• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

নকশাল আন্দোলন খুবই নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয় : রাজা সরকার


অঞ্জন আচার্য
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩, ০৪:৫২ পিএম
নকশাল আন্দোলন খুবই নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয় : রাজা সরকার

রাজা সরকার। পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রথাবিরোধী লেখক। লেখেন কবিতা, প্রবন্ধ, গদ্য। দুঃসহ সংগ্রামী জীবন তাঁর। জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জের শ্রীমন্তপুর গ্রামে। ছেলেবেলায় দাদুর হাত ধরে তাঁর দেশান্তর ঘটে। শিলিগুড়িতে থাকতে তিনি ছিলেন হাংরি জেনারেশনের একজন। সেখান থেকে করতেন হাংরি মুভমেন্ট। কলেজ-জীবনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে। তারপর জীবনবাস্তবতায় জীবিকার সন্ধান করতে হয়। চাকরি মেলে ফুড করপোরেশনে। সেখানেও দুর্বিষহ কাজ করতে হয় তাঁকে। এখন পুরোদস্তুর অবসর জীবন। পড়াশোনা আর লেখালেখি নিয়েই কাটে পুরোটা সময়। মননশীল, রুচিবান, আধুনিক চিন্তাশীল ও স্পষ্টভাষী এই মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ঢাকায়। কথা হয় তাঁর নকশালে সম্পৃক্ততা নিয়ে। অকৃত্রিম আন্তরিক মানুষটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অনেক অজানা কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অঞ্জন আচার্য


সংবাদ প্রকাশ : আপনি কীভাবে নকশালের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন?
রাজা সরকার : তখন কলেজে পড়তাম। সে সময় কলেজগুলো মোটামুটি নকশালের বড় ঘাঁটি। সেখানেই পরিচিত ক্লাসমেট বা পাড়ার বন্ধুবান্ধব মিলেই এইটার সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি হতে থাকে। তবে এটা ঠিক, তখন সব যুবককেই নকশাল হিসেবে পুলিশ ধরত। কোনো যুবক কোনো কারণে যদি পুলিশের চোখে পড়ত, তাহলে প্রথমেই ধরে নিতে হতো নকশাল। ফলে তখন আমরা প্রত্যেকেই আত্মগোপনেরই চেষ্টা করতাম। এমন না যে, আমি নকশাদের কোনো একটা মুভমেন্ট করে আত্মগোপন করতে চলেছি। আমার সঙ্গে অমুকের বন্ধুত্ব ছিল, সে হয়তো নকশাল হিসেবে ধরা পড়েছে ওর কাছ থেকে হয়তো পুলিশ আমার নামটি বের করেছে। কার সঙ্গে তুই আগের দিন আড্ডা দিয়েছিস বল— পুলিশ হয়তো আমাকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। যদিও আমাকে কখনো সেভাবে পুলিশ খোঁজেনি। এভাবেই ধরা পড়তে শুরু করেছিল অনেক বন্ধু। আমিও বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলাম।

সংবাদ প্রকাশ : ইতিহাস থেকে যত দূর জানা যায়, সেই অন্দোলনটিকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল।
রাজা সরকার : খুবই অসংগঠিত একটি আন্দোলন ছিল। কোনো খেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে শাসকগোষ্ঠীর এই আন্দোলনকে দমন করতে খুব একটা সময় লাগেনি। সিদ্ধার্থ রায় ইলেকশনে জিতে দিল্লির পরামর্শে বা নিজের ইচ্ছতেই হোক আন্দোলনটাকে কম সময়ে দমন করলেন। এবং সেটা ছিল খুব নিষ্ঠুরভাবে, মানে খুবই নিষ্ঠুরভাবে। স্বাধীনতার পরে অন্তন স্বাধীন দেশে এইটা আশা করা যায় না।

