আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় এ বছর দেশে সারের জন্য ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি। ইতিমধ্যে ১৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে। সারে অতিরিক্ত ভর্তুকি নিয়ে সরকার উভয় সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক।
সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে সচিবালয়ে সারের মজুত, দাম, ভর্তুকিসহ সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে কৃষিমন্ত্রী এসব তথ্য জানান।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, “কোভিড-১৯ পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ ভাড়াও প্রায় দুই গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি সারের আমদানি ব্যয় ছিল ইউরিয়া ৩২ টাকা, টিএসপি ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা, ডিএপি ৩৭ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৬ টাকা, ৭০ টাকা, ৫৪ টাকা এবং ৯৩ টাকা। অথচ প্রতি কেজি সার কৃষককে দেয়া হচ্ছে ইউরিয়া ১৬ টাকায়, টিএসপি ২২ টাকায়, এমওপি ১৫ টাকায়, ডিএপি ১৬ টাকায়।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “এর ফলে বর্তমানে ভর্তুকি দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারে ৮২ টাকা, টিএসপিতে ৫০ টাকা, এমওপিতে ৪১ টাকা এবং ডিএপিতে ৭৯ টাকা। এ বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি প্রদানে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে লাগবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকিতে লেগেছিল ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। এ বছর ভর্তুকি খাতে বাজেট মাত্র ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আরও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন।”
ড. রাজ্জাক বলেন, “পৃথিবীর কোথাও এতো ভর্তুকি দেওয়ার উদাহরণ নেই। বছরে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ভর্তুকি কমাতে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপও রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সংস্থার আপত্তি উপেক্ষা করে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সারের দাম তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলেও বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে অর্থ্যাৎ কৃষক পর্যায়ে সারের মূল্য বৃদ্ধি করেনি। অব্যাহতভাবে ভর্তুকি দিয়ে সুলভমূল্যে সার সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের ধারা বজায় রেখেছে।”
মন্ত্রী বলেন, “সারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকার উভয় সংকটে রয়েছে। একদিকে এত ভর্তুকি দিলে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। অন্যদিকে সারের দাম বাড়ালে কৃষকের কষ্ট বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন খরচ বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে আমরা নীতিগতভাবে এখনও সারের দাম না বাড়ানোর পক্ষে। আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করছি, তবে দাম না কমলে এই বড় অঙ্কে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা কঠিন হবে।”
প্রয়োজনে সারে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো বা সারের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া কর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া যেতে পারে বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, “বর্তমান সরকার সারের মূল্য চার দফা কমিয়ে প্রতি কেজি টিএসপি সার ৮০ টাকা থেকে ২২ টাকা, এমওপি ৭০ টাকা থেকে ১৫ টাকা, ডিএপি ৯০ টাকা থেকে ১৬ টাকা এবং ইউরিয়া ২০ টাকা থেকে ১৬ টাকা করেছে। সার, সেচ, বীজ, বালাইনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিতরণসহ সার্বিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে। কৃষি উপকরণের দাম যেমন কমিয়েছে তেমনি সহজলভ্য করে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের কোন সংকট হয়নি। ফলে কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট দানাদার শস্যের উৎপাদন হয়েছে ৪৫৫.০৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ ৩৩.৬২ লাখ মেট্রিক টন এবং পাট ৭৭.২৫ লক্ষ বেল উৎপাদিত হয়েছে। এসব সাফল্যের পেছনে সারের দাম কমানো ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বিরাট ভূমিকা রেখেছে।”
আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, “বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সার, সেচসহ কৃষি উপকরণে মোট ৮৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। অথচ বিএনপির শাসন আমলে (২০০৫-০৬ অর্থবছরে) প্রায় ৩২ লাখ ৫০ হাজার মে. টন সার ব্যবহার হয় এবং উক্ত সময়ে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ২৭ গুণ বেশি ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। যার ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষকরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “বিএনপির শাসন আমলে সারসহ কৃষি উপকরণের চরম সংকট ছিল। সারের জন্য কৃষকদের জীবন দিতে হয়। সারের জন্য বিএনপি সরকার ১৯৯৫ সালে ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করেছিল। বিপরীতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সারের উৎপাদন ও আমদানি অব্যাহত রেখেছে। গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের কোনো সংকট হয়নি।”
এছাড়া বর্তমানে সারের মজুত ও চাহিদা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৫৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লাখ মেট্রিক টন, টিএসপি সাড়ে ৭ লাখ মে. টন, এমওপি সাড়ে ৭ লাখ মে. টন এবং ডিএপি সাড়ে ১৬ লাখ মে. টন। চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।”
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল, অতিরিক্ত সচিব বলাইকৃষ্ণ হাজরা প্রমুখ।
