• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২, ১৫ জ্বিলকদ, ১৪৪৪

সাকিবদের জন্মই হয় পারফর্ম করার জন্য


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৩, ০২:৪৯ পিএম
সাকিবদের জন্মই হয় পারফর্ম করার জন্য

টেস্ট ক্রিকেটের মতো খেলে সফল হতে হলে বছরের ৩৬৬ দিনই ক্রিকেটীয় ধর্ম মেনে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়। হ্যাঁ, ৩৬৫ নয়। ৩৬৬ দিনই। কারণ, চার বছর পরপর হলেও লিপইয়ার বলে একটা বছর তো আসে। এই কথাগুলো লেখা একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে। একজন ক্রিকেটার চারপাশের এত কিছু সামাল দিয়ে বছরের পর বছর পারফর্ম করে যাচ্ছেন কীভাবে!
উত্তরটা খুব সহজ করে বলা যেতে পারে। তিনি সাকিব আল হাসান। তিনি জিনিয়াস। তিনি পারফরমার। ডেল কার্নেগির বই ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল’ বই তার পড়া কি না, জানি না। তবে শেষ অংশের সব শর্ত তিনি মানেন। আসলে ‘সাকিব আল হাসান বর্ন টু পারফর্ম।’ যেমন ভিভ রিচাডর্স, ইমরান খান, কপিল দেব। দলকে সব সময় জেতাতে না পারলেও নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে ম্যাচে একটা প্রভাব ঠিকই রেখে গেছেন। সাকিব আল হাসান এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা পারফরমার। এ নিয়ে আপনি তর্ক করতেই পারেন। কিন্তু দিন শেষে পরিসংখ্যান বলছে সাকিবই সেরা।


শুধু সেরা পারফরমার নন। সেরা ব্র্যান্ডও। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। বিদীর্ণ অর্থনীতি। দেশ যখন ইমেজ সংকটে পড়ে, তখন সব দেশই একটা ‘মুখ’ খোঁজে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল বহির্বিশ্বে নিজেদের তুলে ধরতে একটা মুখ। তারা পেয়ে যায় স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। ভারত যখন অর্থনীতির উদারীকরণের পথে হাঁটতে শুরু করেনি। পাকিস্তানের সঙ্গে তিন-তিনবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল সেই সময়, ’৭১ সালে তারা পেয়ে যায় সুনীল গাভাস্কার নামের একজনকে। পাকিস্তান পেয়ে যায় ইমরান খানকে। সেই সময়টা এখন অনেক পাল্টে গেছে। বাংলাদেশেও এখন অনেক মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ড ঢুকে পড়েছে। তারাও বিজ্ঞাপনের জন্য নায়ক খোঁজেন। তাদের সেই অন্বেষণে অনেক দিন ধরে গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে একটাই নাম—সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট, এন্ডোর্সমেন্ট, বিজ্ঞাপনের শুটিং, পরিবার, চারদিক থেকে ধেয়ে আসা বিতর্ক, এত কিছু তিনি সামাল দেন কীভাবে!


এর অনেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। শতশত ক্রিকেটার তাদের দেশের হয়ে খেলছেন। তাদের মুখও টিভি পর্দায় ভেসে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশে সাকিকের চেয়ে উজ্জ্বল এবং বিশ্ব  ক্রিকেটে উদ্দীপনা ছড়ান মুখ আর কে আছেন?


আবার সেই সাকিবকে নিয়ে মিডিয়া থেকে আমজনতার কত চর্চা! সাকিব ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন, কারও সঙ্গে তেমন হৃদ্যতা নেই। কখনো কখনো সৌজন্যতাও থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে সাকিব আল হাসানকে চিনি, অনূর্ধ্ব উনিশ দলে ডাক পাওয়ার পর থেকে। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণকে নিয়ে ‘ক্রিকেট অনলাইন’ নামে  এক ঘণ্টার একটা লাইভ শো করেছিলাম। তার জীবনে ওটাই ছিল প্রথম টেলিভিশন শো। সেদিন সেই তরুণকে এক মুহূর্তের জন্যও নার্ভাস মনে হয়নি! আঠারো বছর পরে এসেও মনে প্রশ্ন জাগে তিনি এত নিরুদ্বিগ্ন থাকেন কীভাবে! থাকেন কারণ সাকিব জানেন কখন সুইচ অন-অফ করতে হয়। যখন যে কাজটা করেন সেই সময় তার নিজস্ব বাবলের মধ্যে ঢুকে পড়েন। বাকি পৃথিবী ভুলে যান। পারফরমারদের এটাই বড় একটা গুণ।


