নারীবিদ্বেষী, অশালীন, অবমাননাকর মন্তব্য করে একবার লজ্জায় ডুবেছেন সদ্য সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। দ্বিতীয়বার তিনি লজ্জায় ডুবলেন দেশত্যাগ করে কানাডায় জায়গা না পেয়ে। প্রথম লজ্জায় তিনি নিজের পাশাপাশি মন্ত্রিসভাকে কলঙ্কিত করেছেন। দ্বিতীয় লজ্জায় তিনি কলঙ্কিত করেছেন মহান জাতীয় সংসদকে। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। ওই পদত্যাগে ভাবা হচ্ছিল মন্ত্রিসভা কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় লজ্জা থেকে গেছে এখনো। কারণ, এখনো তিনি দেশের আইনপ্রণেতা; মাননীয় সংসদ সদস্য।
ডা. মুরাদ হাসান জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য। একাধিকবার তিনি এমপি হয়েছেন, একাধিকবার প্রতিমন্ত্রীও। পৃথক দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তিনি দুইটা দলের রাজনীতিও করেছেন। প্রথমে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, পরে ছাত্রলীগ হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী-পরিবারের সন্তান হয়েও তার ‘জিয়ার আদর্শের’ রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তবে শেষমেশ তার রাজনৈতিক পতন আদর্শিক কারণে হয়নি, হয়েছে চারিত্রিক কারণেই। এ পতন ‘নৈতিক স্খলনের’ কারণে কি না, তা বিতর্কসাপেক্ষ। তবে এ রকমই বৈকি! কারণ, নৈতিক স্খলনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিললে তার সংসদ সদস্য পদই চলে যাওয়ার কথা, সংবিধান অনুযায়ী। আমরা এখনো জানি না এই ‘নৈতিক স্খলনের’ যথাযথ ঘোষণা আসবে কি না?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে উদ্দেশ করে অশালীন ও বর্ণবাদী মন্তব্যের জেরে তার শেষের শুরু। আর শেষটা হয়েছে একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর সঙ্গে হুমকিপূর্ণ একপাক্ষিক অশিষ্ট টেলিফোনালাপে। ওই অভিনেত্রীকে শয্যাসঙ্গী করতে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় একাধিক বাহিনীর নাম উল্লেখপূর্বক তিনি তাদেরকে দিয়ে অভিনেত্রীকে উঠিয়ে আনার হুমকিও দিয়েছিলেন। ধর্ষণের ইচ্ছার কথাও উচ্চারণ করেছিলেন। যদিও ফোনালাপটা নতুন নয়, পুরোনো। তবে এটা যে তার মন্ত্রিত্বকালের—এটা প্রমাণ হয়েছে। অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলতে তিনি যে চলচ্চিত্র অভিনেতার শরণ নিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিও এই টেলিফোনালাপের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি বর্তমানে সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করতে যাওয়া ‘ভিকটিম’ ওই অভিনেত্রীও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক ভিডিওবার্তায় টেলিকথনের সত্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘পরিস্থিতির শিকার’ বলেও দাবি করেছেন।
মুরাদ হাসানের মন্ত্রিত্ব হারানোর কারণ জাইমা রহমানকে উদ্দেশ করে অশালীন ও বর্ণবাদী মন্তব্য, নাকি ফাঁস হওয়া ওই টেলিফোনালাপ— এ নিয়ে যে আলোচনা, তা অর্থহীন। কারণ দুটো জায়গাতেই তিনি নারীর প্রতি অশালীন ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত অন্য ভিডিওগুলোতে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করতে শোনা গেছে। তিনি হলে থাকা ছাত্রীদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও কটূক্তি করেছেন। এছাড়া প্রকাশিত একাধিক ভিডিওতে নানাজনকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য ও আচরণ রয়েছে তার। সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্যের এমন অবস্থা সত্যিই আমাদেরকে পীড়িত করে। বিব্রত করছে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকেও।
