• ঢাকা
  • শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩০, ২১ রমজান ১৪৪৬

বাংলাদেশের শকুনেরা ধ্বংস হোক


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২১, ০৭:১৯ পিএম
বাংলাদেশের শকুনেরা ধ্বংস হোক

প্রতি বছর এই বাংলায় শরৎ আসে উৎসবের বারতা নিয়ে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা হয় শরৎকালে। আর এই পূজাকে ঘিরে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। পূজার আনুষ্ঠানিকতাটুকু বাদ দিলে শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতি বছরই শারদীয় দুর্গোৎসব আসে শঙ্কা নিয়ে। দুর্গোৎসব শুরুর আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে মূর্তি ভাঙার খবর আসে। এবার তুলনামূলকভাবে অনেক স্বস্তি নিয়েই শুরু হয়েছিল শারদীয় দুর্গোৎসব। কিন্তু সকল স্বস্তি কেড়ে নিল শান্তি আর সমৃদ্ধির শহর কুমিল্লার একটি ঘটনা। কুমিল্লার সেই ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করেছে। শুরুর স্বস্তি পরে রূপ নেয় আতঙ্কে। মন্দির ভেঙে দেওয়ায় দেশের অনেক জায়গায় এবার দেবী বিসর্জন হয়নি। যেখানে বিসর্জন হয়েছে, সেখানেও বিসর্জনের বিষাদের সাথে মিশে ছিল ভয়াবহ আতঙ্ক, আর নিরাপত্তহীনতা।

কুমিল্লার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের অবমাননা যে কোনো মুসলমানের হৃদয়ে আঘাত করবে, তারা ক্ষুব্ধ হবে, প্রতিবাদ করবে, দায়ীদের শাস্তি চাইবে। কিন্তু কে কোরআন অবমাননা করেছে, তা না জেনেই ঢালাওভাবে হিন্দু মন্দির ভাঙচুর, প্রতিমায় আগুন দেওয়া, হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো, লুটপাট, হিন্দু নারীদের শ্লীলতাহানি কোনো ভালো মুসলমানদের কাজ হতে পারে না। শান্তির ধর্ম ইসলাম যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে এভাবে মন্দির আর হিন্দুদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালিয়ে কোনোভাবেই ইসলামকে রক্ষা করা হয়নি। যারা এই হামলা চালিয়েছে, তারা ইসলাম ধর্মেরই অবমাননা করেছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এই বাংলার মূল চেতনা, আদি সুর। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, বাংলাদেশ যেন সেই চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে পূজার সময় ‘ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার’ এই শিরোনামে আমার একটি লেখা ফেসবুকে শেয়ার করার পর তার নিচে যে মন্তব্য এসেছে, তা আমাকে শঙ্কিত করেছে। ভেবে আতঙ্কিত হই, সাম্প্রদায়িকতার শিকড় অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছে। অনেকেই উৎসব সবার, এটা প্রমাণ করতে ঈদে ঈদগাহে বা কোরবানির ঈদে হিন্দুদের গরুর মাংসের দাওয়াত দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যারা গরুর মাংস খাওয়াকে ধর্মের মানদণ্ড বিবেচনা করে, তাদের মাথাভর্তি সাম্প্রদায়িকতার আবর্জনা। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ কোনো সাম্প্রদায়িক লোক এই স্লোগানের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবে না। শারদীয় দুর্গোৎসবের দুইটা অংশ। একটা দেবীপূজা, যেটা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পালন করেন। কিন্তু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে মেলা বসে, উৎসবের আবহ তৈরি হয়, তা সর্বজনীন। সব ধর্মের মানুষ এই উৎসবে অংশ নেয়। কোনো মুসলমান কখনো পূজামণ্ডপে গিয়ে পূজা দেয় না। তেমনি ঈদের নামাজ এবং কোরবানি একান্তই মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি। নামাজ এবং কোরবানির পর যে উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পরে আকাশে-বাতাসে, তাতে সবার সমান ভাগ। সব ঈদেই হিন্দু বন্ধুরা আমার বাসায় আসে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে গরুর মাংসের দাওয়াত দেওয়া তাকে অপমান করাই শুধু নয়, নিজের ধর্মকেই ছোট করা হয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, এটাকে গরুর মাংস খাওয়ার মতো ছোট বিষয় দিয়ে মাপা যায় না। হিন্দু বন্ধুদের আপ্যায়ন করার জন্য আমার বাসায় গরুর মাংস ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকে। আমরা যেমন পূজায় নাড়ু খাই, তারাও ঈদে সেমাই-পায়েশ খায়। আমাকে যদি কেউ শূকরের মাংস খাওয়ার দাওয়াত দেয়, আমি যতটা অপমানিত বোধ করবো, একজন হিন্দুকে গরুর মাংসের দাওয়াত দেওয়ার কথা ভাবাটা ততটাই অপমানের। বড়দিনে চার্চে প্রার্থনার অংশটুকু খ্রিষ্টানদের। কিন্তু সব ধর্মের শিশুরাই সান্তাক্লজের উপহার পেতে ভালোবাসে। বুদ্ধপূর্ণিমার পূজার অংশটুকু বৌদ্ধদের। কিন্তু ফানুস ওড়ানোর উৎসবে কে না অংশ নিতে চায়? আপনি যদি ভালো মুসলমান হন, ভালো হিন্দু হন, ভালো খ্রিষ্টান হন, ভালো বৌদ্ধ হন— তাহলে অবশ্যই সবার উৎসব-আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্ম কখনোই অন্য কোনো ধর্মের মানুষের ধর্মপালনে বাধা দেয় না। বরং অন্য ধর্মের মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ধর্মপালন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও মুসলমানদেরই। ভালো মুসলমানরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেনও। এবারও কুমিল্লার ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির পাহারা দিয়েছেন মুসলমান যুবকরা। পাশাপাশি মসজিদ-মন্দির কিন্তু বাংলাদেশের অনেক জায়গায় আছে। আজান এবং নামাজের সময় মন্দিরের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তাতে কিন্তু কারো কোনো অসুবিধা হয় না। এবার বিসর্জন ছিল শুক্রবারে। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা পূজার আগেই এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন, জুমার নামাজের সময় যেন পূজামণ্ডপে কোনো কর্মসূচি রাখা না হয়। জুমার নামাজ এবং বিসর্জন নিয়ে কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যাটা বাঁধিয়েছে ধর্মান্ধরা।

