• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৭ জ্বিলকদ ১৪৪৫

সন্তানকে পরীক্ষায় ভালো করার জন্য চাপ দেবেন না


জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২২, ০১:৫৯ পিএম
সন্তানকে পরীক্ষায় ভালো করার জন্য চাপ দেবেন না

বর্তমানে দেশে শিক্ষার হার অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অভিভাবকদের প্রত্যাশাও। শিক্ষার্থীরা কতটা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছে, তার ওপর যতটা মনোযোগ পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থাকা উচিত, তার কিছুই লক্ষণীয় নয়। বরং পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাপকাঠি এখন পরীক্ষার ফল। সন্তান কতটা সার্থক এবং কতটা ব্যর্থ, তা মাপা হয় এই নিক্তিতে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি সন্তানের পরীক্ষার ফলের ওপরই তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে? সেই সঙ্গে পারিবারিক সম্মানও কি শুধু সন্তানের পরীক্ষার ফলের সঙ্গে জড়িত?

আমাদের পরিবার, তথা সমাজ যতটা এগিয়ে গেছে বলে মনে করি, আদৌ কি তা ঠিক? শিক্ষার হার বেড়েছে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে। কিন্তু বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ করলে সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়, শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষার কতটা ঘাটতি। প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করছেন। পিতামাতা বা অভিভাবকেরা সেই ডিগ্রিকেই জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি বলে গণ্য করছেন। সমাজের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, যে শিক্ষার্থীরা অধিকতর ভালো ফল অর্জন করবে, তারাই টিকে থাকবে। ফলে অভিভাবকদের মধ্যেও শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। যে বা যারা তাদের ডিগ্রি বা কাঙ্ক্ষিত ফল দিয়ে সামনের সারিতে থাকবেন, তারাই কেবল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। যারা পেছনের কাতারে থাকবেন, তারা যেন এ সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে উঠছেন।

এদিকে পরিবার এবং সমাজের এত চাপ সহ্য করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সব সময় সম্ভব হয়ে উঠছে না। তারা তখন পরিবার এবং সমাজের চাহিদা পূরণ করতে না পেরে হতাশায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে। পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, এসএসসি, এইচএসসি বা ভর্তিযুদ্ধ কিংবা চাকরির পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল না করার কারণে আত্মহত্যা করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন, তারা এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন মূলত আমাদের পরিবার, সমাজের ভুল চিন্তাধারার কারণে। কিছুদিন আগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।
সন্তানের পরীক্ষার ফলের ওপর তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না, এটা জোরালোভাবে বলা মুশকিল। কারণ আমরা জানি, স্বনামধন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো ফল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাদের অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, ভালো ফল জীবনের একটি অংশমাত্র, পুরো জীবন নয়। তাই শুধু একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, বুদ্ধির পরিমাপক হিসেবে ফলকে গুরুত্ব দেওয়া চলে না। এমন অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী-মনীষী ছিলেন বা আছেন, যারা স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি বা পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না। কিন্তু এই মনীষীরা তাদের জ্ঞান দিয়ে পুরো সমাজকে আলোকিত করেছেন। জাগিয়ে তুলেছেন মানব সম্প্রদায়কে। সমাজের কুসংস্কার, অন্ধত্ব দূর করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং আজও করে যাচ্ছেন। সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু তাই বলে সেই পরিবর্তনের জোয়ারে গা ভাসিয়ে পাল্লা দিয়ে নিজের সন্তানকে সম্মানের হাতিয়ার বানানো উচিত নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র্য গুণ আছে। কে কোন বিষয়ে পারদর্শী, সেদিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

অনেকেই মনে করেন, সন্তানের পরীক্ষার ফল ভালো না হলে সুধী মহল থেকে শুরু করে বন্ধু মহলে তার মাথা হেঁট হয়ে যাবে। সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। আর এ কারণে এক অন্ধ প্রতিযোগিতা চলছে আমাদের সমাজে। সন্তানকে যোগ্য এবং দক্ষ মানুষরূপে নয় বরং সন্তানের একাডেমিক ফল কতটা ভালো হলো, সেদিকেই সবার লক্ষ। আর এই সোনার হরিণ ধরতে আমাদের অভিভাবক সমাজ এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে প্রকৃত জ্ঞানের জগতে সন্তান থাকছে অন্ধ। বাস্তব জগতে এসে লড়তে তারা সাহস পাচ্ছে না। কিছু বই পড়ে উগরে দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করছে। আর এর ফলে আপাতদৃষ্টে তারা এগিয়ে গেলেও সুশিক্ষিত হয়ে উঠছে না।

সমাজের দিকে লক্ষ করলে আমরা অনুধাবন করতে পারব কী প্রচণ্ড পরিমাণে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারবারিক নিপীড়ন, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, সামাজিক অবক্ষয়ের সম্মুখীন জাতি। তবে শিক্ষা কোথায়? মানুষ হিসেবে মানুষের মূল্য কী? কেনই-বা সমাজে এত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে?

