• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সাকিব আল হাসান: দুষ্টু গরু ও গোয়ালের তত্ত্ব


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২২, ০৬:৫৬ পিএম
সাকিব আল হাসান: দুষ্টু গরু  ও গোয়ালের তত্ত্ব

গত কয়েকবছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত ক্রিকেটার কে? এই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা— সাকিব আল হাসান। নিঃসন্দেহে সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সেরা পারফরমার। আসলে সাকিব বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা পারফারমার। শুধু বাংলাদেশ নয়, সাকিব চাইলে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন। এমনিতেই বাংলাদেশ কম খেলার সুযোগ পান। আর সাকিব আবার তার সবগুলোও খেলেন না। তাই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার সুযোগটি তিনি হেলায় হারিয়েছেন। শুরুতে যে প্রশ্নটি করেছি, তার উত্তরটি ঠিক আছে, তবে সেটি বড় বেদনার। কারণ গত কয়েক বছরে সাকিব তার মাঠের পারফরম্যান্সের কারণে আলোচিত নন।

সাকিবের ছুটি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিয়েই আবর্তিত হয়েছে গত কয়েকবছরের বাংলাদেশ ক্রিকেট। সাকিবের ছুটি যেন এক গোলকধাঁধা, মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার মত। এটা ঠিক সাকিব দলে থাকলে বাংলাদেশ আসলে ১২ জন নিয়ে খেলার সুবিধা পায়। একই সঙ্গে সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা বোলার হওয়ার সক্ষমতা তার আছে। সাকিব না থাকলে, তার জায়গায় দুই জন ক্রিকেটার নিতে হয়। তাই সাকিবের প্রতি ক্রিকেট বোর্ডের বাড়তি নির্ভরশীলতা এবং অতিরিক্ত প্রশ্রয় আছে। কিন্তু সেই নির্ভরশীলতা আর প্রশ্রয়কে পুঁজি করে সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটকেই জিম্মি করে ফেলেছেন।

পারফরম্যান্সে যেমন সাকিব সবার ওপরে, বিতর্কেও। ক্যারিয়ার জুড়েই বিতর্কের সাথে তার বসবাস। ছুটি বিতর্ক তো আছেই; জুয়ারির সাথে যোগাযোগ করে নিষিদ্ধ হওয়া, মাঠে আম্পায়ারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, দর্শককে মারধোর, ভক্তের মোবাইল ভেঙ্গে ফেলা, সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি, সতীর্থদের অবমূল্যায়ন, দলীয় ফটোসেশনে অংশ না নেয়া, বায়োবাবল ভেঙ্গে শ্যুটিং করতে যাওয়া— বিতর্কের তালিকা লম্বা হতেই থাকবে। মাঠের বাইরে আপনি যাই করুন, আপনি যেহেতু বোর্ডের চুক্তিভূক্ত ক্রিকেটার, মাঠে আপনাকে খেলতেই হবে। তবে চুক্তিভূক্ত ক্রিকেটার হলেও ছুটি নেয়া যায়, পাওয়া যায়। সারাবিশ্বেই এটা প্রচলিত। কিন্তু আপনি কেন ছুটি নিচ্ছেন, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতি এমনও হতে পারে, খেলার মাঝখান থেকে আপনাকে চলে যেতে হচ্ছে। শচীন টেন্ডুলকার পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে বিশ্বকাপ রেখে দেশে ফিরেছিলেন। আবার ফিরে গিয়ে সেঞ্চুরিও করেছেন। কিন্তু আপনি যদি খেলার চেয়ে বেশি ছুটি কাটান, ছুটি নিয়ে যদি বিজ্ঞাপনের শুটিং করেন, দেশের হয়ে না খেলে যদি আইপিএল খেলেন; তাহলে আপনার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।

সবকিছুরই একটা নিয়ম থাকে, ছুটিরও। কিন্তু সাকিব কখনোই কোনো নিয়মের ধার ধারেন না। বোর্ডকে জিম্মি করে তিনি নিজের মত একটা নিয়ম বানিয়ে নিয়েছেন। গত মৌসুমে সাকিব শ্রীলঙ্কা সফরে না গিয়ে আইপিএল খেলতে গিয়েছিলেন। এবারও আইপিএল খেলার জন্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ছুটি চেয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে বোর্ড সেটা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাকিব এবার আইপিএলে দল পাননি। তাতে সবাই ধরে নিয়েছিলেন, সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাচ্ছেন। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে তিনি সেটা জানিয়েছিলেনও। সাকিবের সম্মতিতেই দক্ষিণ আফ্রিকার সফরের ওয়ানডে এবং টেস্ট দলে তাকে রাখা হয়। কিন্তু দল রওয়ানা দেয়ার চারদিন আগে তিনি জানিয়ে দিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার জন্য তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে তৈরি নন। তাও সেটা বললেন বিজ্ঞাপনের শুটিঙের জন্য দুবাই যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ফোনে বোর্ড পরিচালক জালাল ইউনুসকেও তার অনাগ্রহের কথা জানান। এটা কখনো ছুটি চাওয়ার স্টাইল হতে পারে! কোনো বোর্ডের শৃঙ্খলা এটা অনুমোদন করতে পারে!

সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ছুটি নিয়েছিলেন আইপিএল খেলবেন বলে। এখন যেহেতু তার আইপিএল খেলার সুযোগ নেই, তখন দলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাচ্ছেন, এটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা সাকিব যদি আইপিএলে খেলার সুযোগ পেতেন, তাহলে কি তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকতেন? নাকি আইপিএলে দল না পাওয়াই তার মানসিক অস্থিরতার কারণ। শেষ পর্যন্ত যদি সাকিব আল হাসান দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না যান, বোর্ড একটু বিপাকেই পড়বে। কারণ এমনিতে বাংলাদেশ দলে সাকিবের বিকল্প নেই। আর এত অল্প সময়ে অন্য কা্‌উকে খুজে বের করে, তাকে তৈরি করে ভিসার ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব। সাকিব যত ভালো ক্রিকেটারই হোন, এভাবে দেশের ক্রিকেটকে জিম্মি করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে।

চাইলে বোর্ড সাকিবের ছুটির আবেদন নামঞ্জুর করতে পারে। কিন্তু একজন অনিচ্ছুক খেলোয়াড়কে বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। আমি বরং বলি, বোর্ড সাকিবের সাথে বসে বিষয়টার একটা স্থায়ী সমাধান করতে পারে। সাকিব যদি ক্রিকেটটা আর উপভোগ না করে, তাহলে তাকে বিদায় বলে দেওয়াই ভালো। কারণ অনেকদিন ধরেই সাকিবের কারণে বোর্ড দলে কোনো শৃঙ্খলা আনতে পারছে না। সাকিবের জন্য এক নিয়ম আর সবার জন্য আলাদা নিয়ম, সেটা তো হতে পারে না। তবে সাকিবকে আজকের দানব বানানোর জন্য বোর্ডের দায়ও কম নয়। বছরের পর বছর সাকিবের অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে, তাকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে তাকে সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে ফেলেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যত ভালো খেলোয়াড়ই হোন, কেউই দলের উর্ধ্বে নন।

সাকিব মনে করেন, তিনিই সর্বেসর্বা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রচলিত পঞ্চপান্ডব তত্ত্বে তার আস্থা নেই। তিনি মনে করেন, পান্ডব তিনি একাই। তবুও গত অনেক বছর ধরে সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ- এই পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের ওপর নির্ভর করে চলছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট। এই পাঁচজন না থাকলে দলের কী হবে, এ নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম আমরা। আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর না নিলেও মাশরাফি এখন দলের বাইরে। তামিম টি-২০ খেলছেন না। মাহমুদুল্লাহ অভিমান করে টেস্ট খেলা ছেড়েছেন। তাতে কি বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত সিরিজে সিনিয়রদের বলার মত পারফরম্যান্স ছিল না। আফিফ, মিরাজ, লিটন, শফিউলরাই দল জিতিয়েছে। তাই সাকিব ছাড়া বাংলাদেশ অচল, সাকিব অপরিহার্য- এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে।

বাংলাদেশের হয়ে খেলে সাকিব বিশ্বসেরা হয়েছেন, বাংলাদেশ তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়নি। সাকিব ছিলেন, এসন সব ম্যাচ যেমন বাংলাদেশ জেতেনি, আবার সাকিব না থাকা সব ম্যাচ হেরেছে এমনও নয়। পৃথিবীতে আসলে অপরিহার্য বলে কিছু নেই। শচীন টেন্ডুলকার ছাড়াও ভারতের ক্রিকেট চলছে। আর সাকিবের যা বয়স, এমনিতেও দু্ই বছরের বেশি খেলতে পারবেন না। কিন্তু এই দুইবছরও যদি তিনি বোর্ডের সাথে চোর-পুলিশ খেলতেই থাকেন; তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। এক সাকিবের কারণে বিসিবি দলে শৃঙ্খলা আনতে পারছে না। সময় এসেছে সাকিবের সাথে কথা বলে, তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় বলা। এবং নতুনদের নিয়ে নতুন করে বাংলাদেশ দলকে ঢেলে সাজানোর।

যে গরু দুধ দেয়, তার লাথিও ভালো, সাকিবের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে বিসিবি অনেক লাথি খেয়েছে। এবার সময় এসেছে ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ এই তত্ত্বে যাওয়ার। কোনো ক্রিকেটারই দলের চেয়ে বড় নয় এবং কেউই অপরিহার্য নয়।

Link copied!