• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

যাপিত জীবনের সবকিছু কবিতায় ধরতে চেয়েছি : হেলাল হাফিজ


অঞ্জন আচার্য
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২২, ০২:২০ পিএম
যাপিত জীবনের সবকিছু কবিতায় ধরতে চেয়েছি : হেলাল হাফিজ

কবি হেলাল হাফিজ সাহিত্য অঙ্গনে এক জনপ্রিয় নাম। তাঁর কবিতা সংকলন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। এরপর দীর্ঘ বিরতির পরে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। হেলাল হাফিজের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’- এ কবিতার দুটি পঙ্‌ক্তি “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” বাংলাভাষী কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে। সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কবির একান্ত সাক্ষাৎকার নেন সংবাদ প্রকাশ-এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক অঞ্জন আচার্য

 

সংবাদ প্রকাশ : উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আপনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সময়ের কথা জানতে চাই। 
হেলাল হাফিজ : উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আমার ধারণা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এবং প্রধান যে কবিতাটি, সেটি বোধ হয় ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

সংবাদ প্রকাশ : যত দূর জানি, কবিতাটি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আহমদ ছফা ও হুমায়ুন কবিরের ভূমিকা আছে।
হেলাল হাফিজ : হ্যাঁ। আহমদ ছফা আর কবি হুমায়ুন কবির—এই দুজন আমাকে নিয়ে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিবের কাছে নিয়ে যান। কবিতাটা হাবিব ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “হাবিব ভাই এ আমাদের এক তরুণ কবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ে।” আহসান হাবিব অনেক বড় মাপের কবি, উনি কবিতাটা পড়েন আর আমার দিকে তাকাতে থাকেন। দেখছেন আমাকে। আমি তখন বাচ্চা, পড়া শেষ করে আরও এক-দুবার পড়লেন। পড়েই ছফাকে বললেন, “ছফা এই কবিতাটা আমি দৈনিক পাকিস্তানে ছাপতে পারব না। কারণ, দৈনিক পাকিস্তান সরকারি কাগজ আর কবিতাটি হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী কবিতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেখা। সশস্র সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয়েছে এই কবিতার মাধ্যমে। এটা ছাপলে আমার চাকরি তো যাবেই, কাগজটাও বন্ধ হয়ে যাবে, আরও কত কী যে হবে! তাই আমি কবিতাটি ছাপতে পারলাম না। তবে হেলালের আর কবিতা না লিখলেও চলবে—এই কথাটা বললেন উনি (আহসান হাবিব)। বড় কবি তো বুঝতে পেরেছেন যে, এই ভূখণ্ডের তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি মানুষের তীব্র যে আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষা এই কবিতায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। হাবিব ভাই আর ছাপলেন না কবিতাটা। আমরাও চলে এলাম। কিন্তু কবিতাটির প্রথম দুটি লাইন ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ ছফা ভাই ও হুমায়ুন কবির এক রাতে সমস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে টিকা মেরে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কবিতা রণাঙ্গনের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তাদের মুখে মুখে ছিল এই কবিতাটি। স্বাধীনতার পরে, বিশেষ করে বাম রাজনীতি যারা করতেন, হক, তোহা, সিরাজ শিকদার গ্রুপ—এরা এই কবিতাটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা শুরু করল। কবিতাটি আমাকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে সমাজে একটু পীড়ন থাকবে, নির্যাতন থাকবে, শোষণ থাকবে, সেই সমাজে এই কবিতা থাকবেই—এটা বাদ দেওয়া যাবে না।

সংবাদ প্রকাশ : আপনাকে সবাই প্রেম ও বিরহের কবি হিসেবে জানেন। কিন্তু আপনার কবিতায় তো রাজনীতির বেশ সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
হেলাল হাফিজ : আমি কখনো মিছিলে যায়নি, কখনো রাজনীতি করিনি, কখনো কোনো ছাত্রসংগঠনের সদস্য ছিলাম না। কর্মজীবনে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলাম না বা সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। কিন্তু আমার কবিতা তুমি পড়ে দেখবে, প্রেম-বিরহের পাশাপাশি তার চেয়েও বেশি বোধ হয় রাজনৈতিক কবিতা।

