জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে’- এই কথাতেই প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুর কাছে কতটা প্রিয় ছিল শিশুরা।
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। দিনটি উৎসর্গ করা হয়েছে শিশুদের জন্যে। ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর জীবন হোক রঙিন’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই পালিত হচ্ছে এবারের দিবসটি। শিশু কোমল প্রাণের জন্যে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালোবাসতেন। শিশুদের ভাবনাকে বুঝতেন। শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে ছিল তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা। সেই উপলব্ধি থেকেই দিনটিকে জাতীয়ভাবে শিশু দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, সফল রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রের সবার কথাই ছিল তার ভাবনায়। তবে শিশুদের তিনি দেখতেন আলাদাভাবে। শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। শিশুরাই আগামীতে দেশ গড়বে। তাই শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই- এই উপলব্ধিটা ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবন উন্নত করা, শিশুদের ভবিষ্যত গড়ে তোলা, শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা, সংস্কৃতিক শিক্ষা দেওয়া সবকিছুকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় এই দিনটিতে। এই সবকিছুই ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাবনায়। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন শিশুদের সুরক্ষায় পূর্ণাঙ্গ একটি আইন থাকা জরুরি। এই পথ ধরেই ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) প্রণয়ন করা হয়।
হাসি-খুশিভাবে শিশুরা বড় হবে, শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, সুন্দর আগামী গড়বে এসবই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অংশ। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুরো দেশ যখন ঘুরে দাড়াচ্ছে তখনও শিশুদের নিয়ে ভেবেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময় প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেন। ১৯৭৩ সালের কথা, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, শিশুদের শিক্ষার গুরুত্বের কথা ভেবে তিনি ১১ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন অল্প সময়ের মধ্যেই।
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ঘাটতি হলেই কষ্টার্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। তাই তিনি শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে মনোযোগী হন। শুধু লেখাপড়া নয়, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা শিশুদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ তাও তিনি উপলব্ধি করেন। বঙ্গবন্ধু চাইতেন, শিশুরা হাসবে, গাইবে, ছবি আঁকবে, গল্প লিখবে। হাসি, খেলার মাঝেই শিশুদের প্রতিভা বিকশিত হবে। তিনি কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘরকে একত্রিত করে এই দুটোকে সরকারি শিশু প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন।
শিশুদের ভবিষ্যৎ, শিশু সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিশু সংগঠন, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের সুবিধাগুলোর ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন এই রাষ্ট্র নেতা। দেশকে, জাতিকে ভালো নাগরিক উপহার দিতেই শিশুদের জন্য় ভিত্তি স্থাপনের পরিকল্পনা করেন বঙ্গবন্ধু।
কোনো অনুষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে দেখা হলেই শেখ মুজিবুর রহমানের ভালোবাসার প্রতিফলন দেখা যেত। তার আন্তরিকতায় শিশুরা মুগ্ধ হতো। ছুটে যেতো প্রিয় নেতার কাছে। বঙ্গবন্ধুর অমলিন হাসির সঙ্গে মিশে যেত শিশুরাও।
শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লক্ষ্যে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালুর কথা ভাবেন বঙ্গবন্ধুই।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ গ্রন্থের ‘সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের হাতে প্রাথমিক শিক্ষা’ প্রবন্ধে লেখা রয়েছে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের “The Primary Schools (Taking Over) Act প্রণয়ন করেন। ওই সময়ই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই, অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। মেধাবীদের বিনামূল্যে পোশাকও দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
১৯৬৩ সালের কথা। ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজন করা হয় দশ দিনব্যাপী শিশুমেলা। ওই শিশুমেলায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’
১৯৭২-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন যান। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে ওই সময় রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধায়’ যান। ওই ছবিতে ছিল মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য। ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছবি হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সারাটা দিনের মধ্যে এইটুকুই আমার শান্তি। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’