• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্প ও অমিত শক্তির মানুষের অসহায়ত্ব


মনজুরুল হক
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩, ০১:৫৩ পিএম
তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্প ও অমিত শক্তির মানুষের অসহায়ত্ব

সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টার পর তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। যার কেন্দ্রস্থল ছিল পাজারসিক জেলায়। এরপরে গাজিয়ানটেপ প্রদেশে আরও দুটি ভূমিকম্প হয়, যার মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৪ এবং ৬ দশমিক ৫। একনাগাড়ে তিনবার তীব্র ভূমিকম্প আঘাত করার পর তুরস্ক ও সিরিয়ায় কার্যত এই শতাব্দীর ভয়াবহতম মানবিক দুর্যোগ নেমে এসেছে। আশপাশের অনেক দেশ থেকেই সাহায্যকারী ও উদ্ধারকারী দল এসেছে। খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা নিয়েও একাধিক দেশের টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে।

মঙ্গলবার সকালে এক দিনের ব্যবধানে দক্ষিণ তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে সর্বশেষ হিসাবে মৃতের সংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়েছে, এবং প্রায় ২১ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের পরিসংখ্যানে প্রায় ৬ হাজার ভবন ধ্বংস হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সাত দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। এটি ১৯৩৯ সালের এরজিনকান ভূমিকম্পের পর  দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বিপর্যয় বলে প্রেসিডেন্ট অভিহিত করেছেন।

একই সময়ে তুরস্কের প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ১ হাজার জনের বেশি নিহত এবং প্রায় ২ হাজার জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরের ইদলিব প্রদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ  হয়েছে এবং শত শত হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে অতিরিক্ত অ্যাম্বুলেন্স এবং মোবাইল ক্লিনিক পাঠানো হয়েছে। সিরিয়া সরকার জাতিসংঘের সদস্য ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করেছে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটিও রয়েছে। অনেক দেশ আঙ্কারা ও দামেস্ককে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে এবং উদ্ধার প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য দল পাঠিয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে বিপর্যয়ের ফলে কী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। একটি ক্লিপে দেখানো হয়েছে, সানলিউরফা প্রদেশের একটি ভবন প্রথম ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পর ধসে পড়ছে…। আরেকটি ক্লিপে দেখা যাচ্ছে শত শত লোকজনের সামনে একটি বহুতল বিল্ডিং মুহূর্তে ধসে মাটিতে মিশে গেছে! উদ্ধারকাজ চালানোর সময় দ্বিতীয় আঘাত আসায় অনেক উদ্ধারকর্মীও মারা গেছেন।

হঠাৎ এই অঞ্চলে ভূমিকম্প কেন? মূলত তুরস্ক ও সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তিনটি মহাদেশের চারটি প্লেটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এসব প্লেটের বিচ্যুতি খুব স্বাভাবিক ভূতাত্ত্বিক ঘটনা। এর আগেও এই সংযুক্ত প্লেটের অঞ্চলে একাধিক ভূমিকম্প হয়েছে। দেশ দুটি অ্যারাবিয়ান টেকটোনিক-প্লেটের ওপর অবস্থিত। ইন্ডিয়ান, আফ্রিকান ও অ্যারাবিয়ান এই তিনটি প্লেটই উত্তর দিকে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। উত্তরে রয়েছে ইউরেশিয়ান প্লেট। ফলত আন্তপ্লেট সংঘর্ষ অনিবার্য। তুরস্কের গাজিয়ানতেপ রাজ্যের নুরদাগি এলাকায় প্রায় ২৪ কিলোমিটার ভূগর্ভে এই ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উৎসস্থল বলে মনে করা হচ্ছে।

এর আগে এ অঞ্চলের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ছিল ১৯৩৯ সালে এরজিনকান ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পের পর প্রথম খিঁচুনিটি ছিল তুরস্কে আঘাত করা সবচেয়ে শক্তিশালী, মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ফলে আনুমানিক ৩২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, এবং প্রায় ১ লাখ মানুষ আহত হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কে আঘাত করা সবচেয়ে বিধ্বংসী ভূমিকম্পটি ১৯৯৯ সালে কোকাইলি প্রদেশে আঘাত হানে। তাতে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাঠিয়েছে রাশিয়া। তারা ত্রাণ সহায়তা, উদ্ধারকর্মী, উদ্ধার সরঞ্জামসহ এক শরও বেশি  ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। রাশিয়ার ত্বরিত সহায়তার জন্য ভ্লাদিমির পুতিনকে টেলিফোনে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এরদোয়ান।

