• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

৭ মার্চ বাইরে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সহি হবে?


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৪, ১০:৪৯ এএম
৭ মার্চ বাইরে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সহি হবে?

আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা তার আত্মজীবনীতে লেখেন—“কারাগার থেকে বের হয়ে যখন সাদাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলাম, তখন দেখলাম, আমাদের কারও মাথায় শিং নেই। অর্থাৎ কেউ কারও অত বড় শক্র নয়। কিন্তু তাদের একসঙ্গে বসা হয়নি। ঘৃণা সংযুক্তির সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেয়।” এমন সম্প্রীতির সহাবস্থান দেখি শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ-রকম সহাবস্থানের বহু ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এখন কি তা আছে? 

নোবেলজয়ী ফিলোফিনো সাংবাদিক মারিয়া রোসা তার ‘হাউ টু স্ট্যান্ড আপ টু আ ডিক্টেটর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সত্যের তুলনায় মিথ্যা দৌড়ায় ছয় গুণ গতিতে। ঘৃণাও দ্রুত ছড়ায়। কেবল অসত্যের ক্রেতা নয়, রয়েছে ঘৃণারও ক্রেতা।

আমাদের মধ্যে বেশ সহজাত হয়ে উঠছে অন্যকে ছোট করে দেখা। অন্যকে ছোট দেখানোর জন্য আমাদের আচরণ বা বিদ্বেষ ছড়ানো শব্দমালা কেন ‘হেট স্পিচ’ হিসেবে গণ্য হবে না? এ কথা শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি—অন্যকে ছোট করে কেউ কখনো বড় হতে পারে না, কিংবা অন্যের মতপ্রকাশকে সম্মান জানানো উচিত। প্রাত্যহিক জীবনে এসবের উপস্থিতি খুবই কম। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু ঘৃণা বা বিদ্বেষ উদ্গার ঠিক নয়।  

দুই।
আওয়ামী লীগ আমলে দেখেছি, এরা মনে করতো তারাই বাংলাদেশ। সেই পূর্বাপর অবস্থা এখনো চলছে। খুব পার্থক্য নেই। চারদিকে চাপ প্রয়োগের অশুভ প্রক্রিয়া দিনের পর দিন একটা অস্থির পরিবেশ তৈরি করছে। এটা যে আগামীতে কোন দিকে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়। মতের অমিল হলে ট্যাগ লাগানোর একটা অসুস্থ প্রবণতা এখনো খুব দেখা যাচ্ছে। এটা নিসন্দেহে ঘৃণার বাতাবরণ। 

ইনক্লসিভ রাষ্ট্রের কথা বলছি আমরা। কিন্তু সেই রাষ্ট্রটি আসলে কোথায়! ইনক্লসিভ রাষ্ট্রে তো সকল পক্ষ-বিপক্ষ মানুষের সহাবস্থান তৈরি হওয়ারই কথা। মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখলে একটা শ্রেণি বলে, এসব আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে লেখা। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ন্যারেটিভ করার সুযোগটা দিয়েছে দলটির বিরোধীরাই। মুক্তিযুদ্ধ মানেই আওয়ামী লীগ, এ ধারণা থেকে যতক্ষণ বের হওয়া যাবে না, তখন এ ন্যারেটিভ থামবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধ কি আওয়ামী লীগের? কারা আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে তাদের ফ্রেমে তুলে দিয়েছে? 

২০০১ সালের কথা। বিএনপি মাত্র ক্ষমতায় এলো। নোয়াখালীতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) নিয়ন্ত্রণে। ওই সময়ে আমি পলাশকুঁড়ি খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক। বিজয় মেলায় অংশগ্রহণ করে পলাশকুঁড়ি। মাইক্রোফোনে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি উচ্চারণ করা মাত্রই জাসাসের সভাপতি আমাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনলেন। তিনি প্রশ্ন করেন, মুক্তিযুদ্ধ কেন বললাম। এ শব্দটি আওয়ামী লীগের। এটা বলা যাবে না। 

আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ইতিহাসকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করে নেওয়া। যেটা মস্ত ভুল। যার কারণে আওয়ামী লীগ বারবার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ন্যারেটিভ করার সুযোগ পেয়েছে, সংকীর্ণ করার প্রয়াস পেয়েছে। এ কাজটা বিএনপি তার মতো করে জিয়াউর রহমানকে নিয়েও করেছে, তাকে দলে অন্তর্ভুক্তিকরণ করেছে। বিএনপি শাসনামল যদি ভুলে না যাই, এমনটা তো দেখা গেছে, হয়তো কম ‍ছিল গত ১৫ বছরের তুলনায়। কিন্তু এর ফলে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে কিংবা তার পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণকে পুরোপুরি খারিজ করা হয়েছে। জনমানসের সেই চরিত্রটাকে অস্বীকার করা হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জনযুদ্ধেরই ইতিহাস।   