টেলিকথন ফাঁস হওয়ার পর সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা যে যথেষ্ট বিব্রত এবং ক্ষুব্ধ, সেটার প্রমাণ মিলেছে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশে। প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত আশাব্যঞ্জক, এজন্য তাকে ধন্যবাদ। ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরের দিন তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। সেদিন রাতেই তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভায় মুরাদ হাসানকে জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় তাকে সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরের দিন মুরাদ হাসানকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ডা. মুরাদ হাসান প্রতিমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদ হারিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা অদ্যাবধি নিয়েছে বলে দেখা যায়নি। তার কর্মকাণ্ডে ‘রাষ্ট্র সংক্ষুব্ধ নয়’ বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয়, তার অধিকার রয়েছে মামলা করার। এটা তো ব্যাপার নয়। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আপনি (প্রশ্নকারী সাংবাদিক) যদি সংক্ষুব্ধ হন, আপনি মামলা করবেন। রাষ্ট্র মামলা করবে কেন? রাষ্ট্র তো সংক্ষুব্ধ নয়।” সারা দেশ, এমনকি বৈশ্বিক বিতর্কিত শিরোনাম হয়ে ওঠা একজন সংসদ সদস্যকে নিয়ে ‘রাষ্ট্র সংক্ষুব্ধ নয়’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে দাবি করেছেন এতে আমরা হতাশ হয়েছি। আমাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে—আর কত নিচে নামলে রাষ্ট্র তবে সংক্ষুব্ধ হয়?
রাষ্ট্র যেখানে ‘সংক্ষুব্ধ নয়’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, সেখানে মুরাদ হাসানকে কানাডা তার দেশে ঢুকতে দেয়নি। তিনি সাধারণ সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ওই দেশে যাননি, গিয়েছেন সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়া কূটনৈতিক (ডিপ্লোম্যাটিক) পাসপোর্টে। সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়া বিশেষ ওই পাসপোর্টের মর্যাদা তবে থাকল কোথায়, যেখানে তার ভিসাও ছিল। তিনি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আগেও কানাডা সফর করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়লেও জাতীয় সংসদের একজন সদস্যের পরিচয়েই তিনি এবার কানাডা গেলেন। কিন্তু তার প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। ভিসা আছে, তবু কেন প্রত্যাখ্যাত তিনি? কারণ নিশ্চয় একটাই—তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড! অর্থাৎ কেবল তিনি দেশেই বিতর্কিত নন, তার কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। তাই জায়গা মেলেনি কানাডায়। এটা কি তার ব্যক্তিগত লজ্জা নয়? এটা কি আওয়ামী লীগের লজ্জা নয়? এটা কি সরকারের লজ্জার অংশ নয়? এটা কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্ক নয়?
ধারণা করছি, এত সব কর্মকাণ্ডে ডা. মুরাদ হাসানও অনুতপ্ত। প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানোর পর সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। এই ক্ষমা চাওয়ার পরপরই দেশত্যাগ করে নিজেকে আড়াল করার যে চেষ্টা ছিল তার সেটা সফল হয়নি। উল্টো আবার লজ্জায় ডুবেছেন, ইজ্জতহানি করেছেন মহান জাতীয় সংসদের। লজ্জায় ডুবিয়েছেন পুরো দেশকে। একজন সাধারণ নাগরিকের কানাডা কিংবা অন্য কোনো দেশে ঢুকতে না পারা যেখানে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, সেখানে তার এই ব্যর্থতা স্রেফ ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে থাকেনি, রূপ নিয়েছে রাষ্ট্রীয় লজ্জায়। নিকট অতীতে আরেক সংসদ সদস্য (পরে সংসদ সদস্য হারানো) কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতের আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে দেশকে লজ্জার মুখে ফেলেছিলেন। এবার লজ্জায় ফেললেন ডা. মুরাদ হাসান এমপি।
দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী সংসদ সদস্য ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র সংক্ষুব্ধ নয়’ এমন মন্তব্য আমরা মানতে পারছি না। ধর্ষকামী প্রবৃত্তির কেউ দেশের আইনপ্রণেতার পদে থাকবে, এটাও মেনে নেওয়া কষ্টের। তাই তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবার জাতীয় সংসদকে কলঙ্কমুক্ত করুন।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক