• ঢাকা
  • সোমবার, ১৭ জুন, ২০২৪, ২ আষাঢ় ১৪৩১, ১০ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৫

আমার কৈফিয়ত: নজরুল


ড. গগণদীপ
প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৪, ০৬:৩১ পিএম
আমার কৈফিয়ত: নজরুল
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

কবিতার মধ্যে থাকে ভাষার খেলা। শুধু কি তাই? আমি মনে করি ভাষা তো কবিতার একটি অংশমাত্র। কবিতা বা যেকোনো সাহিত্য রচনা ভাষা দিয়ে বোঝাতে হয় ঠিকই। কিন্তু তার ভাবনা অনেকবার ভাষার সীমাগুলো পেরিয়ে যায়। অনুবাদ এই রকম একটা কাজ যে একটি ভাষার সীমা পেরিয়ে লেখাকে অন্য একটা ভাষায় নিয়ে যায়।

‘কাজী নজরুল ইসলাম’ আমি এই নামটি চিনেছি যখন বাংলা ভাষার একটি শব্দও জানতাম না। উত্তর ভারতের নাটকের গুণী মানুষদের থেকে জেনেছি। তারপর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে পড়তে গিয়ে শুনলাম তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা বলেন। শুনলাম ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম…’। শুনলাম তিনি বিদ্রোহের কথা বলেন। শুনলাম তিনি প্রেমের কথা বলেন। অথচ তিনি যে ভাষায় লিখেছেন, বলেছেন, তা আমার অজানা।

এরপর চাকরির সূত্রে কলকাতা এসে একটু একটু করে বাংলা বলতে লাগলাম। ভাঙা ভাঙা বাংলা। ভুলভাল বাংলা। পড়তে শিখলাম। কিনেও নিয়ে এলাম কিছু বাংলা বই। নজরুলের লেখা বইও ছিল এরমধ্যে। অনেক দিন বইটা খোলার সাহস পাইনি যদিও।

এরমধ্যে রবীন্দ্রভারতী থিয়েটার রেপার্টওয়ারের সঙ্গে একটা নাটক করার সুযোগ এলো। এর আগে আমি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা (দুই বিঘা জমি) নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে একটা নাটক তৈরি করেছিলাম। তখন থেকে মনে ছিল যে কবিতা নিয়ে আরও কাজ করব। রেপার্টয়ারে অনেক নাটকের কথা বলার পর মনে একটি কবিতা অথবা একজন কবিকে নিয়ে কাজ করি।

অনেক বছর ধরে নজরুলকে, নজরুলের কাজকে আরও ভালো করে জানবার যে ইচ্ছা চাপা পড়েছিল, তা উঠে এলো। সত্যি বলতে তাঁর জীবন নিয়ে বেশি কিছু জানা ছিল না। তবুও নাটক তৈরি করার সাহস পেলাম রেপার্টওয়ারেরর শিল্পীদের উৎসাহে। বিভাগের সব শিক্ষক, স্টাফ এমনকি শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে এলো নানানভাবে সহযোগিতা নিয়ে। নজরুলের নাম শুনে সবাই যেভাবে উৎসাহিত হয়েছিল, আমার মনে হয়েছিল কিছু একটা করে ফেলব আমরা সবাই মিলে।

শুরু হলো রতন সন্যায়মতের লেখা এবং আমার নির্দেশনায় রবীন্দ্রভারতীয় ইউনিভার্সিটির থিয়েটার রেপার্টয়ারের নাটক ‘ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা’। কাজী নজরুল ইসলামের জীবন এবং দর্শন নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম নাটক। এই কাজটা করতে গিয়ে আমি যতটা অবাক হলাম, তার চেয়ে বেশি অন্যরা অবাক হলো যে, এই নাটক করলো একজন অবাঙালি। কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রশ্ন বা অবাক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমি পাঞ্জাবে জন্মেছি, কিন্তু বোধহয় সবচেয়ে কম কাজ পাঞ্জাবেই করতে পেরেছি। এতে আমার দুঃখ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট যে আমি জীবনে যেখানে থেকেছি সেখানকার ভাষায় নাটকের কাজ করছি।

আমি নাটকের লোক। নাটক করার জন্য কেবল লিখিত ভাষা লাগে না, লাগে শরীরের ভাষা, মনের ভাষা। আমি কেরালা গিয়ে মালয়ালম ভাষাতেও কাজ করেছি এবং সমৃদ্ধ হয়েছি। আর তাছাড়া আমার মনে হয় আমি একা নই, যারা নাটকের কাজে আলাদা আলাদা জায়গায় গিয়ে কাজ করে, তারা অনেক ভাষা নিয়ে কাজ করে। দিল্লি বা অন্যান্য কত জায়গাতেই তো বাঙালিরা গিয়ে নাটক করে নাটকের বিষয় বাংলা হয় না। কিন্তু এখানে আমার অবাঙালি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ আমার মনে হলো যে আমি এই রকম একজনকে নিয়ে নাটক করলাম, যাকে প্রায় প্রত্যেক বাঙালিই ভালোবাসে।

