শরীয়তপুরে তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর নিখোঁজ বড় ছেলের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন মা। এর আগে ঘটনার পরপরই দুই শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
সোমবার (৬ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে ফুট ভাটিতে স্থানীয় জেলেরা বড় ছেলের মরদেহ উদ্ধার করে।
উদ্ধার হওয়া নিহত শিশুর সাহাবীর ওরফে জাফরের (৭)।
এর আগে, রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজার ব্রিজের কাছ থেকে কীর্তিনাশা নদীতে তিন সন্তান নিয়ে ঝাঁপ দেন গৃহবধূ সালমা বেগম।
ঘটনার পরপরই ডায়াপার পরা অবস্থায় নদীতে ভাসতে দেখে আনিকা (৩) ও সোলেমান (১) নামে দুই শিশু সন্তানকে উদ্ধার করে। তারা বর্তমানে সুস্থ রয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ ছিলেন সালমা বেগম ও তার বড় ছেলে সাহাবীর।
নিখোঁজ সালমা বেগম নড়িয়া উপজেলার জপসা ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের আজবাহার মাতবরের স্ত্রী। আজবাহার মাতবর এক সময় ভোজেশ্বর বাজারে পাটের ব্যবসা করলেও বর্তমানে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন।
পরিবার ও পুলিশ বলছে, একই উপজেলার পাচক গ্রামের রিকশাচালক লোকমান ছৈয়ালের মেয়ে সালমার পারিবারিকভাবে ১০ বছর আগে আজবাহারের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই সালমা বেগমের শাশুড়ি মিলি বেগম ও ননদ কলির সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। শনিবার রাতে শাশুড়ি ননদের সঙ্গে ঝগড়া হয় সালমার। পরে তার স্বামী সালমাকে মারধর করে বলে সালমার স্বজনেরা অভিযোগ করে। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টার সময় সালমা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে তার তিন সন্তানকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন।
নড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের লিডার রওশন জামিল বলেন, ঘটনার পর থেকে নড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের সাত সদস্যদের একটি দল ও মাদারীপুর থেকে আসা চার সদস্যদের একটি ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মা সালমা ও তার বড় সন্তান সাহাবীরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ (সোমবার) বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে পাঁচশ ফুট ভাটিতে স্থানীয় জেলেরা সাহাবীরের মরদেহ উদ্ধার করে। দুপুর পর্যন্ত মা সালমাকে পাওয়া যায়নি।
ঘটনার পর থেকে নদীর পাড়ে আজাহারী করছেন নিখোঁজ সালমার মা সেলিনা বেগম, বাবা লোকমান ছৈয়াল, বোন শারমিন আক্তার, স্বামী আজবাহারসহ স্বজনেরা। আশপাশের লোকজন নদীর পাড় ভিড় জমান।
সালমার মা বিলাপ করতে করতে অভিযোগ করে বলেন, দরিদ্র হওয়ায় ওরা আমার মেয়েকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এত দিন সব অত্যাচার নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেছে। তারা ঠিকমতো খাওন দিতো না আমার মেয়েকে। তাদের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে, আমার মেয়ে তিন সন্তান নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে।
সালমার বোন শারমিন আক্তার অভিযোগ করে বলেন, আমার বাবা রিকশাচালক বলে সালমার শাশুড়ি, ননদেরা আমার বোনকে সারাক্ষণ জ্বালা-যন্ত্রণা দিত। আমার বোন কোনো প্রতিবাদ বললেই তারা মারধর করত। সালমার স্বামী আজবাহার এক সময় পাটের ব্যবসা করলেও, কয়েক বছর যাবৎ বেকার। সে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য স্বামী, শাশুড়ি ও ননদ আমার বোনের কাছে যৌতুক চাইতো। যৌতুক দিতে না পারলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিত।
এ ঘটনার আগের দিন সালমাকে মারধর করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে ঘটনার পর থেকে স্বামী আজবাহারকে নদীর পাড়ে বিলাপ করতে দেখা গেছে। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার স্ত্রীকে আমি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমি তাকে একটা ফুলের টোকাও দেইনি। আমার মা-বোনও কখনো তাকে খারাপ জানেনি। ও কী কারণে আমার সন্তানদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে আল্লাহপাক ভালো জানে।
এ বিষয়ে নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে তিন সন্তান নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার একদিন পর বড় ছেলের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে মা সালমা বেগম এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তাকে উদ্ধারে অভিযান চলছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।