• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

হঠাৎ দেখা নাটাকরঞ্জার সাথে


মোহাম্মদ আলি
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৩, ০৩:১৩ পিএম
হঠাৎ দেখা নাটাকরঞ্জার সাথে

কক্সবাজারের সৈকতের অদূরে ইনানী সৈকত। মাস অক্টোবর। তিন বন্ধু মিলে ঘুরছি, হইহই করছি, সমুদ্রস্নান সারছি। এক ফাঁকে দুই বন্ধুকে ফাঁকি দিয়ে দূর থেকে একঝলক দেখা, উস্কোখুস্কো ঝোপঝাড়ের সামনে উদ্ভিদপ্রেমের স্বভাবসুলভ টানে গিয়ে দাঁড়ালাম। গিয়ে দেখি, বাহ! এ তো নাটাকরঞ্জা! বইতে, ইন্টারনেটে ‍‍`পাখির বাসায় দুটি ডিমে‍‍`র আইকনিক ছবিটার কথা মাথায় চলে এল ঠিক তখনই। বই বা দৃশ্যমাধ্যমে দেখা এক, আর বাস্তব চর্মচক্ষে দেখা আরেক। ফুলের কোনো চিহ্ন পেলাম না; অসংখ্য ফল দিয়ে সুখমৃত্যুর মুখোমুখি ঝোপগুলো। এ এক দারুণ বিসর্জন। কচিসবুজ রঙের ফলগুলো শুকানোর আগেই মাতৃগাছের এই বিদায়বারতা মনটাকে কিছুটা আচ্ছন্ন করে রাখল। তবে ফলে সতেজ ভাব দেখে দুর্দান্ত রোমাঞ্চ বোধ করলাম। আরো রোমাঞ্চিত হলাম ফলের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা দুই শিশুর অবস্থানের কথা চিন্তা করে। ঐ যে বলেছিলাম, পাখির নীড়ে দুটি ডিমের কথা।

ঝিনুক-আকৃতির এবং একই সাথে প্রায় ঝিনুক-আকারের ফলগুলো কণ্টকাকীর্ণ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। কত যে খোঁচা খেয়েছি ১২-১৫টা ফল ছিঁড়তে গিয়ে, তার কোনো শেষ নেই। এ কাজ করতে গিয়ে মনে হল নাটকরঞ্জা যেন আমাকে বলছে, আমার শিশুগুলো এখনো পূর্ণ জীবন পায়নি, কচি অবস্থায় ওদেরকে নষ্ট করো না। আর যদি কথা না শোনো তাহলে দাঁড়াও, তোমার ব্যবস্থা করছি। অনেকটাই সুঁচের মতো অসংখ্য কাঁটা রয়েছে একেকটি ফলে। হাতের কয়েক জায়গায় ঘাই খেয়েছি অনেক। ব্যাগে আচ্ছামতো প্যাকেট করে রিসোর্টে ফিরে এসে ঝিনুকাকৃতির ফলগুলোর বেশ কয়েকটা ঢাকনা খুললাম। গুঁতাগাতা তো খেলাম ঠিকই, খোলামাত্র যা দেখলাম তাতে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। অবর্ণনীয় সুন্দর, ঠিক ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। বাইরে এত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে চোখ রাঙানি অথচ ভিতরে রূপের ডিব্বা নিয়ে বসে আছে নাটাকরঞ্জা। কচি সবুজসুন্দর ঝিনুকের মধ্যে যেন সবুজ একটা মুক্তা। বাড়িয়ে বলছি না একেবারই। রিসোর্টে থাকা ৮-১০ জন বন্ধুর প্রত্যেকের চোখ কপালে উঠল। রূপ আর অভিনবত্বের প্রত্যাঘাতে ভীষণ আনন্দ পেলাম সবাই সে আনন্দভ্রমণে। সে-ই প্রথম নাটাকরঞ্জার ফলের সাথে সাক্ষাৎ, মোলাকাত। প্রথম মোলাকাতেই অবর্ণনীয় প্রেমসুখ! বৈচিত্র্যসুখের আজীবন পূণ্যস্মৃতি।

