• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

‘চারু মজুমদার ইস্পাত পোড়া নাম’


হাসান শাওন
প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২৩, ০৯:২৫ এএম
‘চারু মজুমদার ইস্পাত পোড়া নাম’

ভাঙছি বলেই সাহস রাখি গড়ার
ভাঙছি বলেই সাজিয়ে নিতে পারি
স্বপ্নের পর স্বপ্ন সাজিয়ে তাই
আমরা এখন স্বপ্নের কারবারি।

(চারু মজুমদার)

১৯১৯ সালের আজকের দিন শিলিগুড়ির এক সচ্ছল পরিবারে জন্মেছিলেন নকশালবাড়ি বিদ্রোহের সমার্থক প্রবাদ ব্যক্তিত্ব চারু মজুমদার। যার নিথর দেহকে পর্যন্ত ভয় পেয়েছিল নিপীড়করা। মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর হয়নি। নিভৃতে পুলিশ শ্মশানে নিয়ে যায়। তখন সমস্ত এলাকায় ছিল পুলিশি-বেষ্টনী। তার দেহ যখন আগুনের শিখা হয়ে জ্বলতে থাকে তখন তা দেখারও অনুমতি মেলেনি কারও।

চারু মজুমদার শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখান থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৭ সালে ভর্তি হন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে। প্রখর মেধাবী এই ছাত্র এরপর আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেননি।

১৯৩৯ সালে জলপাইগুড়ির সিপিআইয়ের ইউনিটে চারু মজুমদার সক্রিয় হয়ে পড়েন। চরমভাবে শোষিত কৃষকদের মধ্যে তার কাজ শুরু। সে জনপদে তখন আধিয়ার প্রথার  চেয়েও বেশি শোষণ। আধিয়ারদের ফসলের প্রায় পুরোটাই জমিদাররা লুটে নিত। আবার ওই জমিদারদের কাছ থেকেই অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হতো কৃষকদের। চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে ওঠা এই সুদ কখনোই শেষ হতো না। ঋণের বোঝায় কৃষকের প্রাণ নিভু নিভু তখন। এভাবে জলপাইগুড়ির কৃষকরা কার্যত নেমে আসেন ‘ভূমিদাস’ পর্যায়ে।

দাসত্বের এমন শৃঙ্খল ভাঙতে তখন চাই শক্ত ঝাঁকুনি। চারু মজুমদারকে পার্টি অফিসে প্রথম দেখা এক কমরেডের স্মৃতিতে ঘটনাটি উঠে এসেছে এভাবে—

. . .এক জোড়া উজ্জ্বল চোখের অধিকারী এক সপ্রতিভ, সুদর্শন যুবককে পার্টি অফিসে প্রবেশ করতে দেখি। যুবকটি বলে, ‘আমি চারু মজুমদার। আমি কৃষকদের মধ্যে পার্টির কাজ করতে চাই।’ জলপাইগুড়ির জেলা সম্পাদক প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি কষ্ট সহ্য করতে পারবে?’ চকিতে আত্মবিশ্বাসে ভরা জবাব এলো, ‘হ্যাঁ।

সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক শচীন দাশগুপ্ত এরপর চারু মজুমদারকে নিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে নিয়মিত যেতে থাকেন। বিস্তীর্ণ এলাকায় পায়ে হাঁটতেন তারা। রাতে গরিব কৃষকদের ঘরে আশ্রয় নিতেন। কোনো সময় খাবার জুটত, কোনো সময় জুটত না। কখনো কখনো তাদের খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হতো। কোনো কোনো রাত জলঢাকা নদীর ব্রিজের ওপর শুয়ে পড়তেন এই দিন বদলের স্বপ্ন দেখারা। কখনো কোনো গোয়ালঘরে ঘুমিয়ে পড়তেন। এভাবে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সামর্থ্য প্রমাণ করেন চারু মজুমদার। খুব অল্প সময়েই তিনি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এরপর চা-বাগান ও রেল-শ্রমিকদের মধ্যে পার্টির কাজ যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন তিনি সেখানেও সক্রিয় হন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় চারু মজুমদারের প্রস্তাব অনুসারেই আধিয়ারদের আন্দোলন চরমপন্থায় উন্নীত হয়। জমিদাররা তাদের শস্যের গোলা পাহারা দিয়ে রাখে। আর আধিয়ারদের মরতে হচ্ছিল অনাহারে। পার্টি তখন স্লোগান ঠিক করে, “আমরা গুলি খেয়ে মরব, তবু না খেয়ে মরব না।”

১৯৪৫ সালে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন তখন চরমে পৌঁছায়। চারু মজুমদার আত্মগোপন করে দলের কাজ চালাতে থাকেন। তার নেতৃত্বে বিশাল একটি এলাকা প্রায় মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। তেভাগার অভিজ্ঞতায় পরবর্তীকালে তিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন।

সাধারণ থেকে অসীমতার পথে চারু মজুমদারের রাজনৈতিক যাত্রা। সে পথ নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু আপসহীনতার প্রশ্নে নকশালবাড়ির প্রতিশব্দ এই ব্যক্তিত্ব অনন্য। তার রাজনৈতিক লাইন অব্যর্থ কি না, তা নিয়ে এ সময় এসে এককথায় মন্তব্য করা চলে না। কিন্তু তার দৃঢ় গণভিত্তি নিয়ে দ্বিধার কোনো সুযোগ নেই। মানতেই হবে যে, ভারতবর্ষে বিপ্লবী রাজনীতির ঢেউ তার উত্তর সময়ে আর দেখা যায়নি। লাল প্রতিরোধ যেন চারুতেই শুরু হয়ে চারুতেই শেষ হয়। তাই চারু মজুমদারকে মানতেই হবে ইতিহাসের অগ্রাহ্যতুল্য প্রবাদ ব্যক্তিত্ব রূপে। জন্মবার্ষিকীতে এই ইস্পাতসম ব্যক্তিত্বের প্রতি অপার শ্রদ্ধা।

Link copied!