একটা রাষ্ট্রের সৌন্দর্য্য তার বৈচিত্র্যে। নানা ধর্ম, বর্ণ, জাতির মানুষ মিলেমিশে থাকবে— এটাই দেশের শক্তি। বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত চেতনাও এটাই। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বারবার বাংলাদেশকে হারিয়ে দিতে চায়। যতই সম্প্রীতির কথা বলি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভালো নেই। ১৯৪৭ সালেও এই অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল ৩৩ ভাগ। কমতে কমতে সেটা এখন ৮ ভাগে দাঁড়িয়েছে। বারবার নির্যাতনে-নিষ্পেষণে সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে যায়। আর আমরা তখন গালি দিই, আগেই জানতাম, হিন্দুদের এক পা ইন্ডিয়ায় থাকে। কিন্তু একজন মানুষ কখনোই তার শিকড় ছাড়তে চায় না। বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষটিও তার ফেলে যাওয়া বাড়ির শিউলি গাছটির জন্য চোখের জল ফেলেন। সংখ্যালঘুদের ওপর বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই নির্যাতনে ধর্মকে সামনে আনা হয় বটে। তবে এটা যতটা না ধর্মীয়, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক, জমি দখলের কৌশল। ভয় দেখিয়ে কোনো হিন্দুকে দেশছাড়া করতে পারলেই তার সম্পত্তি লুটে নেওয়া যায়।

একটি দেশের সংখ্যালঘুরা যতটা নিশ্চিন্তে ধর্মপালন করতে পারবেন, জীবনযাপন করতে পারবেন— সেই দেশের সংখ্যাগুরুরা ততটাই ভালো। ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংখ্যাগুরু মানুষের। সংখ্যালঘুরা এমনিতেই দুর্বল। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে। এই যে কুমিল্লার ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের প্রতিবাদ করতে হবে শুভবুদ্ধির সব মানুষকে। এবার শারদীয় দুর্গোৎসব যেভাবে আনন্দ থেকে বিষাদের চাদরে ঢেকে গেছে, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে তাতে আমি লজ্জিত। পূজা করতে না পারার, সিঁদূর খেলা খেলতে না পারার, বিসজর্ন দিতে না পারার, নিজের সম্পদ-সম্ভ্রম রক্ষা করতে না পারার যে বেদনা হিন্দু বন্ধুদের বুকে আছে, তা শতগুণ হয়ে বাজছে আমাদের হৃদয়েও।

