। এমনকি বিভিন্নভাবে নারীর প্রতি শারীরিক মানসিক নির্যাতনও চালানো হয়।
নারীদের বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে বরপক্ষের বিয়ের প্রথম থেকেই বিশেষ নজর থাকে। আর বিয়ে হয়ে গেলে তখন তো অধিকারই জন্মে গেছে বলে মনে করে পুরুষতন্ত্র। দাম্পত্য সম্পর্কের অধিকার নারী হয়ে ওঠে তখন পুরুষের শিকার। নানাভাবে পীড়নে পীড়নে নারীর মনকে দগ্ধ করে তোলা হয়। মানুষের সামনে অপমান-অপদস্থ করেও ক্ষান্ত হয় না একশ্রেণির পুরুষ। ফলে সে ক্ষেত্রে পুরুষকে দোষারোপ করাই যায়। আবার উল্টো চিত্রও চোখে পড়ে। কোনো কোনো নারীর স্বামীর আয়ের চেয়ে ব্যয়ের হাত বেশি। সে ক্ষেত্রে পুরুষকে পড়তে হয় বিপাকে।
নারীর অতিরিক্ত চাহিদার জোগান না দিতে পারলেই কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য; এমনকি সাংসারিক নানা দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু নারীকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হয়।
পুরুষের ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি যেমন নারীর ক্ষেত্রেও তেমন। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের প্রতি শোষণটাই অনেকাংশে বেশি। একশজনে নব্বইজন নারীই নির্যাতনের শিকার। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির প্রতি অধিকার সৃষ্টি হয় পুরুষের। কিন্তু সেই অধিকার বলে ভালোর চেয়ে মন্দের পরিমাণ বেশি। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের চাহিদার যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তেমনই পরিবর্তন ঘটেছে কৌশলের।
বিয়ের পর নানা কৌশলে নারীদের থেকে টাকা, জমি বিভিন্ন উপঢৌকন নিতে দেখা যায় পুরুষের ক্ষেত্রে। ফলে অশ্রদ্ধার জন্ম হয় এখান থেকেই। প্রকাশ না হলেও এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত যৌতুক বা উপঢৌকন কখনো সম্মান বাড়াতে পারে না। এভাবেই গড়ে ওঠে নারীর ওপর নানা মাত্রিক মানসিক চাপ। গ্রাম-অঞ্চলে এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিও মানুষের মস্তিষ্কে আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
স্ত্রীর উপার্জনের ওপর স্বামীর খবরদারি। বর্তমানে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে ফলে নারীরা বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু নারীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসছে না। কারণ চাকরির বেতন যেটুকু আসছে তার ওপর পুরুষের হস্তক্ষেপ! সে ক্ষেত্রে কর্মে নিযুক্ত নারীর মনে প্রেশার বাড়ছে! সারা দিন পরিশ্রম করার পর সংসার-সন্তান লালন-পালন করে আবার চাকরির টাকায় যখন স্বামীর হস্তক্ষেপ তখন তা মানতে নারাজ হচ্ছে নারীরা। নারীদের এই মানসিক দ্বন্দ্ব একসময় ধীরে ধীরে দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরাতে শুরু করছে। পুরুষের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু সময় নারীর অতিরিক্ত নজরদারি পুরুষকে চাপের মুখে ফেলছে। আর পুরুষও চাপ সইতে না পেরে গতিপথ বদলে একটু শান্তি খোঁজার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের উভয়েই যদি একে অপরের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা এবং শেয়ারিং কেয়ারিং এর মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করেন তাহলে সমস্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।
স্ত্রীর উপার্জনের ওপর যেমন স্বামীর খবরদারি ঠিক পুরুষের উপার্জনের ওপর নারীর খবরদারি উভয়ই সমানভাবে ক্ষতিকর। প্রত্যেকটা মানুষ স্বাধীন। জীবনযাপনও স্বাধীন ও ব্যক্তির রুচি-অভিরুচি, মতকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। তবে অনেক সময় এক পক্ষ অতিরিক্ত ভালোবাসা বা করায়ত্ত রাখার তাগিদে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। যে চাপের কারণে মানসিক স্বস্তিটা নষ্ট হয়ে যায়। দাম্পত্য সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে। কিন্তু নারী বা পুরুষ সম্পর্ক সুন্দর করে চালিয়ে নিতে উভয়ের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। কারণ কোনো একপক্ষের পক্ষে সব সময় পেরে ওঠা সম্ভব হয় না। মানুষ মাত্রই একটা সময় ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে দুদিকের বাটখারা যদি সমান হয়, তবে অনেকটা ভার বহন করা যায়। কিন্তু কোনো একদিকে বেশি ভার হলে বরং ছিঁড়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়।
দাম্পত্য সম্পর্কের চিড় ধরলে বা কোনোরকম সন্দেহ প্রবণতার বশে অনেক নারী বা পুরুষ জীবনের সর্বোচ্চ ভুলটা করে বসে। অফিসের সহকর্মী বা পরিচিতজনের কাছে নানা রকম কুৎসা রটনা করে থাকে। সে ক্ষেত্রে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়া ছাড়া আর কোনো ভালো দিক আসে না। এ ক্ষেত্রে মনের সঙ্গে সংসারেও ছেদ পড়তে শুরু করে।
