• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ

অকল্পনীয়-অবিশ্বাস্য, মিরাজ


সৌরভ কুমার দাস
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২২, ১২:৩৪ এএম
অকল্পনীয়-অবিশ্বাস্য, মিরাজ
ছবিঃ ওয়ালটন

 মেহেদী হাসান মিরাজ, ভারতের বিপক্ষে ব্যক্তিগত ১০০ রানটি নিয়েছেন প্রায় আট ঘণ্টা হয়ে গেছে! কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, এখনও কি ঘোর কেটেছে? যদি ভুল না করি আমার ধারণা, ঘোর তো কাটেইনি বরং মিরাজের পুরো ইনিংসটিই এখনও আপনার, আমার বা সবারই চোখে লেগে আছে।

অবিস্মরণীয়, অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য, মিরাজের সেঞ্চুরিকে এই তিন শব্দের কোনো শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করা যায়, এমনকি বিতর্কেরও আয়োজন করা যায়।

মিরাজ এমন পরিস্থিতে, এমন একটা ইনিংস খেলেছেন যেখানে আসলে কয়টা বল খেলেছেন, কয়টা চার বা ছয় মেরেছেন এসব নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম। বরং চাইলে এই সেঞ্চুরিটার মাহাত্ম্য নিয়ে পাতার পর পাতা কাব্য লিখে ফেলা যায় অনায়াসে!

মিরাজ এদিন যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন ততক্ষণে ছয় টাইগার ব্যাটার মাঠের শীতল রোদ থেকে ফিরে গেছেন ড্রেসিংরুমে! আসলে ওই পরিস্থিতিতে সেঞ্চুরি তো দূরের কথা সবার একটাই আশা ছিল, ‘ম্যাচ তো হেরেই গেছি, তার আগে যেন সম্মানজন একটা স্কোর গড়তে পারি।’

হ্যাঁ, মনে হতে পারে, আগের ম্যাচে এই মিরাজই তো একা হাতে রীতিমতো মিরাকেল ঘটিতে দলকে জিতিয়েছেন! আবার পরক্ষণেই সেই একই মানুষটার মনেই বেজে ওঠে, ‘সব দিন কি আর একই জিনিস হয়!’

মাঠের বাইরে যখন একেক জনের মনে এরকম হাজারো ভয়, শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে তখন মাঠে ব্যাট হাতে ভারতীয় বোলারদের গোলার মতো সব ডেলিভারি সামলে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ছেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

খুব আশাবাদী দর্শক বা আগের ম্যাচের জন্য আশাবাদী হওয়া দর্শক হোলে ৬৯ রানে ছয় উইকেট পড়লেও বোধহয় টিভিসেটে বা গ্যালারি থেকে নড়ার কথা চিন্তা করেননি। আর যদি সেটাই হয় তাহলে আশা করি খেয়াল করেছেন, বাইরে থেকে পাহাড়সম চাপ মনে হলেও মিরাজের প্রত্যেকটি ডেলিভারির মুখোমুখি হওয়া, শট খেলা বা ডিফেন্স করা-সবকিছুতেই যেন ঠিকড়ে পড়ছিল আত্মবিশ্বাসের ফুলঝুড়ি!

আসলে আগের ম্যাচে যে খাঁদ থেকে দলকে টেনে তুলেছিলেন তাতে করে আজকে ওই পরিস্থিতিতেও আত্মবিশ্বাসী হওয়া তো তাকেই মানায়! ইনিংসের শুরু থেকেই পজিটিভ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ব্যাটিং করে ধীরে-সুস্থে ভারতীয় বোলারদের একদম বোথা করে দিয়েছেন।

৫৫ বলে হাফসেঞ্চুরি স্পর্শ করেছেন মিরাজ, যেন পাক্কা ওয়ানডে ইনিংস। মনেই হচ্ছিল না বাংলাদেশ দল আসলে কতবড় বিপদসীমা অতিক্রম করছে! একটু এদিক ওদিক হলেই সব শেষ! একটা জুটি না হলে হয়তো ফিল্ডিং করতে নামতে হয়তো স্রেফ নিয়ম রক্ষার জন্য!

ইনিংসের দুই ওভার বাকি, মিরাজ অপরাজিত ৭২ রানে! তখনও বোধহয় কেউ ভাবেনি এই ছেলে শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি করে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়বে! যে উমরান মালিকের বুলেট গতির বাউন্সার সাকিব আল হাসানকে পর্যন্ত নাচিয়ে ছেড়েছে!