শকুন আর তার বাচ্চার গল্পটা আপনাদের সবার জানা। এক শকুনের বাচ্চা তার বাপের কাছে বায়না ধরলো, ‘বাবা, আমি মানুষের মাংস খাব, এনে দাও না প্লিজ।’ শকুন বললো, ‘ঠিক আছে বেটা, সন্ধ্যায় এনে দেব৷’ শকুন উড়ে গেল আর আসার সময় শূকরের মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বললো, ‘বাবা, এটা তো শূকরের মাংস, আমি মানুষের মাংস খেতে চাই।’ বাপ বললো, ‘ঠিক আছে বেটা, এনে দেব।‘ শকুনটা উড়ে গেল আর আসার সময় এক মরা গরুর মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বললো, ‘এটা তো গরুর মাংস, মানুষের মাংস কোথায়?’  তখন শকুনটা উড়ে গিয়ে, শূকরের মাংস একটা মসজিদের পাশে আর গরুর মাংস একটা মন্দিরের পাশে ফেলে দিয়ে চলে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েকশ মানুষের লাশ পড়ে গেল, আর বাপ-বেটায় মিলে খুব তৃপ্তিতে মানুষের মাংস খেলো।

বাংলাদেশেও এমন কিছু শকুন আছে, যারা ধর্মের নামে সহিংসতা ছড়ায়, ঘৃণা ছড়ায়। এই শকুনেরা কখনো রামুতে, কখনো নাসিরনগরে, কখনো ভোলায়, কখনো যশোরে, কখনো কুমিল্লায় উড়ে উড়ে যায়। সব ষড়যন্ত্রের গোড়া একটাই। এই শকুনদের ধ্বংস করতে হবে। কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার কাজটি যে কোনো হিন্দু করেনি, সেট বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। দুর্গাপূজা হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। মণ্ডপ বানানো, প্রতিমা বানানোতে এর প্রস্তুতিটাও সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাপেক্ষ। কোনো হিন্দু কখনোই কোরআন অবমাননা করে তাদের উৎসব পণ্ড করতে চাইবে না। তারচেয়ে বড় কথা, দিনের পর দিন নির্যাতিত হওয়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর সে সাহসও নেই। আর ব্যাপারটা সাহসের নয়। ব্যাপারটা বিশ্বাসের। আর কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানও কোনোভাবেই কোরআন অবমাননা করবে না। এটা যারা করেছে তারা শকুন। কিন্তু এই শকুনদের ফাঁদে পা দিয়ে মুসলমানদের কেউ কেউ যখন মন্দির ভাঙে, প্রতিমা ভাঙে, হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালায়— তখন ইসলামকেই অবমাননা করা হয়। কানে হাত না দিয়ে চিলের পিছনে দৌড়াতে থাকে ধর্মান্ধরা। কুমিল্লায় যেই কোরআন অবমাননা করুক, সরকার অবশ্যই তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিন্তু কুমিল্লার ঘটনার দায়ে কেন খাগড়াছড়ির হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে হামলা চালানো হবে? তার অপরাধটা কোথায়? ধর্মীয় পরিচয় কখনোই একজন মানুষের অপরাধ হতে পারে না। আমি কখনো মানুষকে ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, জাতি দিয়ে বিবেচনা করি না। মানুষের পরিচয় মানুষ। এই দেশ যতটা নুরুল ইসলামের, ততটাই নীতিশ সাহার। যেদিন আমার সংখ্যালঘু বন্ধুটি নিশ্চিন্তে ধর্মপালন করতে পারবে, জীবনযাপন করতে পারবে, সেদিন মুসলমান হিসেবে আমার মাথা উঁচু হবে। কোনো ধর্মেই হিংসার স্থান নেই, ঘৃণার স্থান নেই।

এই শকুনদের দমন করার কার্যকর ঔষধটি বলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দায়ীদের চিহ্নিত করে এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ কখনো এ ধরনের কাজ করার সাহস না পায়। এটাই করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি, রামু-নাসিরনগরের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এখনও হয়নি। বরং নাসিরনগরের ঘটনায় অভিযুক্তদের কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। যদিও পরে তা বাতিল করা হয়েছিল। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখতে চাই। কুমিল্লার ঘটনা তো বটেই রামু-নাসিরনগরসহ সকল ঘটনায় দায়ীরা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ ধর্ম অবমাননা বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টির সাহস না পায়।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!