সংবাদ প্রকাশ : ছাত্রজীবনে আপনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন।
হেলাল হাফিজ : তখন আমি অনার্স পরীক্ষা দেব ১৯৭২ সালে, তখন আমি পূর্ব দেশের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে চাকরি পাই। তুমি আব্দুল গনি হাজারীর নাম হয়তো শুনেছ। ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ তার বিখ্যাত কবিতা। উনি ছিলেন ডেইলি অবজারভার ভবনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমি আ স ম আব্দুর রব ভাইকে বললাম যে, রব ভাই আমার তো সাংবাদিকতা করার খুব ইচ্ছা, আপনি যদি একটু পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদক এতেশাম হায়দার চৌধুরী ভাইকে একটু বলে দেন। তো রব ভাই বলে দিয়েছেন। আমি যেহেতু ছাত্র, তাই ফুলটাইম চাকরি দিতেও পারছেন না। তবে হাজারী ভাই এডিটরকে বললেন যে, এই ছেলে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতা লিখেছে। সে ছাত্র না ব্যবসায়ী, এগুলো কোনো ব্যাপার না। আপনি আজকেই তাকে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার দেন। ওই পূর্বদেশে চাকরি শুরু করি।

সংবাদ প্রকাশ : সাংবাদিকতায় আসার পেছনে প্রেরণা কী ছিল?
হেলাল হাফিজ : আমার মডেল ছিলেন কবি আহসান হাবিব। ওনাকে দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ এবং স্বাধীনতার পরে ‘দৈনিক বাংলা’য় ওনাকে দেখেছি যে, কি  আন্তরিকতার সঙ্গে তরুণ লেখকদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। আমি ওনাকে অনুসরণ করেছি, বিশেষ করে মফস্বল থেকে যেসব লেখা আসত, আমি সেগুলো খুব যত্ন করে পড়তাম এবং ছাপার যোগ্য মনে হলে একটু পরিমার্জনা করে হলেও মফস্বলের লেখা বেশি ছেপেছি।

সংবাদ প্রকাশ : আপনাদের সময়ের সাহিত্য ও বর্তমান সাহিত্যকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
হেলাল হাফিজ : সাহিত্য তো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিবর্তন হবেই। কবিতা বলো, উপন্যাস বলো, গল্প বলো, প্রবন্ধ বলো—সবকিছুরই সমকালীন অবস্থা তো থাকবেই। সেটার প্রতিফলন তো সাহিত্যে থাকবেই। এখন যারা লেখালেখি করছেন, তারা এখনকার সময়কে ধরার চেষ্টা করছেন, এটাই স্বাভাবিক। আমার একটি কবিতাই আছে, ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ের শেষ কবিতাটি, ‘আগামী তোমার হাতে আমার কবিতা যেন থাকে দুধে ভাতে।’ আমি তো আর এখন ১৯৭০ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাকে ২০২২-২৩-এর কথাই ভাবতে হবে। সাহিত্যের যে জোয়ারটা এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের পর বিশেষ করে কয়েকটি ক্ষেত্রে, যেমন : কবিতা, নাটক—এই দুটি ক্ষেত্রে ব্যাপক একটা জোয়ার এসেছিল। সেটা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে গিয়েছে নানা কারণে।

সংবাদ প্রকাশ : এখন আপনি কেমন আছেন, কীভাবে চলছেন?
হেলাল হাফিজ : এখন তো পড়তে-লিখতে খুবই অসুবিধা হয়। সব মিলিয়ে একটু নাজুক অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছি। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবরা কিছু সহযোগিতা করেন। হোটেলে আজ যেখানে আছি, সেখানেও হোটেলের কর্মচারীরা বেশ ভালো। আমাকে সহযোগিতা করেন। এভাবে দিন কাটছে।

সংবাদ প্রকাশ : আর কোনো সমস্যা বোধ করছেন কি না?
হেলাল হাফিজ : এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সময় কাটে না। যেহেতু চোখের প্রবলেম, তেমন করে বই পড়তে পারি না, লেখালেখি করতে পারছি না। বই পড়তে পারলে সময় খুব সহজেই কেটে যেত।

সংবাদ প্রকাশ : করোনার সময়টায় কোথায় কীভাবে ছিলেন?
হেলাল হাফিজ : করোনার আগে আমি সেগুনবাগিচায় আরেকটি হোটেলে থাকতাম। করোনা যখন মহামারি আকারে দেখা দিল, তখন তো সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেল। গত ৫০ বছর ধরে আমি তো তিন বেলা প্রেসক্লাবে খেতাম, প্রেসক্লাবেই সময় কাটত। চাকরির জায়গা এবং প্রেসক্লাব, এই দুটি মিলেই আমার সময়। আমার তো আসলে গৃহ বলতে প্রেসক্লাবই। সেটাই আমার প্রথম গৃহ। সেই প্রেসক্লাবও করোনার সময় লকডাউন হয়ে গেল। তখন মহাসমস্যায় পড়লাম। যাহোক আমার বড় ভাই তখন আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল এবং সেখানে প্রায় এক বছর ছিলাম। তারপর করোনার প্রভাব যখন একটু কমলো, তখন এই শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেলে নতুন করে জীবন শুরু করলাম।