অনেক নারী স্বামীর বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের ভালো চোখে দেখে না। আবার পুরুষের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা কম নয়। কিন্তু এর ফলও শুধু বিষাদের সৃষ্টি করে। অশ্রদ্ধার জন্ম দেয় মনে। যেই অশ্রদ্ধা একসময় ভুঁইফোঁড় হয়ে সংসারের মাঝে বিষের সৃষ্টি করে।
নারী বা পুরুষ উভয়েই বেরিয়ে আসতে চান দম বন্ধ করা এ সম্পর্ক থেকে। তাই নারী বা পুরুষ উভয়ের কেউ একজন যদি অতি ডমেনেটিং পাওয়ার নিয়ে সংসারকে নিজের ভোগ দখলের অংশ করে তোলে এবং একে অন্যের কাজের প্রতি আস্থা বিশ্বাস না রাখে, তবে আজকের ভয়াবহ অবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। কারণ আজকের নারী বা পুরুষ স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী। ফলে নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে যেমন নারী চুপ থাকছে না, তেমনি পুরুষও। ফলে একমাত্র ভালোবাসা-সম্মান-আস্থা-ভরসা এবং বিশেষভাবে বিশ্বাসের সংমিশ্রণে একে অন্যের কাজের সহযোগিতা না করলে সময় বদলানো কঠিন হবে।
অনেক স্ত্রী আছে, তারা কথায় কথায় স্বামীকে নির্বোধ প্রমাণের প্রবণতা দেখা যায়। আবার ঠিক অনেক পুরুষ আছে, যারা স্ত্রীর কোনো কাজেরই স্বীকৃতি দিতে নারাজ। স্ত্রীকে সবার সামনে বিভিন্নভাবে অসম্মানিত করে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে। কথায় কথায় ‘তুমি বুঝবে না’ এমন মন্তব্যে ব্যথা সৃষ্টি করে! উভয় পক্ষের এমন প্রবণতা সম্পর্কে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কোনো সম্পর্কই একদিনে খারাপ হয় না বা ফাটল ধরে না। ধীরে ধীরে সুন্দর থেকে অসুন্দরে রূপ নেয়। যেগুলো আমরা সাদাচোখে কোনো দোষ বলে মনেও করি না হয়তো কখনো কখনো। কিন্তু মন বড়ই অদ্ভুত। যাকে সবচেয়ে আপন ভেবে চলে মানুষ, তার কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট-দুঃখ-বেদনার পাহাড় পেতে থাকে, তখনই সম্পর্কে ফাটল ধরে। ফলে সম্পর্কের সঠিক পরিচর্যা জরুরি। স্বামী-স্ত্রী যদি যদি নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্কের পরিচর্যা না করেন তবে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন।
স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং দুজন সমান ভালোবাসা শ্রদ্ধায় আগলে রাখলে তবেই সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে চলবে। কিন্তু কেউ কেউ নিজেকে ওভার স্মার্ট ভেবে বিপরীত পক্ষকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। সেখান থেকেও সৃষ্টি হয় দাম্পত্যের ভাঙন। এছাড়া মনের অমিল তো আছেই।
নারী-পুরুষ জীবনের একটি সুন্দর সময় পার করেন পরিবারে। তবে এই পরিবারই নরক-সম হয়ে ওঠে যদি অশ্রদ্ধা-সম্মানহীনতা এবং ভালোবাসা- ভরসা-আস্থার অভাব ঘটে। এ ক্ষেত্রে এককভাবে নারী বা পুরুষ উভয়েই দায়ী হতে পারে। আবার কখনো পরস্পরের অসহযোগিতা সম্পর্কের ছেদ ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
দাম্পত্য সম্পর্কে স্বচ্ছতা অত্যাবশকীয়। অনেক নারী বা পুরুষের মধ্যে তথ্য গোপন রেখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালে এ ধরনের প্রতারণা বা ধোঁকাকে কেন্দ্র করে দাম্পত্য সম্পর্কে দেখা দেয় মনোমালিন্য। একসময় ধীরে ধীরে এটাই বৃহৎ আকার ধারণ করে। ফলে নারী-পুরুষের উভয়েরই উচিত স্বচ্ছতার মাধ্যমে সম্পর্ক করা। তাতে করে ভবিষ্যৎ জীবনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।
বর্তমানে খুবই ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে উভমুখী সম্পর্ক। সাংসারিক নানামাত্রিক খুঁটিনাটিকে কেন্দ্র কিছু শ্রেণি পুরুষের এবং নারী এই জায়গাটি দখল করে। প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই সম্পর্কের বরাতে কয়েকটি পরিবার বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। একটি পরিবারে নারী ও পুরুষ যদি উভয়েই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তবে সেখান থেকে মোটামুটি চারটি পরিবার আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। অনেক ক্ষেত্রে এই সার্কেল চক্রাকারে চলতেও পারে। ফলে দাম্পত্যবিচ্ছেদ শুধু দুজনকে আলাদা করছে না, দুটি পরিবারসহ দুটি গোষ্ঠীর সম্পর্কেরও ভাঙন ধরাচ্ছে। তাই প্রত্যেকের উচিত স্বামী-স্ত্রী সুখী দাম্পত্য জীবন পরিচালনা করার জন্য একে অন্যের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সম্মান ও বিশ্বাসের পাল্লাটা ভারী রাখে। যেন ঠুনকো কোনো হাওয়ায় তরী ডুবে না যায়। নারী-পুরুষ উভয়কেই এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সর্তক থাকতে হবে।
সংসার সব সময় সুস্থ স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নিতে দুপক্ষের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। তাই সম্পর্কের সঠিক পরিচর্যা করা আবশ্যক। ক্ষেত্র বিশেষে নারী বা পুরুষ উভয়ই সংসার ভাঙার জন্য দায়ী।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়