• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৬

শেষ পর্যন্ত জনগণই জিম্মি


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২১, ০১:৩৮ পিএম
শেষ পর্যন্ত জনগণই জিম্মি

বাংলাদেশের মানুষ যেন ক্রমেই এক বিশালাকার নিষ্পেষণের যন্ত্রের ভেতর ঢুকে পড়েছে। অথচ নাগরিকদের কাছে রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল এক স্বস্তিদানকারী আশ্রয়ের নাম। এখানে খেয়ালখুশিমতো বাড়ে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য, যখন-তখন ডাকা হয় পরিবহন ধর্মঘট, ইচ্ছে হলেই চাপিয়ে দেওয়া হয় নতুন নিয়ম ও কালাকানুন। ক্ষমতাবান, ধনবান ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর বিপুল লোভ-লালসা যখন সর্বাধিকার পেতে থাকে, তখন এমনটাই হয়। বলা হচ্ছে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে, এটি সুখবর, কিন্তু সেই আয়ের সমবণ্টন হচ্ছে কি না, তার খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ঝলমলে রঙিন প্রদীপের নিচে কতটা ঘুটঘুটে বিস্তৃত অন্ধকার!

এখানে সব গোষ্ঠীই জিম্মি করতে চায় জনগণকে। দেখবেন যারা জোট বেঁধে তরিতরকারির দাম বাড়ায়, তারা যেমন জিম্মি করে, আবার গণপরিবহন যাদের হাতে, তারাও সেই জনগণকেই জিম্মি করে। সিটিং ও লোকাল বাসের মধ্যে এখন আর কোনো পার্থক্য নেই, বাড়তি ভাড়া এমনিতেই দিচ্ছিল যাত্রীরা, তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে গ্যাসে চলা গাড়ির ভাড়াও বেড়ে গেছে। মানুষ ঝগড়া করছে, প্রতিবাদ করছে, কিন্তু এটা প্রথম কয়েক দিন, এরপর একটা সময় গা-সওয়া হয়ে যাবে, কারণ তারা জিম্মি।

এক মহা অরাজকতার ভেতর দিয়ে জনগণ দিনাতিপাত করছে। গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম, তেলের দাম, খাদ্যদ্রব্যের দাম—সবই যেন একটির সঙ্গে অন্যটি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, কোনো লাগাম নেই, আগাম অবগত করার পরোয়াও করছে না কেউ। বাড়াতে হবে, বাড়িয়ে দাও। বাকিটুকু আমজনতা বুঝবে। জনগণ মুখে রক্ত উঠে মরলেও কারও কিচ্ছু যায় আসে না। তো জীবন চালাতে যদি মুখে রক্ত উঠতে থাকে, বলার অপেক্ষা রাখে না সেই জাতি দুর্নীতিতে জড়াবেই। সুনীতিকে পায়ে মাড়িয়ে সে দুর্নীতিতেই চ্যাম্পিয়ন হবে। কারণ, বৈধ উপায়ে সাধারণ মানুষ যা উপার্জন করে, তা চলতি বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শহরে পরিবার নিয়ে মোটামুটি একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে গেলে, তিন বেলা ন্যূনতম পুষ্টির চাহিদা ও সন্তানদের শিক্ষা দিতে গেলে একজন মধ্যবিত্ত জানে শরীরের রক্ত কতটুকু পানি করতে হয়। আর অসুস্থ হলে একমাত্র খোদা মালুম কত টাকা কোন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। টাকা খরচ করেও যদি ভালো চিকিৎসা পাওয়া যেত! এ দেশের চিকিৎসা নিয়ে জনগণ যে সন্তুষ্ট নয়, তার বড় প্রমাণ প্রত্যেকেই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কলকাতা, বেঙ্গালুরু থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর অথবা লন্ডন পাড়ি জমায় শুধু সঠিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য। এ দেশে বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নেয় গরিব, অসহায় ও নিরুপায় মানুষ। সরকারি হাসপাতালে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায় কি হতশ্রী আমাদের স্বাস্থ্য খাতের। আমাদের অনেক বড় বড় সেতু, উড়ালসড়ক, টানেল ইত্যাদি দরকার, সন্দেহ নেই, কিন্তু ভালো মানের বড় বড় হাসপাতালের চেয়ে ওসব কি বেশি জরুরি?

