• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

তেরো দিনে ক্ষতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৩, ১০:০০ পিএম
তেরো দিনে ক্ষতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি। চলছে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক অগ্নিসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা। সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, নষ্ট হচ্ছে সম্পদ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি, ধ্বংস হচ্ছে অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে সংকটে থাকা অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, হরতাল-অবরোধ অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলেছে। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি সহনশীল না হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক পণ্যের আনা-নেওয়া এবং আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামির সাত্তার বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যে নেতিবাচক প্রভাব সেটা বছরের শুরুতেই জ্বালানির দাম দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর সাপ্লাই চেন, ডিসাপশন, ডলারের দাম বেড়ে গেল। সব কিছুতেই কস্ট অব ডোয়িং বিজনেস বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসা পরিচালনার যে খরচ, সেটা প্রথম থেকে বাড়ছে। বছরের শেষে এসে শুরু হয়েছে হরতাল-অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব। সব ব্যবসাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর এই নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ছে।”

তিনি বলেন, “যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা শুধু সম্পদের ক্ষতি নয়। আমি যে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব, আমার কাছে ক্রেতা আসবে কি আসবে না সেগুলো নিয়েও কিন্তু ব্যবসায়ীরা চিন্তা করছে। উৎপাদন নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তা করছে। আমার ম্যানুফেকচারি ক্যাপাসিটি ফুললি ইউটিলাইজ করতে পারছি কি পারছি না, সেগুলো নিয়ে তারা চিন্তা করছে।”

ব্যবসায়ীদের দেওয়া একটি তথ্য বলছে, গত ২৯ অক্টোবর থেকে হরতাল-অবরোধ রোববার (১৯ নভেম্বর) পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত একটানা ১৩ দিন পালন করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এই ১৩ দিনে ইতোমধ্যেই ৭৫ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আগুন-ভাঙচুরে আরও ৩০ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে।

এখন থেকে ১০ বছর আগে ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণায় উঠে আসে- একদিনের হরতালে তখন আর্থিক ক্ষতি হতো ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে অর্থনীতির আকার ৪ গুণ বেড়েছে। ফলে এ সময়ের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ক্ষতিও সেই হারেই বাড়বে।

এদিকে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশকে যখন অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছে, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতিতেও আঘাত হানে। এরইমধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। এ যুদ্ধও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমন অবস্থায় আমদানিমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোটাই বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এছাড়া ডলার সংকটে স্থবির হয়ে পড়েছে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি আমদানিসহ বৈদেশিক লেনদেন। এলএনজি ও গ্যাসের সংকটে অভ্যন্তরীণ শিল্পে উৎপাদন কমতে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। 
এই নাভিশ্বাস ওঠা পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে অবরোধ-হরতাল, ভাঙচুর-আগুন অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে বড় কাজ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সরবরাহ বাড়ানো এবং রিজার্ভের পতন আটকানো। কিন্তু রপ্তানি আয়, প্রবাস আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান কমছে।

বিশেষ করে হরতাল-অবরোধে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তারা। সড়কে পরিবহন না চলায় পণ্য সরবরাহে ঘাটতি, বেশি দামে পণ্য সরবরাহ, আমদানিতে ঘাটতি, রপ্তানিতে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় লোকসান বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পোশাক শিল্পের মালিক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “চলমান হরতাল-অবরোধে আমদানি-রপ্তানিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটে আমরা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছি। বিদেশি গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। পণ্য সরবরাহে পরিবহন না চলায় দ্বিগুণ ভাড়ায় পণ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে গেলে সবদিকেই আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে না এমন রাজনীতি করা। কারণ, দেশের অর্থনীতি ভালো না গেলে মানুষ ভালো থাকবে না। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, অনাকাঙ্ক্ষিত এই তিন পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে ভয়ানক অবস্থা তৈরি করেছে। এরমধ্যে হরতাল-অবরোধের রাজনীতি দীর্ঘ হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।” 

Link copied!