• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দুরাশার জনতুষ্টির বাজেট, না জনতুষ্টির ঘ্রাণমিশ্রিত বাজেট


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২৩, ১১:৫২ এএম
দুরাশার জনতুষ্টির বাজেট, না জনতুষ্টির ঘ্রাণমিশ্রিত বাজেট

আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেট নানা দিক দিয়ে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আর এবারের ৫২তম বাজেটের মধ্যে টাকার অঙ্ক ও সময়ের বিস্তর হেরফের থাকলেও দুটি বাজেটের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন; অর্থাৎ বিপর্যস্ত সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে পুনরুদ্ধার করা। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য-বঞ্চনার মধ্যেই ২০২০ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও কোভিড-১৯ অতিমারির লকডাউন আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের এবারের বাজেটে নতুন দুটি অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ। অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় সরকারকে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে, যার প্রথম কিস্তি ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। এই ঋণের অনেক শর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো অন্যতম। সরকার ভর্তুকি কমাতে ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। সমন্বয়ের নামে কয়েক দফায় দাম বাড়িয়েছে বিদ্যুতের দাম। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। জনগণের পছন্দ না হলেও সরকারকে আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলো পেতে আগামীতে নতুন কর আরোপ, অন্যায্য কর ভ্যাটের সম্প্রসারণ, সুদের হার বাড়ানো, মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ আরও অনেক কথিত সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যা জনপ্রিয় না হওয়াটাই স্বাভাবিক। নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য-বিবৃতিতে যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তার মর্মার্থ করলে দেখা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার জনতুষ্টির ঘ্রাণমিশ্রিত ভোট টানার বাজেট এবার ঠিকই দেবে। তবে এবার প্রেক্ষাপট যেহেতু ভিন্ন, পরিস্থিতি যেহেতু তুলনামূলকভাবে অধিকতর সংকটময়; সেহেতু অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দিকেই তাদের বেশি মনোযোগ থাকবে। চলতি মাসে একনেক আগামী অর্থবছরের জন্য যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে, তাতে ফাস্ট ট্র্যাক বা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার তালিকার প্রকল্পে বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্পও অগ্রাধিকার পেয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ৯টি ভৌত অবকাঠামো। পরিকল্পনা কমিশন গত মার্চে এডিপির নীতিমালায় ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অগ্রাধিকারের পাশাপাশি ধীরগতির প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোর কথা বলেছে। খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি খাতে বিশেষ জোর দেওয়ার তাগিদ ঠিকই রয়েছে সেই নীতিমালায়, কিন্তু সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। দারিদ্র্য বিমোচনসংশ্লিষ্ট প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের সঙ্গে নির্বাচনী ভাবনার যে কিছুটা যোগসূত্র রয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। বড় বড় প্রকল্পে জোর দেওয়ার কথা বলার এসব অস্পষ্ট নীতিমালা আসলে শিলান্যাশ আর ভিত্তিপ্রস্তরের নহর বইয়ে দিয়ে জনগণকে জনমুখী বাজেটের গন্ধ বিলিয়ে ভোট করায়ত্তের চেষ্টা। কারণ, আমাদের বাজেটপ্রণেতারা বুঝে গেছেন, জনগণ শিলান্যাশেই খুশি। কারণ, তারা বিরোধী শক্তির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের বলি হতে চায় না। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি আর বাজার নিয়ন্ত্রকদের দৌরাত্ম্যে তারা অতিষ্ঠ, তার ওপর জ্বালাও-পোড়াও শুরু হলে তাদের যে আর বাঁচার উপায় থাকবে না।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশে বাজেট ঘনিয়ে এলেই জনগণের মধ্যে চাপা আতঙ্ক ভর করে। জিনিসপত্রের দাম এক-দু টাকা বাড়লে তারা নিশ্চিত ধরে নেন, ওই জিনিসের দাম বাড়বে। তারা এ-ও বোঝেন, কিছু কিছু জিনিসের দাম কমে, যা ধনীদের ব্যবহার্য। আর দেশে একবার দাম বাড়লে তা আর কমে না, এটাই স্বতঃসিদ্ধ রীতি হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, বছর দুয়েক ধরে দাম বাড়াতে মুনাফাজীবীদের আর জাতীয় বাজেট লাগে না, প্রতি মাসেই তারা নিয়ম করে দাম বাড়ান। একবার বাড়ান আমিষের ব্যবসায়ীরা। তারপর বাড়ান শর্করার ব্যবসায়ীরা। তারপর অন্যরা। সম্ভবত মুনাফাজীবী ব্যবসায়ী ও টাকার মালিকদের অ্যাডাম স্মিথের বহুলকথিত ধারণার মতো গোপন কোনো সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, জনগণেরও তো চাপ সহ্য করার সীমা আছে। কয়েক বছরের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে চাপে। মূল্যস্ফীতির হার এখন প্রায় দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা গত এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। সরকার চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকার জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশ অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে স্থানীয় মুদ্রা টাকার ধারাবাহিক পতন হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২ বিলিয়ন ডলার কমে ৩০ বিলিয়নে ঠেকেছে। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার পতন হয়েছে ২৪ শতাংশ। গত এপ্রিলে রপ্তানি আয়ও কমেছে ১৬ শতাংশের মতো। এই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমেছে একই হারে। বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণও কমে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে ধরে নিয়ে সরকার বাজেট দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপির সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে, তা ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ; যা সরকারের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম। সরকার তার লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আয়ও করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে এনবিআর সংগ্রহ করেছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩ মাসে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। প্রবাদ আছে, যার নয়ে হয় না, তার নব্বইতেও হয় না। মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, প্রবৃদ্ধি আর রাজস্ব আয়ের এমনতর তথ্য-উপাত্ত দেখে কেউ যদি বলেন, হিসাবরক্ষণে পটু সরকারি নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতিশাস্ত্রের গূঢ় অর্থ ও পরিবর্তনের খোঁজখবর রাখেন না, তাতে দোষের কিছু হবে না।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাদের সংখ্যা ৭০-৮০ শতাংশ তাদের আলোকিত-শক্তিশালী-টেকসই মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রূপান্তর করতে, বৈষম্য-অসমতা-বহুমুখী দারিদ্র্য সম্ভাব্য-সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে এবং পরজীবী-লুটেরা ধনিক শ্রেণির সম্পদের যৌক্তিক অংশ দরিদ্র-প্রান্তিক-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের দিকে প্রবাহিত করতে বিদ্যমান বাজেট কাঠামো আমাদের কোনো কাজে আসবে না। কারণ, আশির দশক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তবাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশ প্রবেশের পর আমাদের বাজেট ও নীতিনির্ধারণে চালকের আসনে বসে গেছে তথাকথিত দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীতাড়িত দাতাগোষ্ঠী। এদের বদৌলতে আমাদের বাজেটের বরাদ্দ খাতে আমূল পরিবর্তন ঘটছে। জনকল্যাণকামী খাতগুলোতে জনসংখ্যানুপাতিক প্রকৃত বরাদ্দ কেবলই কমছে। যদিও বা বরাদ্দ কিছুটা বাড়ছে, তা বাড়ছে অনুন্নয়নমূলক খাতে। এ কারণেই ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের উন্নয়ন বরাদ্দ ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও অনুন্নয়ন বরাদ্দ ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ উল্টে গিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে হয়েছে যথাক্রমে ৩৯ দশমিক ৩ ও ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ। ওপরে তুলে ধারা এত কিছুর পরও যারা জনতুষ্টি, জনকল্যাণ, জনমুখী, জনবান্ধবসহ ‘জন’সমৃদ্ধ নানা শব্দের যোগে বাজেটের স্বপ্ন এখনো দেখেছেন তাদের উদ্দেশ্যে আবারও বলি, যে জাতীয় সংসদে আপনার বার্ষিক বাজেট উপস্থাপিত ও অনুমোদিত হয়, সেই সংসদের ৬১ দশমিক ৭ শতাংশই পেশায় আপাদমস্তক ব্যবসায়ী। বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে অংশ নেওয়া ৩০০ আসনের মধ্যে জয়ী হয়ে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরা ছাড়াও ধনাঢ্য ব্যক্তি, সাবেক সরকারি আমলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরও জোরালো উপস্থিতি রয়েছে, যারা আবার ঘুরেফিরে সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। আর এ কারণেই ২০১২ থেকে ২০১৯ সময়কালে দেশের মোট শিল্প উৎপাদনে বৃহৎ আকারের প্রতিষ্ঠানের হিস্যা ৪৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৯ শতাংশে হয়েছে এবং একই সময়ে মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানের হিস্যা ২৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমে গেছে। অর্থাৎ এই সময়টিতে রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীরা চুনোপুঁটিদের খেয়ে ফেলেছেন। এই ৬৯ শতাংশ রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীর মাত্র ৩ হাজার মুনাফার ফ্যাক্টরির কাছে জাতীয় বাজেটের সব সুফল কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে এসে অশীতিপর মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিখ্যাত একটি উক্তি বাংলাদেশের জন্য বেশ প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, “আপনার চরিত্র কেমন, আপনি কী ধারণ করেন, তা আমাকে বলবেন না। আমাকে আপনার বাজেট দেখান। আমি আপনাকে বলে দেব, আপনার চরিত্র কী, কী ধারণ করেন।”

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি।

Link copied!