উপদ্রুত অঞ্চলে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ইইউ, ইসরায়েল, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, গ্রিস, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ইরাক, সুইজারল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, মলদোভা, লেবানন, জর্ডান, ইরান, মিসর, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড ও চীন। 

সিরিয়ায় আঘাত হানার পর সেখানেও আফটারশক ঘটেছে। ফলে রেল চলাচল স্থগিত করে দিয়েছে দেশটি। সিরিয়ার তেল ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূকম্পনের কারণে গ্যাসক্ষেত্রগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আলেপ্পোর মধ্যযুগীয় দুর্গ, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটসহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান এবং নিদর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাচীন শহরের প্রধান জাদুঘরের সম্মুখভাগে ফাটল দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
২.
এই শতাব্দীর সবচেয়ে বিধ্বংসী ভূমিকম্পগুলো কতটা ভয়াবহ ছিল? ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের  একটার পর একটা ‘ঢেউ’ দেখা গেছে তুরস্ক-ইরান-সিরিয়ায়। 

২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ৯.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী ভূমিকম্প, যেটি ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম উপকূলের কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানে। ঝাঁকুনিটি একটি বিশাল ছিল, যা ৩০ মিটার উচ্চতার সুনামি ঘটিয়েছিল। ১৪টি দেশে ২ লাখ ২৭ হাজার মানুষ এই ভয়াবহ দুর্যোগে প্রাণ হারায়। এখন পর্যন্ত এটিই মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর প্রভাবে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ এবং ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের মতো উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে! ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি যুক্তরাষ্টের আলাস্কা পর্যন্ত ছোট ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটিয়েছিল।

ক্যারিবিয়ানে ধ্বংসযজ্ঞ

২০১০ সালের জানুয়ারিতে ক্যারিবিয়ান দ্বীপ দেশ হাইতিতে ৭.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। পোর্ট-অব প্রিন্সের রাজধানী থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে লিওগান শহরের কাছে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট আফটারশকগুলো প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে এবং এতে ৪.৫ বা তার বেশি মাত্রার কমপক্ষে ৫২টি ছোট ছোট কম্পন হয়েছিল। এই দুর্যোগে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হাইতিয়ান সরকারের পরিসংখ্যানে এই বিপর্যয়ে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার বাসস্থান এবং ৩০ হাজার বাণিজ্যিক ভবন ধ্বংস হয়েছিল। 

চেরনোবিলের পর সবচেয়ে খারাপ বিপর্যয় 

২০১১ সালের মার্চ মাসে জাপানের প্রায় ৭২ কিলোমিটার পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি উপকেন্দ্রে সমুদ্রের নিচের মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৯.১ মাত্রার এই ভূমিকম্প ২১ শতকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং ১৯০০ সালে আধুনিক রেকর্ড-কিপিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে রেকর্ড করা চতুর্থ বৃহত্তম ভূমিকম্প। ভূমিকম্পটি ১৯ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল এবং কয়েক লাখ লোককে সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে দিয়েছিল। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামি ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যাকে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের পর সবচেয়ে খারাপ পারমাণবিক বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই ভূমিকম্পে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৩৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের মতে এটিই ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দুর্যোগ।

ভয়াবহ সিচুয়ান ভূমিকম্প

সালের মে মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৮.০ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে রেকর্ড করা সবচেয়ে বড়সংখ্যক ভূ-ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছিল, যার মধ্যে প্রায় ২ লাখ ভূমিধস ঘটেছিল। এটি বেইজিং এবং সাংহাই, সেই সঙ্গে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামেও অনুভূত হয়েছিল।
এই বিপর্যয়ে ৮০ হাজারের বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল। প্রায় ৫০ লাখ লোককে গৃহহীন করেছিল। 

কাশ্মীর ভূমিকম্প

অক্টোবর ২০০৫ সালে ৭.৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর অঞ্চলের পশ্চিম অংশে, সেই সঙ্গে ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের কিছু এলাকায় আঘাত হানে। এই বিপর্যয়ে ৮৬ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে।

ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠের একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। কাকতালীয়ভাবে অনেকের পূর্বাভাস ফলেও যায়। তারপরও কখনোই সাইক্লোনের মতো নিশ্চিতভাবে বলা যায় না অমুক সময়ে ভূমিকম্প হতে পারে। সে কারণে বিজ্ঞানীরা টেকটোনিক প্লেটের মতো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রয়োগ করেও যখন পূর্বাভাস দিতে পারেন না, তখন এই দুর্যোগ ‘যেকোনো সময় আসতে পারে’ তত্ত্বটাই মানুষের অবলম্বন।

লেখক : সাংবাদিক।

Link copied!