• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

গাজায় বড় হুমকি কলেরা ও সংক্রমণ রোগ


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৩, ০৫:১০ পিএম
গাজায় বড় হুমকি কলেরা ও সংক্রমণ রোগ
দ্বিগুণ দাম দিয়ে পানি কিনছে গাজার কিছু পরিবার। ছবি-এএফপি। আল জাজিরা

মানবিক সংস্থাগুলো  সতর্ক করে বলেছে, গাজায় যদি সাহায্য প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া হয়, তবে  মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে পানিবাহিতসহ নানা সংক্রামক রোগ।

ওয়াসিম মুশতাহারের চার সন্তান প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে। গণিত বা ভূগোল শেখার পরিবর্তে তাদের এখন শেখানো হচ্ছে কীভাবে পানি ভাগাভাগি করে নিতে হয়।

দক্ষিণ গাজা শহরের খান ইউনিস থেকে আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়াসিম মুশতাহার। তিনি বলেন, “আমি দুর্গত মানুষদের প্রত্যেকের জন্য প্রতিদিন পানির বোতল ভর্তি করি এবং তাদের বলি, আপনারাও আমার মতো এই কাজটি করার চেষ্টা করুন।” 

তিনি আরও বলেন, “শুরুতে তারা লড়াই করেছিল, কিন্তু এখন তারা ভয়ানক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।”

গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ১.১ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিকে এলাকা ছেড়ে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েল। ওই আদেশ জারির পর মুশতাহা তার স্ত্রী এবং আট থেকে ১৫ বছর বয়সী সন্তানদের নিয়ে খান ইউনিসে তার খালার বাড়িতে ওঠেন। গাজার খান ইউনিসের বাসিন্দারা ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত আত্মীয় স্বজনদের জন্য সার্বক্ষণিক দরজা খুলে রেখেছিলেন।

বিশ্বব্যাপী ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অক্সফামের কর্মকর্তা মুশতাহা। তিনি তার আশপাশের অবস্থা দেখে অনুমাণ করছেন এখানে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মতো ঘটনা ঘটবে।

তিনি বলেন, “মানুষ রাস্তায়, দোকানে, মসজিদে ও গাড়িতে ঘুমায়।” মুশতাহার পরিবার দুইশ বর্গমিটার অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় ১০০ জন লোকের সঙ্গে বসবাস করে এবং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। 

 গাজার খান ইউনিসের একটি দোকান থেকে অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রি কেনার চেষ্টা করছেন ফিলিস্তিনি দুর্গতরা। 

এদিকে গাজার  সুপার মার্কেটগুলোতে উধাও হয়ে গেছে স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন পণ্য। সৌরিবিদ্যুতচালিত ছোট ওয়াটারপাম্পগুলোতে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণ। স্থানীয় মুদ্রায় ৩০টাকার পানির বোতল এখন ৬০ টাকা।

বুধবার (১৮ অক্টোবর), মুশতাহা ধারনা করছিলেন ২৪ ঘণ্টা পর তাদের সব পানি শেষ হয়ে যাবে। এরপর কী হবে তা জানতেন না। মুশতাহা বলেন, “আমরা বাজারে গিয়ে যাই পাই তাই কিনব। আমরা অন্ধকার চোখে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি।”

অক্সফাম ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, গাজায় পানি ও স্বাস্থ্যসেবার সবকিছুই বন্ধ। যদি জরুরি ভিত্তিতে এখানে মানবিক সেবা দেওয়া না হয় তাহলে এখানে সংক্রামক রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

সাত অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় পানির লাইন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাসহ পয়ঃনিষ্কাশন প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল।

একইসঙ্গে গাজার ৬৫টি পয়ঃনিষ্কাশন পাম্পিং স্টেশনের বেশিরভাগ এবং পাঁচটি বর্জ্যজল শোধনাগারের কাজ বন্ধ করতেও বাধ্য করা হয়েছে।