তবে কি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ব? মনে রাখতে হবে, কেউ চূড়ান্ত নন। যে কাউকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। প্রশ্ন জারি রাখাটা বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য অপরিহার্য। আলাপ-আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্য চিহ্নিত হবে। বঙ্গবন্ধুও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন, চূড়ান্ত নন। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “শেখ মুজিব ছিলেন দুজন। প্রথমজন স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত স্থপতি। দ্বিতীয়জন খোদ সংবিধান জখম করে একদলীয় শাসন কায়েম করা একনায়ক।” এ বিশ্লেষণের মধ্যে একধরনের অবস্থান বোঝা যায়। বিষয়টি অগ্রাহ্য না করে ঘটনাপরম্পরার সঠিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এমন নেতা অনেক আছেন, যারা বিপ্লবে সফল হলেও জাতি গঠনে ভুল করেছেন। তারা এমন সব ভুল করেছেন, যা দেশের মানুষের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ, দুর্দশা, এমনকি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের মাও সেতুংয়ের পুরোটা জীবন কেটেছে দেশের মানুষকে ভালোবেসে, তাদের জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করে। কিন্তু পরবর্তীতে তার ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ ও ‘কালচারাল রেভ্যুলেশন’ নীতি বাস্তবায়নের ফলে অগণিত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নিপীড়ন হয়েছে। অন্যান্য বিশ্বনেতার এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ব্যক্তিদের মতো বঙ্গবন্ধুকেও সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাঁর জীবন অনুসন্ধানের বহু দিক এখনো বাকি। স্বাধীনভাবে প্রজন্মদের সেসব খুঁজে নেওয়া উচিত। বরং দেখা দরকার প্রথম মুজিব যেন বেহাত না হন। একইভাবে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদসহ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের চরিত্রগুলো বেওয়ারিশ না হয়। যেন তারাও সব সময় জনতার আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা-প্রশংসার জন্য উন্মুক্ত থাকে। তাদের স্মরণ করার দায় যেন জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া না হয়। 

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে প্রথম সা‌রিতে যা‌রা ছিলেন, ত‌া‌দের অবমূল‌্যায়ন ক‌রে পেছ‌নের সা‌রি থে‌কে অযাচিতভাবে বঙ্গবন্ধু‌কে টে‌নে এনে মধ‌্যম‌নি করা হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধু‌কে ইতিহা‌সের সব জায়গায় কার‌ণ-অকারণে স্থান দেওয়া ও অন্যদের ‘নাই’ করার প্রবণতা তার লিগ্যাসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যখন কেউ বঙ্গবন্ধুকে সংকোচনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন বা তাঁর সম্পর্কে দ্রুত উপসংহারমূলক মন্তব্য করছেন, তখন তা ক্রিটিক মনে হচ্ছে। ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এ নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্ন মনের ভেতর জাগছে, বাঙালির মননে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে নির্মাণ করেছেন? না তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে? কোনো মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস কি নেতৃত্বশূন্য হয়?

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল লেখেন—“সব অপপ্রচার আর অতিরঞ্জনের মাঝে সবচেয়ে ধ্রুব সত্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি, অবিসংবাদিত প্রধান নেতা। যে স্বাধীনতা এনেছেন তিনি, কমবেশী তার সুফল ভোগ করছি আমি, আপনি সবাই।” ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট ফেসবুকে পোস্টে লিখেছিলেন তিনি। ড. আসিফ তার ‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২ : গণপরিষদের ভাবনা’ বইয়ের উৎসর্গে লিখেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”। প্রশ্ন হলো, আসিফ নজরুল কেন শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি বললেন, কী সেই ভিত্তি?

