আমার বড় হওয়া নোয়াখালী শহরে, মাস্টারপাড়ায়। আমাদের আশেপাশে যারা প্রতিবেশী ছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন ধর্মের দিক দিয়ে হিন্দু। কিন্তু উনারা ছিলেন আমার প্রণম্য মানুষ। তাঁরাই আমার মাসি, আমার মামা, আমার ঠাকুমা, আমার দিদি। আমরা খেলতাম আমাদের এই মামা, মাসিদের সঙ্গে, দিদিদের সঙ্গে। উনারা উনাদের বাচ্চাদেরকে যেভাবে আগলে রাখতেন, ঠিক একইভাবে আমাদেরও আগলে রাখতেন। আদর করতেন, ভুল করলে আদর করেই বকা দিতেন। স্কুলে যাওয়ার আগে আমাদের সময় কাটতো উনাদের বাসায়, স্কুল থেকে এসে খেলতাম উনাদের বাসায়। গোল হয়ে ভিসিআরে সিনেমা দেখতাম। এর মাঝে খাওয়ার সময় হলে খাওয়া দাওয়া করতাম উনাদের বাসায়। শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলতাম সন্ধ্যায় উনাদের বাসায়।
পূজায় আমাদের জন্য সন্দেশ তোলা থাকতো। এমনকি উনারা যখন বাজি-পটকা কিনতেন, সেটাও আমাদের জন্য কিনতেন। কতো রকমের বাজি! আমার আম্মু ছিলেন উনাদের কারো আপা, কারো-বা মাসি, কারো-বা মেয়ে। আর আমার আব্বু ছিলেন আমাদের এলাকার জামাই!
আমাদের ঈদের সময় সব বাচ্চা একসঙ্গে দলবেঁধে বাসায় এসে সেমাই, জর্দা খেয়ে যেত। আমার ছোটবেলায় আমার মা-বাবাকে চিন্তা করা লাগেনি আমাদেরকে নিয়ে।কারণ জানতেন আমাদের এই মামা-মাসিরাই দেখে রাখবেন। কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তো নাই! রাস্তায় হিন্দু-মুসলিম সবাই এক সঙ্গে গল্প করতে করতে বাজার করতে গিয়েছেন। দাদা-ভাই ছাড়া কারো মুখে কখনো কোনো সম্বোধন ছিল না।
আমাদের কাছে আলাদা কেউ ছিল না। ছিল সবসময়ের আত্মীয়। ধর্মের কোনো ঘেরাটোপ কখনো আমাদের মধ্যে ছিল না।
হিন্দুদের পূজা কিংবা মুসলমানদের ঈদ, তাতে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। কে হিন্দু, কে মুসলমান, তার কোনো প্রশ্নই ছিল না। আজ বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, ওই যে পূজা দর্শন, প্রতিমা দর্শন, বিসর্জনের কোনো আয়োজন বা অংশে পুলিশ কিংবা আনসারকে দেখা যেত না। ভাঙচুর জাতীয় কোনো ঘটনাও ঘটতো না৷ এখন ঈদের জামাতেও ব্যাপক পুলিশের ব্যবস্থা নিতে হয়, যা আগে ছিল না। এটা কি মানুষের হাল নাকি ধর্মের হাল, কী দাঁড়িয়েছে তাহলে?
নোয়াখালী যাই না, মাঝেমধ্যে গেলেও সেটা হুট করে যাওয়া। আজকে অনেক বছর, সবার সঙ্গে যা একটু যোগাযোগ, তা ফেসবুকের মাধ্যমে। এত বছর পরেও যখন মেসেঞ্জারে মাসি বা মামা বলে একটা ছোট মেসেজ দিয়ে বসি। তাঁরা যেন ঠিক সেই ছোটবেলার মামা হয়ে যান। আঙুল ধরে হাঁটা সেই মাসি হয়ে যান। স্নেহ সুলভ বকা দিয়ে বলেন, বেঁচে থাকতে একবার এসে দেখা যা!
ঠিক এই মুহূর্তে নোয়াখালীর অবস্থা ভালো না। আমি জানি না আমার খোকা মামা, বিক্রম মামা, সঞ্জয় মামা বা শম্পা মাসি, মিঠু মাসি, অপু মামা, ইলা মাসি বা পাভেল, মিতুরাসহ অন্যরা ভালো আছেন কিনা? আমার সাহসও নেই এই খোঁজ নেওয়ার।এরকম দম বন্ধ করা অবস্থা এর আগে কখনো দেখিনি! এটা আমাদের জন্য লজ্জার, গ্লানির। একসময় শুনতাম, মসজিদ-মন্দির ভাঙা আর মন ভাঙা একই কথা। আজ আমাদের মনটা সত্যিই ভেঙে গেছে।
মনেপ্রাণে খুব চাই নোয়াখালীর সবাই ভালো থাকুক। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই, ঠিক যে রকমটা আমি ছোটবেলায় ছিলাম।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট