‘সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন। পাশের বেঞ্চে বসা মেয়েটি প্রায়ই তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মাঝে মাঝে নিজের চোখও সেখানে চলে যায়। মেয়েটি দেখতে বেশ। কিন্তু কখনো কথা হয়নি। তবে বুঝতে পেরেছি মেয়েটি হয়তো আমাকে পছন্দ করে। আগ বাড়িয়ে কথা না বললেও তার চোখের চাহনি আর তার লাজুকতায় ভালো লাগা প্রকাশ পায়। আমারও ভালোই লাগে। এভাবে নীরবেই একটা বছর কেটে যায়।’
অষ্টম শ্রেণিতে উঠি দুজনই। কিন্তু ক্লাসরুম এবার ভিন্ন। ক্লাস শেষে মেয়েটি স্কুলের বারান্দায় অপেক্ষা করে। যতক্ষণ আমি না বের হই সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গে তার বান্দবীরাও থাকে। কিন্তু এতটা সময় পার হলেও কথা হয়নি কখনো। আমার বন্ধুরাও ব্যাপারটা খেয়াল করে। একদিন ওরাই জোর করে যেন আমি নিজেই কথা বলি। মনে মনে আমিও তাই চাচ্ছিলাম। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে। ওই দিনই কথা বলব বলে ঠিক করি। যেমন প্ল্যান তেমনই কাজ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে তে ক্লাস শেষে আমি ওর ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। ক্লাস থেকে বের হতেই ওকে স্কুলের বাইরে আইসক্রিম দোকানের কাছে যেতে বলি। ও একটু ইতস্ততা বোধ করছিল! কিন্তু অমতও করেনি। আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই একটা চকবার আইসক্রিম আর একটা গোলাপ নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আমায় ভালোবাসো? প্রত্যুত্তরে ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো? সেই দিন দুজনের প্রশ্নের মধ্যেই দুজন উত্তর পেয়ে যাই। সেই থেকে শুরু পথ চলা।‘
‘এরপর অসংখ্য চিঠিতে ভালোবাসার প্রকাশ, দেখা করার প্রহর গোনা, পরিবারকে জানানো, সবার মেনে নেওয়া, অবশেষে অনার্স ফাইনালের আগেই বিয়ে। এভাবেই পেরিয়ে গেছে কতটা বছর! এখন ৬ বছরের একটি মেয়েও আছে আমাদের। সবকিছুর পরও এখনো সব নতুন মনে হয়। মনে হয় প্রতিদিনই নতুন করে আবিষ্কার করছি একে অন্যকে। ভালোবাসার অনুভূতি সত্যিই সুন্দর। যদি প্রিয়জন পাশে থাকে মুহূর্তগুলো আরও সহজ হয়।“
নিজের ভালোবাসার কথা এভাবেই প্রকাশ করছিলেন রূপম আহমেদ। ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিনি। স্ত্রী রেজওয়ানার সঙ্গে পথচলার গল্পটি কতটা সুন্দর তাই জানাচ্ছিলেন। তাদের মতো অসংখ্য প্রেমিক যুগলের কাহিনি হয়তো এতটাই সুন্দর। আবার অনেকে হয়তো দূরে থেকেও ভালোবেসে যাচ্ছে একে অন্যকে। পথচলা একসঙ্গে না হলেও পথে দেখা হতেই ভালোবাসার অনুভূতি হৃদয়ে নাড়া দিচ্ছে।
সব প্রেম সফল হয় না। আবার সফল প্রেমের অনুভূতিও কি একই রকম থাকে? থাকে, প্রকৃত ভালোবাসার অনুভূতি, ভালো লাগা হয়তো একই রকম থাকে। শুরুর দিনের মতোই উপলব্ধিটাও সারাজীবন জীবন্ত থাকে। তবে এতটাই সহজ হয় না। এরজন্য় শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। একে অন্যকে বোঝার প্রয়োজন হয়। অভিযোগের খাতা না টেনে বোঝাপড়াটা শিথিল রাখতে হয়। সম্পর্ককে লালন করতে হয়। তবেই তো ভালোবাসা আরও সুন্দর হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে ঘটা করে ভালোবাসার প্রকাশ করতেই হবে, তা কিন্তু নয়। তবে প্রিয়জনের খুশিতে বিশেষ দিনটি উদযাপন করাই যায়। এর চেয়ে আরও ভালো হয়, প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্তকে বিশেষ করে তোলা।
রূপম ও রেজওয়ানার ভালোবাসার সার্থকতা মূলমন্ত্র কী ছিল, সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তারা বলেন, ‘এতো বছর পেরিয়েছে কখনো একঘেয়েমি মনে হয়নি। প্রতিদিনই নতুন করে আবিস্কার করেছি নিজেদের। অল্পতেই আমরা খুশি হয়েছি। কখনো চাহিদা ছিল না। বরং যা পেতাম তাতেই সারপ্রাইজ হতাম। সেই খুশি ছিল অন্য রকম। নিজেদের শখগুলোকে একসঙ্গে পূরণ করেছি। খারাপ সময়ে পাশে থেকে দুজনই মোকাবিলা করেছি। কোনো মুহূর্তই কঠিন মনে হয়নি। বরং পথচলা আরও সহজ হয়েছে।’
ভালোবেসে রেজওয়ানাকে ‘রোজ’ ডাকেন রূপম। কারণ রোজ মানে গোলাপ, যা রূপমের ভীষণ পছন্দ। পছন্দের ফুলটি প্রতি বৃহস্পতিবার প্রিয় স্ত্রীর জন্য় নিয়ে আসেন। রেজওয়ানাও এত বছরে সেই অভ্যাসেই অভ্যস্ত। ভালোবাসার উপহারের প্রতিদানে ওই দিনটিতে নতুন কিছু রান্না করে এখনো চমকে দেন রূপমকে। এটাই হয়তো ভালোবাসা, ভালো লাগা আর ভালো থাকার চিরন্তন রূপ।