এটা অবিসংবাদিত সত্য, শেখ মুজিবের সেই অবিস্মরণীয় বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সর্বস্তরের বাঙালিদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যাঁর তর্জনী হেলনে বাংলার মানুষ জীবন দিতেও কার্পণ্য করেনি। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তাঁকে কেন্দ্র করে এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যদিও সেই স্বাধীনতা এখনো আমাদের কাছে কাঙিক্ষত হয়নি। আমাদের দুভার্গ্য, বঙ্গবন্ধু নাম নিলে অনেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজা শুরু করেন। বার বার বলি, বঙ্গবন্ধু কোনো দলের সম্পদ নয়, তিনি জাতীয় সম্পদ। 

শেখ মুজিব তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই অবিসংবাদিত ছিলেন না। কিংবা তাঁর ওপর এ অভিধা চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শুরুতে তিনি ছিলেন দুরন্ত কিশোর মুজিবুর। অনেকের কাছে মুজিব ভাই। তারপর মুজিবুর রহমান, অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তাঁর নাম ছিল শেখ সাহেব। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। এদেশের মানুষের আকাঙক্ষায় একাত্তরের পর তিনিই স্বাধীন দেশের স্থপতি। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই তাঁর অবস্থানের উত্তরণ।

তিন।
২০২১ সালে বিএনপি ৭ মার্চ পালন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা আর ৭ মার্চ পালন করেনি। ওই সময় আয়োজিত আলোচনা সভায় বিএনপি নেতারাই বলেছেন, ‘৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি দিন। সেই সময়ের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ যে আঙ্গিকে হোক, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে হোক, বিএনপির উচিত ছিল ৭ মার্চ পালনের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা। হতে পারতো ইতিহাসের পুরো সত্যটা বিএনপি গোপন করতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের ফ্রেমের বাইরে পড়ার সুযোগ হতো, তিনিসহ অন্য জাতীয় নেতারা অনেক বেশি নির্মোহ হতে পারতেন। কিন্তু সেদিকে বিএনপি যায়নি, হয়তো তাদেরও মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে সামনে আনা যাবে না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ তাদের বয়ানে নেওয়ার দায় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিরও আছে।

রাজনীতিতে ‘কোরিলেশন অব ফোর্সেস’ অর্থাৎ শক্তির ভারসাম্যের সঠিক হিসেব করতে পারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো দলই এই শক্তি ভারসাম্য বা শক্তি বিন্যাসের ব্ষিয়টি বিবেচনায় নিতে পারেনি। ফলে দেশের দক্ষিণমুখী ও সাম্প্রদায়িক দিক পরিবর্তন হয়েছে। অবজেকটলি বললে এ পরিবর্তনে তাদের ন্যারেটিভ বার বার বিরাজনীতিকরণের পথকে উন্মুক্ত করেছে। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরির চর্চা বেশ পুরোনো। এটা বাঙালির সহজিয়া প্রবণতা। ক্ষমতাসীন দলের মতের বিরুদ্ধে কেউ থাকলেই তার প্রতি ঘৃণা তৈরি ন্যায্য। মানুষের মনোজগতেও এটি গেঁথে দিতে সফল হয়েছে এ দেশের রাজনৈতিক ডিসকোর্স। তবে বয়ান যা–ই হোক না কেন, ইতিহাসের ‘ঢালাও ন্যারেটিভ’ সর্বদাই পরিত্যাজ্য। 

বিএনপি সংকোচনবিযুক্ত চর্চার ভেতর দিয়ে ইতিহাসকে নিরপেক্ষ করতে পারত। খোদ জিয়াউর রহমান যখন নিজেও একটি লেখায় ৭ মার্চের ভাষণকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এক লেখায় জিয়াউর রহমান নিজেই লেখেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল তার স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনকের স্বীকৃতি দিতে বিএনপির হীনমন্যতা থাকলেও ওই লেখায় জিয়া নিজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কীভাবে বিষোদগার করা হতো, তা-ও উঠে এসেছে জিয়ার লেখায়। প্রশ্ন হলো, তিনি কি পেরেছেন ইতিহাসকে রিসেট বাটনে টিপ দিতে? কিংবা ইতিহাসের অমোচনীয় সত্যকে খারিজ করে দিতে পেরেছেন? জিয়াউর রহমানের ওই লেখাটি বিএনপির ওয়েব সাইটে আছে। তারা সেটাকে সম্মানের সঙ্গে রেখেছে। 

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণের পরই দেশজুড়ে যেন স্বাধীনতার দাবিতে তীব্র হাওয়া লাগল। এর প্রমাণ অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে ৯ মার্চ পল্টনে জনসমুদ্রে মওলানা ভাসানীর দেওয়া ভাষণ। পল্টনে ভাষণ দিতে সরাসরি টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। বিকেলে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা রাখতে জনগণ ও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের অনুরোধ করেন মওলানা ভাসানী। তিনি বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন, “বাঙালিরা আপনারা সবাই শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রাখেন। শেখ মুজিবুরকে আমি ভালোভাবে চিনি। তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। শেখ মুজিবকে আমি আমার তিন পুত্রের চেয়েও ভালোবাসি। মুজিবুরের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবুরের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব।” (১০ মার্চ ১৯৭১, দৈনিক ইত্তেফাক)