সাকিব যখন বাইশ গজে নামেন তখন তিনি জানেন ওখানে তার কাজটা কী। ওর বাইরে বাকি পৃথিবীর কথা ভুলে যেতে পারেন! ব্যাট হাতে ক্রিজে তিনি যখন মিশেল স্টার্ক, আর্চার, ওকস, উড, শাহীন আফ্রিদি, সামিদের হাত থেকে গোলার মতো ধেয়ে আসা বলের সামনে বুক পেতে দেন, তখন তাকে ঘিরে দশজন। এগারোজনের সঙ্গে লড়াইটা তার একার। এখানে তিনি নিঃসঙ্গ! আবার সফল পারফরম্যান্সের পরও তিনি নির্বিকার। উচ্ছ্বাসহীন থাকতে পারেন! এম এস ধোনির সঙ্গে এই জায়গায় সাকিবের বড় একটা মিল। আসলে এরা পারফরমার। খেলার সময় নিজস্ব ক্রিকেটীয় বাবেলের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে পড়েন অন্য কিছু র্স্পশ করে না তাদের।


অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটার লাবুশেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কার সঙ্গে ব্যাট করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অস্ট্রেলিয়ার এই তারকা ব্যাটার নিরুত্তর থাকলেন। প্রশ্নকর্তা ধরে নিয়েছিলেন ওসমান খাজা কিংবা স্টিভ স্মিথের মধ্য থেকে একজনের নাম বলবেন। কারণ, ওই দুজনের সঙ্গেই তার বেশি বড় পার্টনারশিপ। কিন্তু কোনো নাম বললেন না লাবুশেন। পরে বলেছিলেন, ‘ওরা ব্যাট করার সময় একেবারে অন্য জগতে ঢুকে পড়েন!’ স্মিথ, খাজারা পারফরমার। ব্যাট করার সময় নিজস্ব বাবলের মধ্য ঢুকে পড়েন। তাদের সঙ্গে ব্যাট করতে কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন লাবুশেন? সাকিবের বেলাতেও তাই। নিজের পারফরম্যান্স বের করার জন্য নিজস্ব বাবলের মধ্যে চলে যান। যেটা অন্যদের পক্ষে বোঝা কঠিন। অ্যাডিলেডে সাকিবকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এত চাপ সামলান কীভাবে!’ খুব ছোট একটা উত্তর দিয়েছিলেন; আমি তো এত চাপ দেখি না! যখন যে কাজটা করি, তখন শুধু সেটার চাপই দেখি। তবে চাপটাকে চাপ হিসেবে নিই না আমি।’


পারফরমাররা এভাবেই সবকিছু সামাল দেন। নিজের গ্রেটনেস প্রমাণ করেন। দিন শেষে গ্রেট হিসেবেই সরে যান। আর মিডিয়া থেকে আমজনতা প্রতিনিয়ত তাদের পারফরম্যান্স, মাঠের বাইরের জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া করে! পারফরমাররা জানেন মিডিয়ার অভিনন্দনসূচক মন্তব্য, সমাদর তার ক্যারিয়ারে পূর্ণচন্দ্রের আলো দেবে না। আবার ব্যঙ্গ, সমালোচনা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও ঠেলে দিতে পারবে না। তার ক্যারিয়ারের দীপশিখা তার পারফরম্যান্স। সাকিবের মতো যাদের জন্ম পারফরম করার জন্য তারা জানেন, ক্রিকেট টিমগেম হলেও দিন শেষে খেলাটা একান্ত ব্যক্তিগত। ক্রিকেটের ধর্মই হলো সাফল্যের উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়েও নিজের সমস্যার সমাধান নিজেকেই করতে হয়। সমর্থকদের পাহাড়প্রমাণ চাপও তাকেই সামলাতে হয়। সেই মনস্তত্ত্ব কোনো বিজ্ঞাপনের ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না। শুধু পারফরম্যান্স দিয়েই বোঝানো সম্ভব।

 

লেখক: সাংবাদিক
 

Link copied!