করোনা মহামারির কারণে শহরে কিছুটা বাড়িভাড়া কমেছে। কারণ, অনেকেই রাজধানীর জীবনমানের যে খরচ, তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সপরিবারে স্থায়ীভাবেই চলে গেছেন গ্রামের বাড়ি। কর্মস্থলে অনেকে ছাঁটাইয়ের ভেতর পড়েছেন, অনেকের বেতন হয়েছে অর্ধেক, কারও বেতন হয়েছে বকেয়া। ঢাকার বাড়িওয়ালা, বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত বাড়িওয়ালা, তারাও বিপদে আছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, একটি ভবনের বাড়ি ভাড়াই কারও কারও একমাত্র সম্বল। ভাড়াটে না থাকায় তারাও কিছুটা ছাড় দিয়েছেন ভাড়ায়। তাই কিছুটা বুকে বল ফিরে পায় ঢাকার ভাড়াটে মধ্যবিত্ত। তবে অপর দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীন পারদের মতো ওপরে উঠতে থাকায় সুখে নেই তারা। চাল-ডাল-তেল-নুন-চিনি নিয়ে প্রতিদিনই মধ্যবিত্ত হয় দোকানে গিয়ে দর-কষাকষি করে, নয় প্রয়োজনের তুলনায় কম কেনে, অথবা তালিকা থেকে বাদ দিতে থাকে দু-একটি করে পণ্য। মাছ-মাংসের বাজারেও একই চিত্র। একটি ডিমের দাম পড়ছে দশ টাকা! শীত মৌসুমে সবজির প্রাচুর্য হয়, তাই স্বভাবতই বাজারে সেসবের দাম কমার কথা, কিন্তু তা কি কমেছে? সেগুলোর গায়েও আগুন লেগে আছে। তো লোকে খাবে কী?

মানুষ তো শুধু পেটেভাতে বাঁচে না। তার সংস্কৃতির দরকার হয়, পড়ালেখার দরকার হয়। সাংস্কৃতিক মানের অবনমন দেখতে পাবেন গণমাধ্যমে প্রচারিত কন্টেন্ট আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। তার চেয়েও নাজুক অবস্থার ভেতর আছে শিক্ষা। শিক্ষার জন্য অভিভাবকেরা খরচ করছেন ঠিকই, কিন্তু তার মানও অত্যন্ত নিম্নগামী। নয়-দশ বছর পড়ালেখা করেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী কেন বাংলা ও ইংরেজি শুদ্ধ করে লিখতে বা পড়তে পারে না? তার মানে আখেরে লোকসান হচ্ছে সেই জনগণেরই। গত প্রায় দুই বছর তো মহামারির জন্য ক্লাস বন্ধ ছিল, এখন যা-ও শুরু হয়েছে, তা-ও অতি সীমিত আকারে, একেবারে না শুরু হওয়ার মতোই। আর প্রাক্‌-প্রাথমিক তো এখনো খোলার কথা কেউ ভেবেই ওঠেনি। বাচ্চারা ঘরের ভেতরেই বন্দী জীবন কাটাচ্ছে ক্লাসরুম ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বঞ্চিত হয়ে। অনলাইনের ক্লাস কখনোই ত্রিমাত্রিক দুনিয়ার বিকল্প হতে পারে না, অন্তত প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য তো নয়ই।

শিক্ষা বলুন, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন, খাবারদাবার বা বাজারব্যবস্থা বলুন, আসলে সব ক্ষেত্রেই অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত ও অনুন্নত অবস্থা দৃশ্যমান, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আমাদের ঘটবে, তবে নিকট ভবিষ্যতে তা হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র পাল্টাতে আমার ধারণা দুই থেকে তিনশ বছর সময় লাগবে। তত দিনে বুড়িগঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়াবে।

 

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংবাদ প্রকাশ

Link copied!