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, “বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু এমনভাবে তিনি ডাক দেন যাতে করে ‘একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা’ করার অভিযোগ তুলে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করা ও তাকে আইনিভাবে আটকানো না যায়। যেন প্রস্তুতিগ্রহণের আগেই চূড়ান্ত আক্রমণের অজুহাত শত্রুরা না পায়। অনেক ধরনের চাপের মধ্যেই তাকে ৭ মার্চের বক্তৃতা দিতে হয়েছিল।” 

তিনি আরও বলেন, “অনেকেই প্রশ্ন করেন বঙ্গবন্ধু ওইদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না কেন। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে আমি মনে করি, স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ছিল ৭ মার্চের ভাষণ। সে ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ‘ঘোষণা’ না থাকলেও তাতে স্বাধীনতার ‘ডাক’ খুব স্পষ্টভাবে ছিল।” (বৈঠকি আলাপে কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, হাবীব ইমন, ২০১৭) 

আমরা যেন ভুলে না যাই, খন্দকার মুশতাক, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে ইতিহাস বর্ণনায় শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ বন্ধ হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে যেন কোনোভাবেই দৃশ্যপটে আনার সুযোগ আর না থাকে। আবার আওয়ামী লীগ আমলে বঙ্গবন্ধুর অপ্রয়োজনীয় পুনঃপুন উপস্থাপন আর অতিমূল্যায়নের ফলে তাকে টক্সিক করে ফেলা হয়েছিল। জনগণের ভেতর বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক মালিকানাবোধ সৃষ্টি করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে পুনঃপুন উপস্থাপন করেছেন। এতে বঙ্গবন্ধু মানুষের কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে গেছেন। প্রশ্ন হলো, সারা দেশে এত এত বঙ্গব্ন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বিতরণ করা হলো, সেগুলোর ফল কী হলো? মদ্দা কথা হলো, শেখ হাসিনা তার ন্যারেটিভগুলো চূড়ান্ত বিচারে দাঁড় করাতে পারেননি।

চার।
ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করতেন তারাই যেন বাংলাদেশ। এখনো কি সেই অবস্থা চলছে? চেহারায়ও বদলাল, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। একটা ন্যারেটিভকে ঘৃণা করতে গিয়ে নতুন আরেকটি ন্যারেটিভের বন্দোবস্ত হচ্ছে। এ ন্যারেটিভ কেবল সাধারণ গোছের ন্যারেটিভ হবে না, বিদ্বেষমূলক, একই সঙ্গে বোকা বানানোর ন্যারেটিভ, যেটা আরেকটি ফ্যাসিজমের পথ প্রশস্ত করছে। তবে, ৫ আগস্ট শিখিয়ে গেছে যে গায়ের জোরে টিকে থাকা যায় না। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলে গিয়েছেন ‘বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবা না’। যা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানেরও ঢাকার দেয়ালে শোভা পেয়েছে। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। সেই ৭ মার্চকে অগুরুত্বপূর্ণ ভাবার যুক্তি কী? এটা সত্য, তাঁর নামের অতিরিক্ত ব্যবহার সমর্থন করি না। আবার তাঁর নাম মুছে ফেলার মিশনও সমর্থন করি না। আওয়ামী লীগ সরকার করেছে বলে সবকিছু বাদ দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ সরকার তো আমাদের জাতীয় পতাকাও ঠিক করেছে। তাই বলে আমরা কি জাতীয় পতাকাও বাদ দেব? 

ইতিহাসের মরালিটি এটাই, ৭ মার্চ মুছতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ ‘ডিলিট’ হয়ে যায়। এটাই সিগনিফিকেন্ট। কিন্তু এটা ইতিহাসের ফ্যাসিবাদী বয়ান নয়। বঙ্গবন্ধুকে পাশ কাটিয়ে ইতিহাস কাটাছেঁড়া করা যায় না। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অপরাপর চরিত্রগুলোকেও পুনঃস্থাপন দরকার। সেটাই ইতিহাসের বড় দায়। বঙ্গবন্ধুকে বাইরে রেখে ইতিহাসের অন্যান্য চরিত্র নির্মাণ করা যায় না, আবার তাদের বাদ দিয়েও ইতিহাস সহি হবে না।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

Link copied!