সংবাদ প্রকাশ : বিয়ে করেননি কেন?
হেলাল হাফিজ : আমি বিয়ে করিনি এটা ঠিক না, আমাকে কেউ বিয়ে করেনি। সে জন্য আর হয়ে ওঠেনি। আমার তো ইচ্ছা ছিল, ব্যাটে-বলে হয়নি।

সংবাদ প্রকাশ : এই সময়ে এসে কোনো সঙ্গীর অভাব বোধ করেন কি না?
হেলাল হাফিজ : গোধূলিলগ্নে একটু মন চায়, পাশে একজন থাকলে ভালো হতো, যতটা না শারীরিক চাহিদার জন্য তার চেয়েও বেশি একটা মানসিক সাপোর্ট। মানসিকভাবেই ভারটা, বোঝাটা ভাগাভাগি করতে পারলে ভালোই লাগত। সেটি আর হয়ে ওঠেনি। একা একাই এই পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে আর কি!

সংবাদ প্রকাশ : লেখালেখির জগতে এলেন কী করে? কোনো অভিঘাত আছে কি?
হেলাল হাফিজ : আমি ছিলাম খেলাধুলার মানুষ, ফুটবল-ব্যাডমিন্টন-ভলিবল খেলতাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃহীনতার বেদনাটা আমাকে উথলা করে দিত। যত বয়স বাড়ছিল ততই আমি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। মা যখন মারা যান, তখন তো আমার বোধশক্তি হয়নি; মাত্র তিন বছর বয়স। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই বেদনাটা এত তীব্র হলো এবং গ্রাস করে দিল যে, এই বেদনা বোধটা খেলাধুলা দিয়ে প্রশমিত করতে পারছিলাম না। ফলে একটু লেখালেখি, কবিতা আবৃত্তি এবং ছড়া লেখা— এসব দিকে চলে এলাম।

সংবাদ প্রকাশ : আড়ালে কারও কোনো অনুপ্রেরণা ছিল কি?
হেলাল হাফিজ : শৈশব-কৈশোরে আমার জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন যিনি, তার নাম সবিতা সেন। আমার চেয়ে ১৩-১৪ বছরের বড়। মায়ের মতোই উনি খুব বিদূষী এবং রূপসী মহিলা ছিলেন। আমার মায়ের অনেকটা অভাব পূরণ করেছেন তিনি। আমার শিল্প-সাহিত্যের এই যাত্রায় আমাকে যোগ্য করে তোলার জন্য তার অনেক অবদান। আমার আব্বা এবং সবিতা মিস্ট্রেস— এই দুজনের অবদান সবচেয়ে বেশি আমার আজকের যে হেলাল হাফিজের সামনে যে তুমি বসে আছ, তার গঠনপ্রক্রিয়ায় এই দুজনের অবদান সবচেয়ে বেশি।

সংবাদ প্রকাশ : কবিতার মধ্য দিয়ে আপনি কী ধরতে চেয়েছেন?
হেলাল হাফিজ : যাপিত জীবনে আমার সময়ে এই ভূখণ্ডে যা যা ঘটেছে, সবকিছু আমি ধরতে চেষ্টা করেছি।

সংবাদ প্রকাশ : এই সময়ে এসে মৃত্যুচিন্তা হয়?
হেলাল হাফিজ : মৃত্যুর জন্য তো আর চিন্তা করতে হয় না। এটা আসবেই, বয়স যত বাড়ে একধরনের অনুভূতি প্রবল হতে থাকে। বিদায় নিতে হবে, বিদায় তো নিতে হবেই। এটার বিশেষ কোনো পরিবর্তন আমার মগজে বা মনে আসে না। এগুলো স্বাভাবিক হিসেবে আমি নিয়ে থাকি। তবে সুস্থভাবে বিদায় নিতে পারলে ভালো। এই যে আমি বছরের পর বছর অসুস্থ অবস্থায় থাকি, এটা খুবই কষ্টকর।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!