সংবাদ প্রকাশ : নকশালকর্মী হিসেবে সেই আন্দোলনকে এই সময়ে এসে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাজা সরকার : ওই সময়ে আমাদের যে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল, সেটা এই আন্দোলনের পক্ষেই যায়। সাংঘাতিক দারিদ্র্য। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গকে ব্যাপকভাবে শরণার্থীদের বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছিল। এসব কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক কাঠামোটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। তারপরে ৬৭ সাল থেকে অর্থনৈতিক মন্দা চূড়ান্ত আকার নেয়। খাদ্যসংকট, খাদ্যাভাবের ফলে খাদ্য আন্দোলন চলছিল। সেটা খুব আলোচিত। আমরা নিজেরাই শৈশবে দুই কেজি চালের জন্য অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছি। জঙ্গল পার হয়ে গ্রামীণ হাট থেকে চাল কিনে এনেছি। সাংঘাতিক খারাপ অবস্থা দিয়েই যাচ্ছিল তখন। এই সব, মানে একটা বিপ্লবের পক্ষের অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বৈপ্লবিক যে কার্যক্রমটা শুরু করা হচ্ছে, সেই জায়গাতে আমার আপত্তি ছিল এবং এটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ় হয়ে যায়। কারণ, একটু বড় বড় দলের রাজনীতি যারা করেন তারা জানেন, এটা যদি আমি কোনো দমন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাই তাহলে আমাকে অনেকগুলো দিক ভেবে দেখতে হয়। আমার নিজের শক্তি, প্রতিপক্ষের শক্তি এবং সেই পরিকাঠামো আমি তৈরি করতে পেরেছি কি না? সেটা জানা জরুরি। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় না এগুলোর সম্পর্কে পরিসংখ্যান বা সার্ভে ততখানি নিখুঁতভাবে হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দিয়ে বিপ্লব আধুনিক সময়ে এসে সম্ভব না। চীনা বিপ্লবকে প্রদর্শন করা হতো। মানে দেখানো হতো, চীন এভাবে এভাবে করেছে। সত্তরের দশকে চীনা বিপ্লব হলো, মানে চীন স্বাধীন হলো ১৯৪৯-এ। সেসময়ের চীনের অবস্থা এবং ভারতবর্ষের অবস্থা আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ভারতবর্ষে রেগুলার সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী তখন আছে। ভারতবর্ষের রেল ব্যবস্থা একটা বিস্তৃতভাবে ছড়ানো। রাস্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থা মিলিটারি শিপমেন্ট খুব দারুণ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। সেখানে চায়নার অবস্থা ছিল খুব আদিম মিশেল অবস্থা ছিল। কিছু কিছু জায়গা একটু উন্নত আর দেশের বিশাল অংশ সাংঘাতিক অনুন্নত। যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সেখানে যে লংমার্চ হয়েছিল, সেই লংমার্চের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়, কী ধরনের জায়গাগুলো দিয়ে তারা অতিক্রম করেছে। আমাদের দেশে এ ধরনের তো জায়গা পাওয়া যাবে না। যেসব জায়গায় পাওয়া গেছে সেসব জায়গায় আন্দোলনটা কিছুদিন টিকে গিয়েছিল। কিন্তু গভর্মেন্টের শক্তি সেসব জায়গায় গেছে, বিলম্ব হলেও গেছে। ফলে চায়নার এই কার্যক্রমটাকে যারা দেখিয়ে বলত যে, ওখানে যদি বিপ্লব হয় তবে আমাদেরও হতে পারে— তার সঙ্গে আমি একমত নই। কখনোই এটা হতে পারে না। এ সময় অনেকগুলো কারণই ছিল। আর রাজনৈতিক তাত্ত্বিকতার দিকটা কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রথম শুরু হয়েছি ১৯২০-এ। প্রথম দিকে তারা কিছুটা গণতান্ত্রিক ধারায় কংগ্রেস যে রকম কাজ করছিল, সে রকমই কাজ করছিল। তবে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি শুরু থেকে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে সংগঠন করে তাদের সুবিধার দিকে নজর দেওয়া বা মালিক শ্রেণির যে অন্যায় শোষণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছিল। কিন্তু ক্রমশ কমিউনিস্ট পার্টি যেহেতু আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রাখে, তাদের মধ্যে একধরনের ভাবনা এলো, তারা যে ধরনের কাজ করছে এগুলো দিয়ে দেশের কোনো উন্নতি হবে না। বড়জোর শ্রমিকদের কিছুটা উন্নতি হবে, যেটাকে আমরা বলি সংশোধনবাদ। আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হলো, ক্ষমতা দখল করতে হবে। ক্ষমতা দখল করতে পারলে আমরা আমূল বদলে দেবো। এখানে আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করবো। তখন তো অনেক মডেল ছিল। চীন বা রাশিয়া মডেল কাজ করছিল। এসব করতে গিয়ে শুরু থেকে অনেক শাখা গঠন করা হয়। আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তখনো সেভাবে এইটা হয়নি। তারপর তো পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো ভাগ হলো। সিপিআই থেকে সিপিআইএম, সিপিআইএল, সিপিআইএমএল— এভাবে ভাগ হয়। তাত্ত্বিক পার্থক্যের জন্য তারা ভাগ করল আরকি। তারপর সিপিএমএল সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দিল। তার পরিণতি তো আপনারা জানেন।