এর কারণ হিসেবে প্রথমেই বলা চলে আমরা এখন মানবিক বোধসম্পন্ন হওয়ার কথা ভাবতেও ভুলে গেছি। আগে যেমন স্কুল, কলেজ এবং পরিবারগুলোতে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হতো, এখন তা হয় না। এখন সবাই এক মহত্তম জীবন খুঁজে চলে। আর তা হচ্ছে কতটা ভালো ফল করবেন। কীভাবে বহুমূল্যের চাকরিটি হাতিয়ে নিতে পারবেন। এর জন্য যত ধরনের তদবির করা লাগে, তা অভিভাবক পর্যায় থেকে আমাদের সমাজ করে থাকে। কিন্তু একটিবারের জন্য অভিভাবকরা ভাবেন না তার সন্তান এই দৌড়ে কতটা মানুষ হয়ে উঠছে!

একটা সময় আমাদের পূর্বসূরিরা যৌথ পরিবারে বাস করতেন। তাদের মধ্যে ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মমতা। কিন্তু এখন সবাই একক পরিবারের প্রতি ঝুঁকেছে। কিছুটা নগরায়নের ফল আর বেশির ভাগই সদিচ্ছার অভাব। নীতিনৈতিকতা, শ্রদ্ধাবোধ যেন এখন আকাশের চাঁদের মতোই দূর বস্তু। গভীরভাবে ভেবে দেখুন সমাজ কিন্তু তার আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে, পিতামাতা তার সন্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান হিসেবে চাচ্ছে সে বড় হোক। অনেক টাকা এবং নাম কামাক। তা না হলে সমাজে মুখ দেখানো দায়! কিন্তু এই পিতামাতাই বৃদ্ধ বয়সে স্বপ্নের রাজপুত্র বা কন্যার কাছ থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন। আশ্রয় হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে!

এসব কিছুর জন্য দায়ী প্রথমত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে দক্ষ, যোগ্য মানুষের চেয়ে উগরে দেওয়া সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন বেশি। আর এই মূল্যায়নের ফল ভয়াবহ। ডাক্তারি পাস করে একজন ডাক্তার তার সেবাধর্ম ভুলে হয়ে উঠছে কসাইসম। শিক্ষাক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা আরও বেশি। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে নামমাত্র মূল্য শিক্ষা কেনার ব্যবস্থা চলছে। বেসরকারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার নামে চলছে প্রহসন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবার মধ্যে ঔদাসীন্য! এর নেপথ্য কারণ শুধু একটাই অভিভাবকদের একমাত্র ভালো ফলের আশা। এই আশায় তারা এতটাই মোহাবিষ্ট যে সন্তানকে মানুষ হিসেবে নয়, একটা টাকার মেশিনে রূপান্তরিত করতে চান। এর জন্য ভালো কোচিং, ভালো স্কুল, ভালো পরিবেশ যতটা সাধ্য তার বেশিই দিতে চেষ্টা করেন অভিভাবকেরা। সেই সঙ্গে যদি তারা শুধু ফলাফলকে গুরুত্ব না দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠাকে গুরুত্ব দেন, তবে হয়তো জাতির দৈন্যদশা কমবে।

শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি এর পাশাপাশি আমাদের পরিবার এবং সমাজে গজিয়ে ওঠা মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে আমাদের সন্তানেরা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার দীক্ষা গ্রহণ করবে। পরিবার, সমাজকে বিশ্বাস করতে হবে সন্তানের পরীক্ষার ফল কখনোই পারিবারিক সম্মান আনয়ন করতে পারে না। বরং সন্তান কতটা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠল, তা অনেক বেশি অর্থ বহন করে।

তাই মানবিক, সৎ, যোগ্য, দক্ষ, বিবেক ও মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানবসন্তান গড়ে তুলতে প্রকৃত শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। একমাত্র ভালো ফলই যেন কোনো পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজের কাম্য না হয়৷ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক আমাদের সন্তানেরা—এই হোক ব্রত।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।

Link copied!