শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষকে পদত্যাগ করতে হয়েছে গত ৩১ দিন ধরে অব্যাহত গণবিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে। দেশের অর্থনীতির ভয়াবহ সংকটের মুখে ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের সুবিধাভোগীদের টিকে থাকার এটা হচ্ছে শেষ চেষ্টা। 
শ্রীলঙ্কার এই সংকটকে কেবল অর্থনীতির অবস্থা দিয়ে বুঝলে আংশিক বোঝা যাবে। এই সংকটের মর্মমূলে আছে দেশের রাজনীতি। যেই রাজনীতি একাদিক্রমে কর্তৃত্ববাদী শাসন তৈরি করে, একটি পরিবারের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ তুলে দেয় এবং এমন একধরনের অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করে, যা কেবল একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা প্রদান করে। উন্নয়নের দৃশ্যমান বিষয়ের দিকে নজর দিয়ে দেশকে ঋণগ্রস্ত করাই এর একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনবিচ্ছিন্নতা। শ্রীলঙ্কার রাজনীতির এই দিকগুলো আমাদের মনে রাখা দরকার।
লক্ষণীয় যে মাহিন্দা রাজাপক্ষ এবং তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পরে ক্রমাগতভাবে দেশকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাহিন্দ রাজাপক্ষের শাসনামলের দিকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষর শাসনামলে শ্রীলঙ্কা কর্তৃত্ববাদী শাসনের জাঁতাকলে থেকেছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাঁকে ভোটাররা সরিয়ে দিলেও রাজনীতির বৃত্তচক্রে, তাঁর ভাইয়ের প্রেসিডেন্ট হবার সূত্রে এবং ২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাঁর দলের বিজয়ের সূত্রে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। 
মাহিন্দা রাজাপক্ষ ব্যক্তি হিসেবে শ্রীলঙ্কায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতীক হয়ে উঠলেও তিনি নির্বাহী প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ফলে তাঁর এই পদত্যাগ ক্ষমতা কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে মনে করার কারণ নেই। দেশের নাগরিকরা যে কেবল তাঁর অপসারণ চাইছিলেন তা নয়, তিনি এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেই তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া আসলে বাজি খেলায় মত্ত হয়েছেন, ধরে নিচ্ছেন যে আপাতত এই ব্যবস্থা তাঁকে এবং পুরো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে দেবে।
এটাও লক্ষণীয় যে, এই আন্দোলনের সূচনাতে সহিংসতা না থাকলেও তা এখন সহিংস রূপ নিয়েছে। এটাও লক্ষ করা দরকার যে সরকার কেবল যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরে নির্ভর করেছে তা নয়। সোমবার সারা দিন ধরে রাজাপক্ষের সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের ওপরে হামলা করেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যে, ‘আজ রাজধানীর বাইরে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কয়েক হাজার সমর্থককে বাসে করে রাজধানীতে আনা হয়। তাঁরা প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের পাশে অবস্থান নিয়ে থাকা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। তাঁদের তাঁবু ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারবিরোধী ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবিতে অবস্থানরত ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালান তাঁরা’ (প্রথম আলো, ৯ মে ২০২২)। কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো বিভিন্ন দেশেই এই কৌশল অবলম্বন করে আসছে। যেকোনো দেশে যারাই কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তাঁদের জন্য এটা দেখার বিষয়।
শ্রীলঙ্কায় এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং চলমান আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর স্বতঃস্ফূর্ততা। এখন পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর কেউই বা সম্মিলিতভাবে বিরোধীরা কোনো ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এটাও লক্ষ করার বিষয়। প্রেসিডেন্ট বিরোধী দলের নেতাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিরোধী দল, তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন মন্ত্রিসভার অবসান হবার পরে ঘটনা ভিন্ন দিকেই মোড় নেবে বলে মনে হচ্ছে। হয় নির্বাহী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস করে, তাঁকে সরিয়ে দিয়ে নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা তৈরি করে রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে, নতুবা জরুরি ভিত্তিতে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন করতে হবে। কিন্ত পার্লামেন্টের নতুন নির্বাচন সমাধান নয় এই কারণে যে, প্রেসিডেন্টের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তা অবস্থার সমাধানে বড় ধরনের বাধা। শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহের দিকে সে কারণেই নজর রাখা জরুরি। কেবল অর্থনীতির দিকটাই দেখার বিষয় নয়।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