শুধু ফল নয়, নাটাকরঞ্জার পুরোটাই অস্ত্রশস্ত্রবোঝাই। যেখানে গাছটি হবে, সেখানেই দুর্ভেদ্যতার দেয়াল তুলে থাকবে। ইতস্তত ছড়ানো অনেকটা লতানো গড়ানের গাছটি; বলা যায় লতাগুল্ম। বহুবর্ষজীবী তো অবশ্যই, বেশ শক্তপোক্ত কাষ্ঠল কাণ্ডের ও ইতস্তত ছড়ানো লম্বা-লম্বা ডালের গাছটির শরীর তীক্ষ্ণ কাঁটায় ভরা। এর তলে যাওয়া মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব কাজ; এককথায় দুর্ভেদ্য। গাছটি তার চারপাশ ঘিরে রাখে অসাধারণ পক্ষল পাতা দিয়ে। এ এক আশ্চর্য দান প্রকৃতির। কাঁটায় পরিপূর্ণ যার শরীর, দেখতে সে সুন্দর। লতান গুল্ম বা ছোট বৃক্ষটি ৫ মিটারের মতো উচ্চতা প্রায় সাধারণত। ডালের কাঁটাগুলো শক্ত, তীক্ষ্ণ, খাড়া কিংবা বিড়ালের নখের মতো বাঁকানো। পাতা দ্বিপক্ষল ও সজোড়পত্রী (আগার দিকে পাতা থাকবে জোড়ায়)। পাতা বিশাল; ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা। পাতা ১৪-২৪টি। একক পাতা ডিম্বাকার-আয়তাকার কিংবা ডিম্ব-বর্শাকার; ২-৪ সেন্টিমিটার ও ১-২ সেন্টিমিটার চওড়া। পত্রাক্ষের প্রত্যেক জোড়া পাতার মধ্যে কাঁটা থাকবেই।

নাটাকরঞ্জার ফুলের রং হলুদ—সোনালি হলুদ। পুষ্পমঞ্জরির আগায় বেশ কয়েকটি ফুল ভিড় করে থাকে। একেকটি ফুলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ সেন্টিমিটার। ফুলের বৃতি ৫টি। পাপড়িও ৫টি। বড় পাপড়িটি মূল ফুল থেকে বর্ধিত কিছুটা, আর এটি লাল দাগে চিত্রিত। বাকি পাপড়ি-৪টি মাংসল। পুংকেশরের সংখ্যা ১০। এর ফুল ফোটে বর্ষাকালে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও থাকে অল্পবিস্তর।  

নাটাকরঞ্জার ফল মারাত্মক অস্ত্রধারী, সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক গাছে কাঁটা থাকে—সে জানা কথা, কিন্তু কাঁটাগাছের ফলেও যে তার চাইতে মারাত্মক কাঁটা থাকবে এবং সেটা অসংখ্য-অগণন, তার আদর্শ নমুনা এই নাটাকরঞ্জা। ফলগুলো ঝিনুক আকৃতির, ৬-৯ সেন্টিমিটার লম্বা ও চওড়ায় ৩.৫-৩.৮ সেন্টিমিটার। ফল বিদারী অর্থাৎ আপনা থেকে ফেটে গিয়ে বীজ ছড়িয়ে পড়ে। ফলের মতো এর বীজও দারুণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বীজের কথায় পরে আসছি। সাধারণত দুটি বীজ থাকে প্রতি ফলে, তবে একটিও হয় মাঝেমধ্যে; গোলাকার ১.৫-২.০ সেন্টিমিটার ব্যাসের। ফল পরিণত হয় মূলত শীতে। গাঢ় বাদামি রঙের শুকনো ফল শুকিয়ে গেলে কী হবে, এর কাঁটার তীক্ষ্ণতা থাকে আগের মতোই।

বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলে এর দেখা মিলবে। তাছাড়া সারাদেশে কমবেশি এর দেখা মিলতে পারে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে এটি সহজলভ্য; যেমন—ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, হংকং, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, মালয় উপদ্বীপ। সমুদ্রপাড়ের গাছ-গাছালিরর সঠিক বিচরণভূমি বা জন্মভূমি বের করা খুব কষ্টসাধ্য কাজ। ছাগলখুরি লতা বা সাগরলতা, সমুদ্র কেয়া, নারিকেল ইত্যাদির কথাই ধরা যাক। আমাদের নাটাকরঞ্জা নিয়েও সে বিতর্ক রয়েছে। যেমন সুদূর দ্বীপবাসী দরিয়াই নারিয়ল বা কোকোডুমেরের কথাই ধরা যাক। কোথায় কোন সিসেল দ্বীপের বাসিন্দাকে ভুলক্রমে মালদ্বীপ বা এর আশেপাশের অঞ্চলের বলে এতদিন ধরা হতো।

নাটাকরঞ্জার ফুলের উজ্জ্বলতা, পাতার অসাধারণ বিন্যাস, ডালপালার ছড়ানো ও রাজসিক ভঙ্গি, ফলের দুর্দান্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—সবমিলিয়ে বাগানে স্থান পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমরা শুধু বাগানগর্বী মাধবীলতা, মধুমঞ্জরীলতা, মালতীলতা, বাগানবিলাসী, কাঁঠালিচাপা বা এলামেন্ডা লাগাব কেন, নাটাকরঞ্জাও বাগানে থাকুক। থাক না তাতে দুর্ধর্ষ কাঁটা, কিন্তু সৌন্দর্য তো আছে; আমরা কি গোলাপ তুলতে গিয়ে কাঁটার ঘাই খাই না!  