ক্যারিয়ারে সম্ভবত কখনও কোনো বোলারদের বিপক্ষে সাকিবকে এমন ক্লু-লেস হতে দেখা যায়নি, যেটা আজ দেখা গেলো মিরপুরে! যে উমরান মালিকের বল যখন শান্তর উইকেট উপড়ে ফেললো, আমি মোটামুটি নিশ্চিত শান্ত ওই বলটাকে চোখেই দেখেননি হয়তো!

সেই উমরানকে ৪৯তম ওভারে মিরাজ যেভাবে তিনটা চার হাঁকালেন সেটা স্রেফ বাউন্ডারি হওয়ার আগ পর্যন্ত দিবাস্বপ্নই মনে হতো! কিন্তু মিরাজ তো এখন বড় ব্যাটার! এখন আর অমুক ভাই তমুক ভাইয়ের নাম নেওয়া লাগে না! তিনি তো এখন নিজেই এক ভাই!

শেষ ওভারে ১৫ রান প্রয়োজন সেঞ্চুরি পেতে! স্ট্রাইকে নাসুম আহমেদ সিঙ্গেল নিলেন প্রথম বলে! পাঁচটা বল পেলেন মিরাজ এবং প্রথম বলেই ভারতীয় পেসার শার্দুল ঠাকুরের স্লোয়ারকে লেগ মিড উইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারলেন গ্যালারির মাঝখানে!

তখন একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে সেঞ্চুরি! পরের বল ডট! তবে কি দলের সংগ্রহ বড় হলে মিরাজের প্রথম সেঞ্চুরিটা হাত ছোঁয়া দূর থেকে চলে যাবে! এমন শঙ্কা তখন হয়তো অনেকেই প্রকাশ করা শুরু করেছেন!

তবে সব শঙ্কা দূর হলো ওই ওভারের চতুর্থ বলে! এবারও স্লোয়ার ডেলিভারি করলেন শার্দুল, আগে থেকে বুঝতে পারায় দ্রুতই মিরাজ সেটিকে উড়িয়ে মারলেন ডিপ মিডউইকেটে! গ্যালারিতে আছড়ে পরার পর তার রান হলো ৯৭*।

পরের বলেই সেঞ্চুরিটা পেয়ে যেতে পারতেন! তবে লং অফের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারা বলকে বাউন্ডারি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে থাকতেই থামিয়ে দেন ভারতীয় ফিল্ডার! তবে ততক্ষণে দুইবার দৌড়ে তার রান সংখ্যা পৌছে গিয়েছে ৯৯ রানে।

শেষ বলে প্রয়োজন ছিল ১ রান! শার্দুল যেন ফুলটস দিয়ে মিরাজের কাজটা আরও সহজ করে দিলো! বলটাকে শর্ট লেগ অনে ঠেলে দিয়েই দৌড়! হয়ে গেলো প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে সেঞ্চুরি, তাও ভারতের বিপক্ষে!

মিরাজের সেঞ্চুরিটা কত ভালো ছিল সেটা বুঝতে পারবেন আরও একটা স্ট্যাট দিলে। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র দুইজন ক্রিকেটার ওয়ানডে ফরম্যাটে আট নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন।

মিরাজের আগে ২০২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আট নম্বরে নেমে ৯১ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন আয়ারল্যান্ডের ব্যাটার সিমি সিং।

মিরাজের এত প্রশংসা করতে রিয়াদকে বোধহয় একটু আড়ালেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে! সেটা তাহলে অবিচার হয়ে যায়। শেষ কয়েক বছরে রিয়াদ প্রায় সবসময় সমালোচনার বন্দুকের মুখেই থাকেন! এই সিরিজেও প্রথম ম্যাচে আহামরী কিছু করতে পারেননি।

তবে সব চাপ সামলে আজ যে ইনিংসটা খেললেন, তার অন্তত শেষ দুই বছরের মধ্যে সেরা ইনিংস। জাতীয় দলের বিপদের দিনে সবচেয়ে বেশি সময় ঢাল হয়ে দাঁড়ান রিয়াদ। ফলে জাতীয় দলের স্বার্থে তার ছন্দে ফেরাটা খুবই জরুরী। আশা করা যায়, আজকের ইনিংসটা তাকে পুরনো ছন্দ ফিরিয়ে দিবে। 
 

Link copied!