• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩০, ১৬ রজব ১৪৪৬

বায়ু শোধনাগার নাকি কার্বন ব্যবসা!


ইশতিয়াক হোসেন
প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২১, ০৩:০৫ পিএম
বায়ু শোধনাগার নাকি কার্বন ব্যবসা!

শহরাঞ্চলে বাতাসের দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিল্পের আগ্রাসনে গ্রামাঞ্চলেও কমছে নির্মল  বাতাস। নানাভাবে বাতাসে মিশছে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। অথচ বেঁচে থাকতে অপরিহার্য অক্সিজেন বাতাস থেকেই পাওয়া যায়। সুস্বাস্থ্য তথা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য বাতাসে মিশে যাওয়া রাসায়নিক পদার্থ অত্যন্ত ক্ষতিকর। বায়ু দূষণ রোধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন, বৃক্ষ রোপণ, ভূমি ক্ষয় রোধ, শিল্প কলকারখানা-যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ আর কতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর ভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ এসব পদক্ষেপ।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সন্ধানে সব সময়ই ব্যস্ত থাকেন। এবার তারা বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে নতুন কিন্তু অত্যন্ত সাধারণ এক প্রযুক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই প্রযুক্তি হচ্ছে বায়ু শোধনাগার। অন্যভাবে বলতে গেলে ছাকনি দিয়ে দূষিত পদার্থ আলাদা করে বাতাসকে পরিষ্কার করার কাজটি করবে বায়ু শোধনাগার।

ঠিক সাবান দিয়ে জামা কাপড় ধোয়ার মতো করেই বায়ু শোধনাগার পদ্ধতিতে দূষিত বাতাস পরিষ্কার করা হয়। তবে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে "মোনো এথানল এমিন" নামক একটি বিশেষ রাসায়নিক। কিছু ক্ষেত্রে পরিষ্কারক হিসেবে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড বা পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইড ব্যবহার হয়। বাতাস পরিষ্কারে ব্যবহৃত এই ছাকনির ভেতর পানিতে মিশ্রিত "মোনো এথানল এমিন" থাকে। এই বিশেষ মিশ্রণটি দূষিত বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডকে আটকে বিশেষ যৌগ "কার্বামেট" তৈরি করে। পরের ধাপে "কার্বামেট" থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড পৃথক করে নেওয়া হয়। এই নিষ্কাশিত কার্বন ডাই অক্সাইড পরে অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যায়।

২০১৭ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সুইজারল্যান্ডে স্থাপিত হয় বায়ু শোধনাগার। প্রতি বছর ৯'শ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাস থেকে নিষ্কাশন করে চলেছে। কানাডার ব্রিটিশ কলোম্বিয়ায় স্থাপিত বায়ু শোধনাগারের কার্বন ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশনের ক্ষমতা বাৎসরিক ১০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ১টি শোধনাগার কোটি গাছের সমপরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাস থেকে শোষণ করতে সক্ষম।

বায়ু শোধনের এই কৌশল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাস থেকে সরাসরি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশনের এই পদ্ধতি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। এ প্রযুক্তি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যেমন কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং নামক একটি প্রতিষ্ঠান আমেরিকার টেক্সাসে যে বায়ু শোধনাগার স্থাপন করছে তার খরচ হবে শত শত কোটি টাকা। আবার সরাসরি বাতাস থেকে প্রতি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশনে খরচ পরে প্রায় লাখ টাকা। অন্যদিকে প্রতি বছর বৈশ্বিক কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৬ শত কোটি টন। মানে বর্তমানে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হয় তা অপসারন করতে লক্ষাধিক বায়ু শোধনাগার প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এতো পরিমাণ বায়ু শোধনাগার স্থাপন ও পরিচালনার বিশাল ব্যয়ভার বহন করা কঠিন হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অপসারিত কার্বন ডাইঅক্সাইড আবার তেল কূপে প্রবেশ করানো হবে অবশিষ্ট তেল নিষ্কাশনের জন্য। জ্বালানী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্বন ডাইঅক্সাইড সরবরাহ করা হবে। তারা বিশুদ্ধ কার্বন ডাইঅক্সাইডের সঙ্গে হাইড্রোজেন মিশিয়ে কৃত্তিম অশোধিত জ্বালানী তেল প্রস্তুত করবে।

পরিবেশবাদীদের এর পরিপ্রেক্ষিতে আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের মতে, বায়ু দূষণ ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধই যদি এর লক্ষ্য হয় তবে এসব শোধনাগারের উপজাত দিয়ে জ্বালানী তেল প্রস্তুতের মানে কি। তাদের অভিযোগ, বায়ু শোধনাগার প্রতিষ্ঠানগুলোর আসল উদ্দেশ্য কার্বন নিষ্কাশন ব্যবসা।

এদিকে বায়ু শোধনাগার প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শুধু জ্বালানী তেল তৈরি নয় অন্যান্য উপকারী ও হিতকর কাজেও এই কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রয়োগ আছে। যেমন হিমাগার, অগ্নিনির্বাপন, কোমল পানীয়, কয়লা ক্ষেত্র, রাবার-প্লাস্টিক ও সিমেন্ট শিল্প, কৃষি ক্ষেত্রে সার তৈরি এমনকি গাছের বৃদ্ধিতেও কার্বন ডাইঅক্সাইডের ব্যবহার আছে।

বায়ু শোধনাগার স্থাপন ও পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে আরও কার্যকর এবং সহজলভ্য করতে এই সব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।

নির্মল পরিবেশে নির্ভেজাল বাতাস টেনে সুস্থ সবল জীবন সবাই চায়। যেভাবেই হোক প্রকৃতিকে রক্ষা করতেই হবে। কার্বন ডাইঅক্সাইড অপসারণের আরও অনেক পদ্ধতি রয়েছে, যেমন শিল্প কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ভু-গর্ভে নিয়ে আটকে রাখা, কার্বন ডাইঅক্সাইডকে খনিজ পদার্থে রূপান্তর, অধিক মাত্রায় সামুদ্রিক জ্বলজ উদ্ভিদ চাষ, জৈব-সার ব্যবহার করে মাটিতে কার্বন মিশিয়ে দেওয়া, বনায়ন ও বনাঞ্চল রক্ষা ইত্যাদি। প্রতিটি পদ্ধতিরই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

পরিবেশবাদীদের পরামর্শ, বাসযোগ্য জলবায়ু বজায় রাখতে নীতি নির্ধারকদের প্রয়োজনে সব পদ্ধতি একসঙ্গে নিয়োগ করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ও সবাইকে পরিবেশ বান্ধব জীবনযাত্রা অবলম্বনে এগিয়ে আসতে হবে।

Link copied!