সংবাদ প্রকাশ : নকশালবাড়ি গ্রাম থেকে সেই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী ছিল?
রাজা সরকার : নকশালবাড়ি তো কৃষক আন্দোলন দিয়েই শুরু হয়েছিল। নকশালবাড়িতে তখন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পরে, যেহেতু নকশালরাও কমিউনিস্ট পার্টির খুব উৎসাহ জাগায়, তাই সেই আন্দোলনে পুলিশ খুব ম্যাসাকার করে। যারা আন্দোলন করছিল, তারাও জমি দখলের আন্দোলনটা করছিল। এটা খুব পরিতাপের ব্যাপার, এই জিনিসটাকে ইচ্ছা করলে গভর্মেন্ট হয়তো শুধরে দিতে পারত। তখন তো বামপন্থীরাই ক্ষমতায় ছিল। তখন অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রী, হরেকৃষ্ণ কোঙারের মতো মানুষেরা ছিলেন। আর চারু মজুমদার বা কানু সান্যালরা তখন তাদের দলেরই মানুষ ছিলেন। তারা একরকমভাবে সামলাতে পারতেন বলে আমার মনে হয়। কিন্তু পুলিশকে পুলিশের মতো কাজ করতে দেওয়া হলো। পুলিশ তো তৎকালীন সময়ে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীনদের সুবিধাটাই বেশি দেখেছে। জমিদারের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। খুব নৃশংসভাবে তারা কিছু মানুষ, শিশু, নারী-পুরুষ মেরে ফেলল আরকি। ফলে সেটা নিষ্ঠুরতাটার স্ফুলিঙ্গ হয়ে গেল, আর কিছু না। 
তাত্ত্বিকভাবে ওইখান থেকে যে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল, এইগুলো পরে বিভিন্নভাবে লিটেরেচার করা হলো; বিভিন্ন দিকে দেখনো হলো। তারপর ব্যাপারটা ছড়িয়ে গেল, একবারে আগুন লেগে গেলে যা শুরু হয়। প্রত্যেকেই উত্তেজিত। প্রত্যেকেই ভেবেছে, এটা তৎকালীন যে সরকার গদিতে ছিল, তাদের একটা ভুল। তার প্রতিক্রিয়াবশত পরে কাজগুলো হতে শুরু করল। তো সেই সরকারও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকল না।
তারপরে এগুলো রাষ্ট্রপতির শাসনে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করল।
নকশাল আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও কিছু কিছু জায়গায় হয়েছিল। কিন্তু সার্বিকভাবে একটা রাজ্য নকশাল আন্দোলনের আওতায় চলে গেলে সেটা সরকারের পক্ষ থেকে যে নিষ্পেষণ বা নিষ্ঠুরতা হয়ে গেল, এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই হয়েছিল। ফলে কে নকশাল কে নকশাল না, এটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা না। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এর জন্য। সেই দুই-তিন বছরে যে ধাক্কা লেগেছে, সেটা সামলে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল তাদের।


অনুলিপি : খাদিজা নিপা

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!