• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শারদীয় দুর্গোৎসব: ‘গাহি সাম্যের গান’


জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২, ১০:৩৯ এএম
শারদীয় দুর্গোৎসব: ‘গাহি সাম্যের গান’

সৃষ্টি থেকেই মানুষ বিভিন্নভাবে শোষিত হয়েছে, আজও হচ্ছে। আর এই শোষণকে নির্মূল করতে বারবার পৃথিবীতে এসেছেন মহামানব। যারা নতুনের আলোকবর্তিকা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। পথ দেখিয়েছেন। নব-নব আলোকে নতুনভাবে দাঁড় করিয়েছেন পৃথিবীকে। জীবনের সঞ্জীবনী শক্তি হয়ে ধরা দিয়েছেন অন্যের কাছে। করেছেন দুঃসাধ্য কাজ। মহামানবদের মতোই পৃথিবীকে আগলে রাখতে অসুরদের বধ করে ধরণীকে পবিত্র করতে যুগে যুগে আসেন দেবী দুর্গা। দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করাই যার কাজ। মহিষাসুরের অত্যাচার থেকে ত্রিভুবনকে রক্ষা করতে সব দেবতার তেজ থেকেই সৃষ্টি দুর্গার।

প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ত্রিশূল গেঁথে মহিষাসুরকে বধ করেন দুর্গা। যুগে যুগে দুর্গার আগমনী শক্তি দুর্গম অসুরদের বধ করার জন্য। যারা সমাজ-সংসার কলুষিত করেন। ঘোর কলিযুগের অবসান আজও হয়নি। নতুনরূপে নতুনভাবে মানুষের পথকে রুদ্ধ করছে। পৃথিবীর কদর্য রূপকে, পাপ-পঙ্কিলতাকে দূরীভূত করতে এই অদম্য শক্তির মতো জাগরণী শক্তির বার্তা নিয়ে আসতে হবে মানবকে। নতুনরূপে গড়ে তুলতে হবে অপ্রতিরোধ্য শক্তি। যে শক্তির কাছে ধ্বংস হবে সব অন্যায়, অবিচার, শোষণ-নিপীড়ন। দেবী দুর্গার আগমনে পরাজিত হোক অশুভ শক্তির। গড়ে উঠুক সাম্যের পৃথিবী। অসাম্প্রদায়িক মন-মেধা-মনন। সৃষ্টি হোক শুভক্ষণের।

বিশ্বময় হঠাৎ দেখা দিয়েছে করোনার থাবা। মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে করোনা। যার নিষ্ঠুরতায় প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের। শুধু যে মানুষের প্রাণ কেড়েই ক্ষান্ত থেকেছে কোভিড-১৯ এমন নয়, বরং এর ব্যাপক আক্রোশে স্তিমিত জনজীবন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক নানা পরিবর্তন ঘটেছে পৃথিবীতে। বিশ্বময় পাল্টে গেছে জীবনের চিত্র। দেখা দিয়েছে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, খাদ্য ঘাটতি, স্বাস্থ্যহানির মতো হাজারো সমস্যা। দেবী দুর্গা আসেন বিনাশী শক্তি নিয়ে। তার শক্তির ধারায় বেজে উঠুক প্রাণের বীণা, সঞ্চারিত হোক জনমনে। যার অপার আলোক ছড়িয়ে পড়ুক সবার মনে। করোনাকে রুখতে এই অদম্য শক্তির মতোই মানব জাতিকে নিজেদের অবস্থান অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে হবে। অলস সময় পার না করে সবাইকে কর্মোদ্যোগ হতে হবে। আক্রমণাত্মক মনোভাব পরিহার করতে পারলে করোনার ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

দিনে দিনে বাড়ছে বেকারত্ব। দেখা দিচ্ছে হতাশা, বিষাদ, আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। মানবমনে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। জীবনের পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ নয়। দুর্গম বন্ধুর পথে চলতে চলতে একসময় সৃষ্টি হয় মসৃণ পথের। কিন্তু তার জন্য পাড়ি দিতে হয় অবরুদ্ধ, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ-পরিস্থিতির। বর্তমান তরুণ সমাজ এই পরিস্থিতিতেই হাল ছেড়ে গহীন গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে। তাদের সামনে দুর্গম শক্তির আলোক জ্বালিয়ে ধরা দিক দেবী দুর্গার শক্তি। অমিত তেজোদৃপ্ত হয়ে উঠুক প্রাণ। নিজের মনের অপশক্তির বিরুদ্ধে সৃষ্টি হোক শুভবার্তার। নিজেকে জয় করতে পারলেই জাগবে ভবিষ্যৎ। দেখা দেবে সুদিন।