আর একটা কারণ হতে পারে যেটা বললে, অনেকে আমার ওপরে রাগ করতে পারেন, কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না। সেটা হলো ইদানিং নজরুলের প্রতি মানুষের প্রেম একটু ঢাকা পড়েছিল। এই কথা আমি একা বলছি না। দিল্লি ইউনিভার্সিটির একজন গুণী প্রফেসর প্রশান্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম যে উনার ছোট্টবেলায় কলকাতায় নজরুল জয়ন্তী পাড়ায় পাড়ায় পালন করা হতো। আমি কলকাতা এসেছি সাত বছর। আমি দেখিনি এটা হতে। অনেকে এই কথার সঙ্গে একমত হবেন হয়তো আমি জানি। এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন একটা নাটক হলো যে নাটক কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের কথা বলে, তাঁর দর্শনের কথা বলে, সেই নাটক বাঙালি মনকে আবেগপূর্ণ করবেই।

নজরুলের মতোন মানুষকে উনার কাজকে বোঝার জন্য তো আমার একটা জন্ম যথেষ্ট নয়। এক কবিকে ভালোবাসার জন্য কত কবিতা পড়লে ভালোবাসা যায়? কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন অনেক ছোট্ট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বলেই অনেকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। কোনো ভাষা বা স্থানের সীমানা তাঁদের আটকাতে পারেনি। যে মানুষ নিজের ভাষা বা স্থানের সীমানা মেনেই চলেছে, তাঁকে ভালোবাসার জন্য সীমানার খেয়াল থাকবে কেন! আর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উনার যে ভূমিকা ছিল তাতে উনার নাম তো সবার মুখে মুখে ছিল।

ভারতের একজন গুণী নাটক নির্দেশক, যিনি একটা সময় ন্যাশনাল স্কুল ড্রামার ডিরেক্টরও ছিলেন। আমার নাটকের কথা শুনে খুশি হয়ে বললেন, “আমি নজরুলপ্রেমী। আমি এই কাজ করতে চাইছিলাম। তুমি করেছো শুনে খুব খুশি হলাম।” উনার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম উনার নজরুল প্রেমের গল্প। রাম গোপাল বাজাজ জানালেন যে ভারত দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে উনাদের চারদিকে শোনা যেত রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতা আর গান। উনি অবাঙালি হয়েও এইভাবে নজরুলকে পেয়েছিলেন। আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কীভাবে পাবে নজরুলকে জানি না। নজরুলের কাজ দেশে-বিদেশে সবার মনের মধ্যেই জায়গা করেছে।

তাও এটা ঠিক যে পরবর্তীকালে আমার বাংলা ভাষার জ্ঞান খুব কাজে লেগেছে। আমি উনার গান ও কবিতা বাংলা ভাষাতেই শুনতে পড়তে পেরেছি। এটা আমার সৌভাগ্য। আমার বাংলা শেখা সফল হয়েছে। নাটক কোনোদিন একা করা যায় না।

নাটকটি হয়েছে কারণ রেপার্টরির শিল্পীরা পরিশ্রম রিসার্চ করেছে। নাটক হয়েছে কারণ রতন সন্যায়মতের মতো অভিজ্ঞ মানুষ পাশে ছিলেন। আর অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকীর মতো গুণী মানুষ দূরে বসেও উৎসাহ দিলেন। উনার লেখা ‘লেটো কাহন’ পড়ে খুব সমৃদ্ধ হয়েছিলাম আমরা।

নজরুলের মতো মানুষকে একটা নাটকে বাঁধা যায় না। নজরুলকে আরও জানা দরকার, বোঝা দরকার। উনার বলা সর্বধর্মের সম্প্রীতির কথা আজকের দিনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জীবনে সব কষ্ট যে সইতে হয়, এই কথা উনি সুন্দর করে বুঝিয়েছেন আমাদের। প্রেমকে, সত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, নিজের মনের মধ্যে বিদ্রোহের আগুনকে কীভাবে পুষে রাখতে হয় উনি জানিয়েছেন। আজকে ধর্মের নামে, দলের নামে, দেশের নামে ঝগড়া করতে আমরা যে জায়গায় নেমেছি সেখানে মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নজরুলের দর্শন চর্চা খুব প্রয়োজন।

আসলে আমাদের কাছে কাজী নজরুল ইসলাম এই নামটাই একটা রোমান্টিক বাস্তবতা। কারণ উনার প্রতিটা কাজের মধ্যেই এই ভাবপ্রবণতা আছে। তবে এই নাটক করার সময় আমি প্রতিটা মুহূর্তে অবাক হয়েছি উনার কাজ, কাজের প্রতি, জীবনের প্রতি আবেগ দেখে। মনে হয় আর যত উনাকে পড়ব, শুনব, বুঝব অবাক হতেই থাকব। নতুন উনাকে আবিষ্কার করব। নিজেও পথ চিনতে শিখব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নাটক বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

Link copied!