অক্সফামের মতে, অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য এখন সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক বর্জ্য জমেছে পথের পাশে। অনেক এলাকায় দাফনের অপেক্ষায় পড়ে আছে মানুষের লাশ।

ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টগুলোর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে গাজার পৌরসভাগুলো আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহ করতে পারছে না। যে কারণে কিছু লোক গাজার একমাত্র লবণাক্ত জলাশয় থেকে তাদের পানির চাহিদা পূরণ করছে। ওই জলাশয়টিতে রয়েছে শহরের নর্দমা ও সমুদ্রের দূষিত পানির সংযোগ। বাধ্য হয়েই এই দূষিত পানি পান করছে গাজার বাসিন্দারা। আবার কেউ কেউ গবাদিপশুর খামারের যে কূপ, সেই কূপের পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।

জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় বর্তমানে ধোয়া, রান্না করা ও টয়লেট ফ্লাশ করাসহ সমস্ত চাহিদা মেটাতে জনপ্রতি দিনে মাত্র তিন লিটার পানি পাওয়া যাচ্ছে।

দাতব্য সংস্থা ইসলামিক রিলিফের এক কর্মী যিনি খান ইউনিসের এক বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, তিনিও একই পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন আল জাজিরার কাছে।

ওই কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার বাবা-মায়ের বাড়িতে,২০ জন শিশু ও ৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক আশ্রয় নিয়েছেন। বাসায় এত লোক রেখেও আমরা দিনে দুবার টয়লেট ফ্লাশ করি- একবার সকালে, একবার রাতে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন খাবার রান্না করি যেগুলোতে সবচেয়ে কম পানি ব্যবহার করা হয়। আমরা শুধু একবার বা দুবার নামাজের জন্য গোসল করি। আমাদের প্রতিবেশীর একটি কূপ আছে, কিন্তু তার কাছে পানি পাম্প করে তোলার মতো বিদ্যুৎ নেই। তাদের জেনারেটর আছে কিন্তু জ্বালানি নেই।”

যাদের কোনো আশ্রয় নেই, তাদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। এমন পরিবার রয়েছে যেখানে শিশু ও নবজাতক শিশু আছে। তারা খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। তারা অনিরাপদ অবস্থায় খাদ্য-পানিবিহীন রাস্তার পাশে বসে আছে।

পানিবিহীন গাজার বর্তমান পরিস্থিতি, মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা বাড়ছে। মানবিক সংস্থাগুলো বারবার রাফাহ ক্রসিং-এ মজুত করা সাহায্যগুলো গাজায় পাঠাতে বারবার জরুরি আহ্বান জানাচ্ছে।

বুধবার ইসরায়েল সফরের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, গাজায় সহায়তা প্রদানের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। 

তবে, ইসরায়েল ওই আলোচনায় বলেছে, সমস্ত ট্রাক অবশ্যই পরীক্ষা করা উচিত এবং হামাস যোদ্ধাদের কাছে কোনো সাহায্য পৌঁছানো উচিত নয়। বাইডেন আরও বলেন, মিশর রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজায় সাহায্যের ২০টি ট্রাকের প্রাথমিক কনভয়কে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে।

অক্সফামের মানবিক নীতির প্রধান ম্যাথিউ ট্রাসকট বলেছেন, সীমান্তের ওপারে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে পানি ও ওষুধের স্তূপ রয়েছে। তবে এগুলো এখনি গাজায় না পাঠালে রোগগুলো ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন।

এই কর্মকর্তা বলেন, “কলেরা অনেকগুলো পানিবাহিত রোগের মধ্যে একটি। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখনি মানবিক সহায়তা পেলে প্রতিরোধ সম্ভব। কিন্তু যেখানে এখনো বোমা পড়ছে সেখানে আপনি মানবিক অপারেশন প্রদান করতে পারবেন না।”

জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস বুধবার গাজায় “মানবিক দুর্ভোগের মহাকাব্য” কমাতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

সূত্র-আল জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে। 

Link copied!