এত এত সব চারিত্রিক গুণ ও দুর্গুণের সাথে নাটাকরঞ্জার ঔষধি গুণও আছে। আর কে না জানে, পৃথিবীর সব গাছে কোনো না কোনো ঔষধি গুণ থাকবেই। ঔষধি হিসেবে এর কিছু লোকায়তিক ব্যবহারের কথা এবার জানা যাক। নাটাকরঞ্জার বীজের ১০০ গ্রাম শাঁস পানিতে গুলিয়ে খেলে ঘুসঘুসে জ্বর বা জীর্ণজ্বর দূর হবে। আবার এর কচি ডগা কলাপাতায় জড়িয়ে মাটি লেপে ঝলসে নিয়ে ওই পানিতে অল্প থেঁতলানো রস এক থেকে দেড় চামচ করে খেলে এই রোগ

থেকে মুক্ত হওয়া যায়। বীজের শাঁস সরিষা বা তিলের তেলে ভেজে সেটাকে ছেঁকে রেখে সেই তেল খোসপাঁচড়ায় লাগালে বেশ উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়াও অর্শ, হাত-পা জ্বলুনি, কৃমি, পেটব্যথা, ম্যালেরিয়া জ্বরেও এর বীজশাঁসের লোকায়তিক ব্যবহার রয়েছে।

বলি বলি করেও নাটাকরঞ্জার বীজের অভিনব ব্যবহারের কথাগুলো বলা হয়নি, এই সুযোগে বলা যাক। এর বীজ দারুণ শক্ত, গোলগাল, সামান্য চ্যাপ্টা। শক্ত বলেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা এর বীজ দিয়ে অনেক সময় মার্বেল খেলার কাজটি চালিয়ে থাকে। এর বীজের অতুলনীয় এক গুণ আছে যা সত্যিই বিস্ময়কর। সাগরের পানিতে পড়ে ভাসতে ভাসতে ৩০ বছরেও এর অঙ্কুরোদ্গমের সম্ভাবনা নষ্ট হয় না! এ সময়ের মধ্যে যেখানে মাটির ছোঁয়া পাবে, অনুকূল পরিবেশ পাবে সেখানেই পরবর্তী বংশধর রাখার চেষ্টা করবে নাটাকরঞ্জা। সমুদ্রের পানিতে ভেসে ভেসে বেড়ানোর এই গুণপনার জন্যই হয়তো এর ইংরেজি নাম Sea pearl।

আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গের কোথাও কোথাও ফসলি জমির বেড়া হিসেবে এ গাছ লাগানো হয়ে থাকে। আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে নাটাকরঞ্জা অথবা এর ধারেকাছের প্রজাতির বীজ দিয়ে দারুণ উৎসাহে খেলা হয়ে থাকে ঔয়ারে (Oware) নামীয় এক ধরনের খেলা। খেলাটি বোর্ড গেইম—হিসাবনিকাশের খেলা। আফ্রিকায় এই খেলার উন্মাদনার ব্যাপারটি বোঝা যাবে একটা তথ্য পেলে, সেটি এই—খেলাটি ঘানার জাতীয় খেলা। দেশটির এক পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, এই খেলার মজা অব্যাহতভাবে লোটার জন্য প্রতিপক্ষ ছেলেমেয়ে-দুজন শেষে বিয়েই করে ফেলেছিল। ইন্দোনেশিয়াতে নর্তকীরা নাকি এ খেলায় দারুণ মজে থাকে। খেলাটিতে অংকের হিসাব রাখতে হয় টনটনা। অংকে মাথা খোলাবার জন্য সুদূর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদেরকে এই খেলা মশগুল থাকতে নাকি উৎসাহ দিয়ে থাকে।  

নাটাকরঞ্জা ছাড়াও গাছটির আরো কয়েকটি নাম আছে। অনেকে একে বলে নাটা, লাল কাঁটা, ঝগড়াগোটা। ঝগড়াগোটা কেন বলা হয় জানি না, তবে খাড়া খাড়া ও মারাত্মক সুঁচালো কাঁটার দস্যুপনার জন্যই হয়ত নামের এ দশা হয়ে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশেপাশের এলাকায় একে বলে কুঁদুলেবিচি ও গণ্ডগুলে ফল। সংস্কৃত ভাষায় বলে কুবেরাক্ষি ও পুতিকরঞ্জ। এর বৈজ্ঞানিক দ্বিপদী নাম Caesalpinia bonduc। এটি Caesalpiniaceae পরিবারের সদস্য। Sea pearl ছাড়াও এর আরো কয়েকটা ইংরেজি নাম আছে যেমন—The fever nut, Benzoar nut, Indian nut, Nickar bean, Physic nut ইত্যাদি।

 

ছবি: লেখক

Link copied!