• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
স্মরণ

একজন আবুল হাসনাত ও ‘রাত্রির পরিযান’


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৩, ০২:৫২ পিএম
একজন আবুল হাসনাত ও ‘রাত্রির পরিযান’

সেই কবে, প্রায় চার দশক আগে, সংবাদ সাহিত্য সাময়িকী ও তার মিতবাক কাণ্ডারী আবুল হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত, অদেখা সাহিত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। আমি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ততদিনে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে লেখালেখি, মূলত কবিতা ও কিছু গ্রন্থসমালোচনা, প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু সেসব পত্রিকায় যত লেখাই ছাপা হোক না কেন দৈনিক সংবাদের বৃহস্পতিবারের চার পাতার সুপরিসর ও সুসম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকীতে লেখা প্রকাশিত না হলে ঠিক যেন জাতে ওঠা যাচ্ছিল না। তাই একদিন সাহস করে পদ্য নয়, প্রবন্ধ নয়, একটি সদ্যরচিত ছোটগল্পই পাঠিয়ে দিলাম ডাকে। গল্পের নামটিও মনে আছে স্পষ্ট, ‘উৎসমুখে’, কদিন আগে প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয় পিতৃপুরুষের বসতভিটেয় আচমকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে রচিত। কবি ও গদ্যকার হিসাবে ততদিনে কিছুটা প্রতিষ্ঠা থাকলেও, গল্পকাররূপে একেবারেই কোনো পরিচিতি ছিল না আমার। তাই লেখাটি ছাপা হবার বিষয়ে নিজের মনেই অতটা জোর পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই লেখাটি ছাপা হয়ে গেল সংবাদের বনেদি সাহিত্যপাতায়। আর সেই সাথে আমিও যেন এক লহমায় সভ্য হয়ে গেলাম সাহিত্যের এমন এক এলিট ক্লাবের, যাদের লেখা ছাপা হয় খোদ সংবাদের সাহিত্যপাতায়! হাসনাত ভাই তাঁর সম্পাদিত এই সাহিত্যসাময়িকীটিকে এমনই এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মেধা, মননশীলতা, প্রজ্ঞা ও পরিশ্রমের গুণে।


তারপর থেকে নিয়মিত বিরতিতেই লেখা ছাপা হতে থাকল তাঁর সুসম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকীতে। তবে সব লেখাই ডাকে পাঠানো। তেমনটাই দস্তুর ছিল; বড় জোর পুরনো ঢাকার বংশালের ভাঙাচোরা একটি দালানে অবস্থিত দীনহীন ‘সংবাদ’ অফিসের নিচতলায় এক কেরানির কাছে লেখা দিয়ে আসা যেত। হাসনাত ভাই বসতেন দোতলায়, কিন্তু সেই অব্দি যাওয়ার অনুমোদন ছিল না আমাদের, তরুণ লেখকদের। বিলও সংগ্রহ করতে হতো নিচ থেকেই। (হ্যাঁ, যত সামান্যই হোক না কেন, তখনকার আমলে পত্রিকাগুলো কিন্তু লেখকদের সম্মানী দিত। অথচ এখনকার বড় বড় কর্পোরেট হাউসের অশীর্বাদধন্য পত্রিকাগুলোরও লেখকদের প্রাপ্য সম্মানীটুকু দিতে কত যে কুণ্ঠা ও কার্পণ্য!) আমার গোটা ঢাকাবাসের জীবনে একবারই বিলের কী একটা সমস্যার দরুন দোতলায় কোষাধ্যক্ষ্যের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল। তখন এক ঝলক দেখেছিলাম তাঁকে, হাসনাত ভাইকে, মৃদু সম্ভাষণ বিনিময়ও হয়েছিল বোধ হয়, কিন্তু কোনো কথা হয়নি, তাঁর টেবিলের সামনে অবশ্য কোনো চেয়ারও ছিল না যে দুদণ্ড বসে আসব অন্তত। পরে চাটগাঁ থেকে, তারপর নিউ ইয়র্ক, মন্ট্রিয়ল থেকে লেখা পাঠাতাম ডাকে কিংবা কারও হাতেহাতে, এন্তার লেখা; কবিতা, গদ্য, নিয়মিত সাহিত্যকলাম, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি। হাসনাত ভাইও সেগুলো নিয়ম করেই ছাপতেন তাঁর পাতায়। পরে একবার, সম্ভবত পঁচানব্বইয়ে, দেশে বেড়াতে এলে, কী এক সূত্রে যেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা হয়, সেই ঘনিষ্ঠতায় হয়তো তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না, কিন্তু অকৃত্রিম উষ্ণতাটুকু টের পাওয়া যেত ঠিকই। 


এবং তা অটুট ও অব্যাহত ছিল তাঁর অপ্রত্যাশিত প্রয়াণের দুসপ্তাহ আগ পর্যন্ত। ‘কালি ও কলম’ প্রকাশের আগে লেখা চেয়ে দূর মন্ট্রিয়লেও যোগাযোগ করেছিলেন আমার সঙ্গে, তারপর আমি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এলে সেই সংযোগটুকু আরও নিয়মিত ও প্রসারিত হয়, এতটাই যে, তিনি দুই দুইবার চট্টগ্রামে আমাদের তৎকালীন প্রতিষ্ঠান ‘বিশদ বাঙলা’য় ছুটে এসেছিলেন, ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার জন্য লেখা সংগ্রহ ও চট্টগ্রামের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হতে। এই করোনাকালের গোড়ার দিকেও একবার ফোন করেছিলেন আমার একটি অনুবাদ গ্রন্থের খোঁজে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে-তিনি কখনও সভাসমিতিতে বক্তৃতা করতে, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে, নিজের সম্পর্কে বলতে কখনও উৎসাহ বোধ করতেন না, সেই তিনি আমাদের শিল্পসংগঠন বিস্তারের করোনাকালীন আন্তর্জাল অনুষ্ঠান ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজনে’র অতিথি হয়ে আসতেও সম্মতি দেন আমাকে। এবং যথারীতি ২০২০ সালের পয়লা অক্টোবর সন্ধ্যায় তিনি আমাদের এই আয়োজনের দশম পর্বের আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে যোগ দেন আন্তর্জালে, তাঁর নিজ বাসভবন থেকে। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয়, সেদিন তিনি প্রাণ খুলে বেশ কথাও বলেন আমার সঙ্গে: তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সংগঠন ‘সংস্কৃতি সংসদে’র গল্প, কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের গল্প, মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সাংস্কৃতিক তৎপরতার গল্প, সংবাদের সাহিত্যপাতা ও ‘কালি ও কলম’ পত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতার বয়ান, তাঁর নিজের লেখালেখি ও আমাদের প্রকাশনাশিল্পের নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতা ইত্যাদির কথা। তাঁর সেদিনের সেই অকুণ্ঠ ও অকপট আলাপচারিতা শুনে দেশবিদেশ থেকে তাঁর বহু স্বজন ও সুহৃদ তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জালের পরিসরে তাঁদের মধুর বিস্ময় ও আনন্দিত অনুভবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, যা অব্যাহত ছিল অনুষ্ঠানের পরেও আরও বেশ কিছুদিন। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটিই কি না হল তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার! তবু সান্ত্বনা এই যে, প্রযুক্তির কল্যাণে অন্তত তাঁর একটি সচিত্র সাক্ষাৎকার কালের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত থেকে গেল।


তাঁর সঙ্গে শেষ কথা হয় অক্টোবরের পনেরো তারিখে। তিনিই ফোন করেছিলেন আর কদিন বাদেই প্রকাশিতব্য ‘কালি ও কলম’ এর পরবর্তী সংখ্যার জন্য সদ্য নোবেলবিজয়ী মার্কিন কবি লুইজ গ্ল্যুকের কিছু কবিতা দ্রুত অনুবাদ করে পাঠানোর অনুরোধ করে। আমি তাঁর অনুরোধ রেখেছিলাম। মাত্র দুদিনের মধ্যে কবির চারটি বেশ দুরূহ কবিতা অনুবাদ করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমার সেই ইমেইলের প্রাপ্তিস্বীকারের জন্য সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করে কোনো সাড়া না পেয়ে আমি নিজেই যখন যোগাযোগ করি, তখন তাঁর সহকারীর কাছ থেকে জানতে পারি তিনি অসুস্থ এবং হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এই সংবাদ শুনে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। মাত্র কদিন আগেই যে সুস্থ, সবল, প্রাণবন্ত মানুষটির সঙ্গে আমার এমন মনখোলা আলাপ হল, কী এমন দুর্বিপাক ঘটে গেল এর মধ্যে যে, তাঁকে রীতিমতো হাসপাতাল-শয্যা নিতে হল! তখনও কি জানতাম যে, আর মাত্র অল্প ক’দিনের মধ্যেই, নভেম্বরের ঠিক মাসপয়লায়, তিনি এক অলৌকিক ইস্টিমারের সিটি শুনতে পেয়ে এই জগৎসংসার থেকে চিরদিনের ছুটি নিয়ে, কালি ও কলম গুটিয়ে, পাড়ি জমাবেন তাঁর স্বপ্নের ভুবনডাঙায়! এরই ইঙ্গিত কি ছিল, তাঁরই অনুরোধে আমার অনূদিত লুইজ গ্ল্যুকের নিম্নোদ্ধৃত এই ‘রাত্রির পরিযান’ কবিতার অমোঘ কয়েকটি পঙক্তির বুক জুড়ে?

“এই সেই মুহূর্ত যখন আপনি
আবারও আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের মধ্যে 
রক্তজাম, এবং অন্ধকার আকাশে
পাখিদের রাত্রিকালীন পরিযান 
প্রত্যক্ষ করেন।

আমার ভাবতে খুব বেদনাবোধ হয় যে,
মৃতরা এই দৃশ্য দেখতে পাবে না—
আমরা যাদের ওপর ভরসা করি
তারা এইভাবেই হারিয়ে যায়।

আত্মা তাহলে তার স্বস্ত্যয়নের জন্য কী করবে?
হয়তো তার আর এইসব আনন্দের
প্রয়োজনই পড়বে না, নিজেকেই বলি আমি;
হয়তো স্রেফ না-থাকাটাই যথেষ্ট,
এটা কল্পনা করা একটু কঠিন যদিও।”

 

সত্যিই তো, আমরা যাদের ওপর ভরসা করি তারা বুঝি এইভাবেই হারিয়ে যায়। যেমন আচমকা হারিয়ে গেছেন প্রত্যাবর্তনহীন এক রাত্রির পরিযানে, আমাদের এক অতি প্রিয় ও প্রাজ্ঞ ভরসার জন, কবি ও চিত্রবোদ্ধা মাহমুদ আল জামান, জগৎসভার সবাই যাকে জানতো, আবুল হাসনাত বলে।

 

Link copied!