• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জয়নুল কেন জরুরি


হাসান শাওন
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৩, ১০:৩৯ এএম
জয়নুল কেন জরুরি
জয়নুল আবেদিন, জন্ম : ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪, মৃত্যু : ২৮ মে ১৯৭৬

আজ ২৮ মে, জয়নুল আবেদিনের প্রয়াণ দিবস। এই শিল্পাচার্যের আবির্ভাব ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর, কিশোরগঞ্জে। বহু কারণে আজকের সময়েও জয়নুল বড় জরুরি। তিনি না এলে আমরা হয়তো পড়ে থাকতাম বেহুদা বিবাদে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান মেতে থাকতো ছবি আঁকা হারাম, না হালাল তা নিয়ে। কম কথা বলে সৃষ্টিকর্ম দিয়ে জয়নুল আবেদিন এর জবাব দিয়েছেন। এ অঞ্চলের শিল্পচর্চায় তাকে বলা যায় এক রেনেসাঁর ঢেউ তোলা ব্যক্তিত্ব।

শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ বলে কিছু নেই। প্রতিকূলতায় প্রকৃত শিল্পী জানেন তার করণীয়। আমৃত্যু জীবন সংগ্রামী জয়নুলের কর্ম এর বাইরে নয়। শৈশব থেকেই ছবি আঁকতেন তিনি। স্বপ্ন ছিল আর্ট কলেজে পড়ার। মায়ের গলার গয়না বিক্রি করে এ ছেলে কলকাতার আর্ট কলেজে পড়তে যায়। থাকার জায়গার অভাবে সে শহরে মসজিদের বারান্দায় ঘুমাতেন যিনি। অনেক রাত তার কেটেছে পার্কে ঘুমিয়েও।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ঢাকায় আসেন জয়নুল আবেদিন। তার প্রাণান্ত চেষ্টায় ঢাকায় আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠিত হয়।

জয়নুল আবেদিন তো পারতেন সমাদৃত শিল্পী হয়ে এক জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি মন দিয়েছেন প্রতিষ্ঠান গড়ায়। তার অনুপস্থিতিতেও যেখানে চলবে শিল্পচর্চা—এই ছিল তার স্বপ্ন। তবে প্রয়াণ দিবসে প্রশ্ন তুলতেই পারি কতটা বাস্তব হয়েছে শিল্পাচার্যের আমৃত্যু লালিত স্বপ্ন?  

বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অলংকরণ করেন জয়নুল আবেদিন। এ সংবিধান সামরিক ও ‘গণতান্ত্রিক’ নানা আমলে বেহাত হয়ে এখন যে দশায় পৌঁছেছে তাতে হয়তো অনন্তলোকে থাকা জয়নুল বিষণ্ণই হবেন। আদৌ কি প্রচার হচ্ছে শিল্পাচার্যের জীবন দর্শন ও শিল্প ভাবনা? রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে জনপদের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পচর্চা বিকাশের কথা ভাবতেন জয়নুল আবেদিন। এ জন্যই সোনারগাঁওয়ে তিনি গড়ে তোলেন লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন। এখানেও চলছে উন্নয়নের নামে জয়নুলের মৌলিক চিন্তার হরণ।

দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বিখ্যাত হওয়া শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলতেন, “এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর রুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।”

তার বলে যাওয়া হাহাকার ভরা এ কথার মর্মার্থ কতটা আমরা টের পেয়েছি? আমাদের চিত্রকলা কি হেঁটেছে জয়নুলের দেখানো পথে? তিনি দেখেছেন অনাহার, উপকূলের সাইক্লোন, জনযুদ্ধের গেরিলা, শ্রমজীবী নারী, উজাড় হতে থাকা নৃগোষ্ঠী। অথচ আমাদের শিল্প আঙিনার ক্যানভাসে এমন বিষয় উপজীব্য হয় কমই। যে জয়নুল বলতেন, “নদীর ছবি আঁকার আগে পানির দোলনই আগে বুঝতে হবে।” তার হাতে গড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদসহ দেশের সামগ্রিক শিল্পচর্চা প্রতিষ্ঠানগুলোর খুব অল্প অংশ এ সত্য বুঝেছে। আমরা কি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি ‘পাইন্যার মা’র সঙ্গে? শস্যের শিল্পীর ‘গুণটানা’ নজরে আসেনি আমাদের। নানা আক্রমণে ‘সাঁওতাল’ আজ বিপন্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের রাস্তার অন্য পাড়ে স্বাধীন শিল্পচর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ‘ছবির হাট’ উচ্ছেদে বড় কোনো বাঁধায় পড়েনি কর্তৃপক্ষ। বহু বছরের পুরনো গাছ কেটে সেখানে চলছে ভবন নির্মাণ।

জয়নুল আবেদিনের ভাষ্য ছিল, “যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ছবি আঁকা শিখলাম কী করে? বা কার কাছ থেকে? তবে উত্তর দিতে পারবো না। বলবো আমার দেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ আমাকে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এ দেশের আকাশ, বাতাস, নদী, মাঠ, বন, এখানকার মানুষের চলাফেরা, ওঠা-বসা, হাসি কান্না আমাকে ছবি আঁকতে বলে।”

Link copied!