ছোট ছোট ইটের সুরকি ও চুন মেশানো দেয়াল এবং লোহার বা কাঠের কড়ি বর্গার ওপরে সুরকি চুনের ঢালাই দিয়ে পাকা বাড়ি। অতিবৃষ্টির জন্য অনেক বাড়ির পাকা দেয়াল হলেও কাঠের কড়ি বর্গার ওপরে থাকত ঢেউটিনের চাল। মোগল আমল থেকে শুরু করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিলেটের বেশির ভাগ স্থাপনা ছিল প্রায় একই রকম। একই রকম স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এসব ঘরবাড়ি ‘আসাম প্যাটার্নের স্থাপনা’ হিসেবে পরিচিত।
আঠারো শতকের শেষের দিকে সিলেট তথা আসাম অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর অনেক স্থাপনা বিধ্বস্ত হলেও আসাম প্যাটার্নে নির্মিত বাড়িগুলো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এরপর থেকেই এই প্যাটার্নে ঘরবাড়ি নির্মাণ শুরু করেন অনেকে। আধাপাকা কাঠের নল-বর্গা, বেড়ার ওপর চুন সুরকির লেপন ও সাদা চুনকাম করা দেয়াল এবং ঢেউটিনের তৈরি নান্দনিক এই স্থাপনা শোভা পেত সিলেটের অনেক এলাকায়। পরে আসাম স্থাপত্যরীতির সঙ্গে যোগ হয় ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতি। একটা সময় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাগুলো আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির আদলে নির্মিত হতে থাকে। প্রাচীন এই নিদর্শন এখনো ছড়িয়ে রয়েছে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে।
তবে নতুন করে আসাম প্যাটার্নের স্থাপনা নির্মাণে আগ্রহ নেই মানুষের। ইট, সিমেন্ট ও রডের প্রযুক্তি গ্রাস করেছে সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যের সেই স্থাপনাগুলোকে। যে স্থাপনাগুলো রয়েছে, সেগুলোও বিলুপ্তপ্রায়। প্রযুক্তির বদৌলতে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার স্বপ্নে প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে সরে আসছে মানুষ। চুন-সুরকির আধা পাকা দেয়াল ভেঙে গড়ে তোলা হচ্ছে ইট-পাথরের শক্ত দালান। শহর বা গ্রাম, সিলেটের সর্বত্রই এখন পাকা দালান। ইট-পাথরের দালানকোঠা এখন শোভা পায় প্রত্যন্ত এলাকাতেও।
সিলেট নগরীতে আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির আরও একটি প্রাচীন স্থাপনা ছিল আবু সিনা ছাত্রাবাস। ১৮৫০ সালে সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থলে ইউরোপিয়ান মিশনারিরা এই ভবনের প্রথম পর্বের নির্মাণকাজ শুরু করেন। প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই ভবন আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির একটি নান্দনিক স্থাপনা। এর সঙ্গে দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মৃতি জড়িত। পুরাতন মেডিকেল ভবন বা আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন নামে পরিচিত এই ভবনটি এ অঞ্চলের শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক। সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে হাজার বছরের পুরোনো বিভিন্ন শাসনামলের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো কিছুটা ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন এটি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ২০১৯ সালে এটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
আসাম প্যাটার্নে নির্মিত আরেকটি স্থাপনা ছিল সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) ছাত্রাবাস। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি ছিল সিলেটের শতবর্ষের ঐতিহ্য। ২০১২ সালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায় প্রাচীন এ স্থাপত্যকর্ম। যদিও পরে আসাম আদলেই নতুন করে বানানো হয়েছে ছাত্রাবাসটি। তবু সেই শোভা নেই নতুন করে নির্মিত এ ছাত্রাবাসে।
এছাড়া সিলেট নগরীর চৌহাট্টায় রয়েছে আসাম প্যাটার্নের তৈরি আরও একটি প্রাচীন স্থাপনা। সিলেটবাসীর কাছে এটি সিংহবাড়ি হিসেবে পরিচিতি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন গুণীজনের চরণ পড়েছিল এই আসাম প্যাটার্নের বাড়িতে। তাছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার চারিগ্রামে অবস্থিত সাজিদ রাজার বাড়িতে রয়েছে আসাম প্যাটার্নের তেরো চালা ঘর। কাঠ-বাঁশের খানার ওপর চুন সুরকি ব্যবহৃত ঘরটিতে রয়েছে নানা কারুকার্য। এখানেই একসময় হাছন রাজাসহ সিলেটের জমিদারদের আড্ডা বসত। সতেরো শতকের প্রথম দিকে নির্মিত এই প্রাচীন স্থাপনাটি এখন ধ্বংসের পথে। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে প্রাচীন এই স্থাপত্যকর্ম।
একই উপজেলার কামালপুর গ্রামে রয়েছে আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির আরও একটি প্রাচীন বাড়ি। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন সরকারের ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কারমন্ত্রী এম এ হকের পৈতৃক ভিটা এটি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি পুলিশের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন। সতেরো শতকের শেষ দিকে এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন এম এ হকের পিতা সাহেবজান আলী। এছাড়া সিলেট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির স্থাপনাগুলোও ধ্বংসের পথে। সংরক্ষণের অভাবে সিলেটের প্রাচীন স্থাপনাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক গবেষক আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, “আসাম প্যাটার্নের স্থাপনাগুলো আমাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে এগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার ঐতিহ্যের স্থাপনাগুলোর গুরুত্ব না বুঝে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে মানুষই এগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বার্থে প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ জরুরি। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাই।”
প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার বলেন, “সিলেটের প্রাচীন স্থাপনাগুলো রক্ষা করা খুবই জরুরি। কিন্তু কারা সংরক্ষণ করবে? আমরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেও আবু সিনা ছাত্রাবাস রক্ষা করতে পারিনি। খোদ সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত কথা দিয়েও সেটি রক্ষা করেননি। শেষ পর্যন্ত আবু সিনা ছাত্রাবাসের ইতি ঘটল।”
তিনি বলেন, “সিলেটে এখনো অনেক প্রাচীন স্থাপনা আছে। সেগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের কাজ করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব।”