বিশ্বময় বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধের অশুভ ছায়া পড়ছে অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সপ্তম মাস অতিক্রম করতে চলেছে। দিন যত গড়াচ্ছে রাশিয়ানদের যুদ্ধ প্রতিহত করা আরও কঠিনতর হয়ে উঠছে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ যেভাবে এগিয়ে চলছে তাতে পরিমাপ করা কঠিন এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়? বিশ্বে এর আরও কী কী প্রভাব পড়বে? যুদ্ধের পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য সঙ্কট, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো অনেক সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়বে। শান্তির দূত যদি কারও পক্ষ থেকে না আসে তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে হয়! আলোচনার টেবিলে বসলে চাপ সৃষ্টি হবে দেশের অভ্যন্তরে। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর এ সংকটকালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। বিশ্ববাজারে মন্দা দেখা দেবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে।

ইউক্রেনের যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বে প্রভাব ফেলছে। ইউরোপজুড়ে দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় জনগণের ব্যয় বাড়ছে। জ্বালানির ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যয়ও বাড়ছে। যুদ্ধের তীব্র প্রভাব পড়েছে অন্যান্য রাষ্ট্রেও। পার্শ্ববর্তী সুইডেন, ফিনল্যান্ড রক্ষা পাচ্ছে না ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা থেকে। চরম অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে রাশিয়াতেও। এখন সময় দেবী দুর্গার অসুর দমনের শক্তি নিয়ে কারও আবির্ভূত হওয়ার। যে বা যারা পৃথিবীর এমন দুর্দিনে শান্তির বার্তা নিয়ে আসবে। পৃথিবীর সব দুর্গম শক্তিকে দমন করবে ।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল পড়ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার, গানশিপ ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশের আকাশসীমায়। এ পরিস্থিতি দেশের জন্য ভয়াবহ সংকেত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট  রোহিঙ্গারা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। নারী, পুরুষ, শিশু—কোনো শ্রেণিই বাদ পড়েনি। বন্যার ঢেউ যেমন বাঁধভাঙা গতি নিয়ে আসে, ঠিক তেমনই এ দেশে রোহিঙ্গা ঢুকতে শুরু করে।

এ দেশে রোহিঙ্গাদের আগমনের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে আগস্টের শেষে। দিবসটি ঘিরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মনোযোগ দিতেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতি। তবে সমস্যার আশু সমাধান জরুরি। আর কত বিশ্বের বুকে সুনাম অর্জন করতে গিয়ে নিজ দেশের ওপর শোষণ-নিপীড়ন? বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ সমাজের অনেকেই বেকার। এ সমস্যার সমাধানকল্পে জনগণের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। দেশের ওপর বাড়তি চাপ কমাতে অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তনের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দেশে বর্তমানে ভেতরে ভেতরে গজিয়ে ওঠা মোল্লাতন্ত্রের বিনাশ করতে হবে। ধর্মের নামে মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন করা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। দেশের জনগণের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা, মানসিক বিকলতা দেখা দিচ্ছে। জাতি বেকারত্ব, কর্মহীন যত হবে ততই দেশের মাঝে অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে এই তরুণ-যুব সম্প্রদায়কে কাজে নিয়োজিত করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমজীবী মানুষকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত অনুযায়ী কাজ নির্ধারণ করতে হবে। সবাইকে কাজে উদ্যোগী করতে হবে। বেকারত্ব ঘোচালে দেশের সার্বিক চেহারা পাল্টে যাবে। কাজের মাঝে সময় অতিবাহিত হলে বখাটে, ছিনতাই, চুরি, ভিখারির সংখ্যা কমবে। দেশের মাঝে যেমন অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দূর হবে, তেমনি অন্যায়-অপরাধও কমতে থাকবে।

নারীর প্রতি সুদৃষ্টি গ্রহণ, নারীকে সম্মান-শ্রদ্ধা করাও জাতির জন্য সুদিন বয়ে আনবে। সম্মান পেতে সবাই ভালোবাসে। তেমনই নারীরা যদি তাদের উপযুক্ত সম্মান-মূল্যায়ন পায় সমাজ থেকে তবে অনেক সমস্যা এমনই উবে যাবে। নারী শক্তি সবসময় দুর্গতিনাশিনী। তাই নারীদের অদম্য পরিশ্রম, মেধা, ধৈর্যকে সম্মান করা উচিত প্রত্যেকের। দুর্গা প্রতিবারই কোনো না কোনো আগমনী বার্তা নিয়ে মানবের মাঝে হাজির হয়। এবারের দুর্গার জয় হোক মানবের কল্যাণে। যেখানে বিশ্বময় অস্থিরতা সেই অস্থিরতার বিনাশী শক্তি হয়ে। দেখা দিক দুর্গমকে জয় করে নতুনত্বের অপরিমেয় শক্তিতে। মুক্তি পাক মানুষ। সৃষ্টি হোক মনুষ্যত্ব। জয় হোক মানবতার।

দেবী দুর্গার দুর্গম শক্তির নাগপাশে ধ্বস্ত হোক সব কলুষতা। কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যের বাণীতে নতুনভাবে ধরা দিক পৃথিবী ‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।’

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক।

Link copied!