• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,
দুঃসহ বাজার

সিন্ডিকেটের কবলে ভোক্তার নাভিশ্বাস


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২৩, ১০:০৩ পিএম
সিন্ডিকেটের কবলে ভোক্তার নাভিশ্বাস
ফাইল ছবি

এখন দুঃসহ দেশের বাজার। এই বাজারে ভোক্তার পকেট কাটার ফাঁদের নাম ‘সিন্ডিকেট’। এই ‘সিন্ডিকেট’ই একটির পর একটি পণ্য নিয়ে চালাচ্ছে পকেট কাটার হরিলুট। 

চাহিদার কাছে অসহায় হয়ে ‘সিন্ডিকেট’র ফাঁদে প্রতিদিন অর্থদণ্ড দিচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা। কিছু পুঁজিপতি কয়েক বছর ধরে সাধারণের নিত্য চাহিদাকে টার্গেট করেই চালাচ্ছে এই লুটপাট।

সরকারের প্রচেষ্টায় পণ্যের মজুত ‍ও উৎপাদন চাহিদামাফিক থাকে। কিন্তু ‘সিন্ডিকেট’র কারসাজিতে ভোক্তাকে কিনতে হয় তিন গুণ-চার গুণ আবার কখনো দশ গুণ বেশি দাম দিয়ে। 

যার উদাহরণ কাঁচা মরিচ। বাজারের এই দুঃসহ অবস্থা কাঁদাচ্ছে ভোক্তাকে, উঠছে নাভিশ্বাস।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসবের সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্ট বড় কর্তারাও জড়িত। তবে ভয়ে মুখ খুলছেন না অনেকে। খোদ সরকারের ঊর্ধ্বতনরাও যে বিষয়টি জানেন, তা গত সংসদ অধিবেশনের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে।

এই ‘সিন্ডিকেট’র বিরুদ্ধে সরকারের কোনো অভিযান ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সংসদে মন্ত্রীও এই ‘সিন্ডিকেট’র কথা স্বীকার করেছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে ‘সিন্ডিকেট’র রাঘববোয়ালরা।

জানা গেছে, এই ‘সিন্ডিকেট’র বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এ পর্যন্ত ৫০টি মামলা করেছেন। তবে এসব মামলায় শাস্তি পায়নি কেউই।

কমিশন বলছে, মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম চলছে। এর আগে ‘সিন্ডিকেট’ শনাক্ত করতে বাজারে গোয়েন্দাও নামানো হয়। নামানো হয় পুলিশও। কিন্তু কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না।

গত সংসদ অধিবেশনে একজন মন্ত্রীকে ‘সিন্ডিকেট’র হোতা বলে ইঙ্গিত করা হয়। অভিযোগের তির ছোড়া হয় তার দিকেই। উল্টো সেই মন্ত্রী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সংকট আরও বাড়বে বলে দাবি করেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাজার তদারকিতে যুক্ত সংস্থার কর্তারাও জড়িত রয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, তা না হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের এত এত উদ্যোগে সাফল্য আসছে না কেন?

জানা যায়, দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ট্রেড আ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। পণ্যের নির্ধারিত দামের বিষয়টি তদারকি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। 

পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও বাজার নিয়ন্ত্রণে তদারকি করে থাকেন। এত সংস্থা, অধিদপ্তর আর বাহিনীতেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাজারে অনুসন্ধান চালিয়ে সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করে নাম-পরিচয়সহ যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন আকারে জমা দিয়েছেন সরকারের দেওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দারা।

ওই প্রতিবেদনে ‘সিন্ডিকেটে’ বড় বড় রাঘববোয়ালদের নাম থাকায় ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে উল্টো চাপা দিয়ে রাখা হয়।

গত ২৬ জুন সংসদ অধিবেশনে দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় সংসদে তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী। 

একপর্যায়ে মন্ত্রী স্বীকার করে বলেন, ‘আরও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় ওই সব বড় বড় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার চেষ্টা চলছে।’

এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ‘সিন্ডিকেটের সম্পর্ক রয়েছে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সিন্ডিকেট’র কথা বলা হয়, এ কথা ঠিক। 

বড় বড় গ্রুপ একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ রাখা দরকার। আমরা তাদের জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম, তা হয়তো করা সম্ভব। 

তাতে যে ক্রাইসিসটা হঠাৎ করে তৈরি হবে, আমাদের তো সেটা সইতে কষ্ট হবে।’

অপরদিকে এ ঘটনার ১০ দিন কেটে গেলেও সিন্ডিকেটের সঙ্গে মন্ত্রীর আলোচনার কোনো উদ্যোগের কোনো খবর পাওয়া যায়নি এখনো।

বাজারের এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতে ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার আলোচনা কত দূর এগিয়েছে, তা জানতে চায় ভুক্তভোগীরা। তবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সুখবর নেই।

এদিকে বাজার দেখভালকারী একাধিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছে সংবাদ প্রকাশ। তারা বলছেন, বাজার ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ন্ত্রণে এ সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এখনো। 

এই সংস্থাগুলো তাদের মনিটরিং রিপোর্ট আলাদাভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে থাকে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা না নিলে তাদের কিছুই করার থাকে না।

সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা তাদের নাম গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, চিনি ও পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের যে প্রতিবেদন তারা জমা দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ে, তাতে দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

দেশের সব বাজারের প্রবেশপথে এবং খুচরা দোকানের সামনে পণ্যমূল্য তালিকা টাঙানো বাধ্যতামূলক হলেও তা কোনো বাজার বা দোকানের সামনে টাঙানো নেই। 

ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই আদেশ দেওয়া হলেও কার্যত কোনো ফল নেই এর।

মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি না করার বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত সেল রয়েছে। এই সেলের অধীনে ৪৩টি টিমও রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে এই টিমকে মাঠে দেখা যায় না।

এই মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের পরামর্শক মো. মাহমুদুল হাসান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, সেল সক্রিয় রয়েছে। 

‘সিন্ডিকেট’র দৌরাত্ম্য ঠেকাতে সেল সরকারকে কী পরামর্শ দিয়েছে, তা জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি। তিনি বলেন, “আমি রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আছি, তাই মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।”

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘এই সংকটগুলো থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজা হচ্ছে। গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। 

আমরা সে বিষয় বাস্তবায়নে কাজ করছি। ওই সভায় বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে একটি সমীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা সেই সমীক্ষাটি করছি।’

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের পরদিন হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের কেজি ১ হাজার টাকা হয়ে গেল। 

ভারত থেকে আমদানির পর সঙ্গে সঙ্গে ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে চলে এল। এই ঘটনাই প্রমাণ করে বাজারে দ্রব্য-পণ্যের কোনো সংকট নেই। 

আছে ভয়াবহ ‘সিন্ডিকেট’র অস্তিত্ব। দ্রব্যমূল্য নিয়ে কারা খেলছে-তাও স্পষ্ট। এরপরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পেঁয়াজ, চিনি, কাঁচা মরিচের পর এবার আলুতেও ‘সিন্ডিকেট’র থাবা পড়েছে।

অপরদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব কষে মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী পরিসংখ্যান দেখালেও বাস্তবে বাজারে এর কোনো মিল নেই।

বাজারে অকস্মাৎ কোনো পণ্যের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা, বা এর বেশিও বেড়ে যায়। এরপর সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ আর পদক্ষেপ নিতে নিতে ‘সিন্ডিকেট’র পকেটে চলে যায় ভোক্তাদের কোটি কোটি টাকা। 

এভাবেই বছরের পর বছর ধারাবাহিকভাবে ক্রেতার কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে পুঁজিপতিদের এই ‘সিন্ডিকেট’।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘গত এক বছরে অনেক পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সরকারের সংস্থাগুলোর তদারকি আরও বেশি বেশি জোরদার করা প্রয়োজন।’

ভোক্তারা বলছেন, যেখানে গোড়ায় গলদ সেখানে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম বন্ধ হবে না, ভোক্তাদের দুর্ভাগ্যের পরিধি শুধু বাড়বেই। সরকারের উচিত ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া।

Link copied!