ডেনিস লিলির শহর পার্থ। তার প্রিয় মাঠ ওয়াকা। যেখানে আর কোনো দিন টেস্ট ক্রিকেট হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কর্তারা। কারণ আরও আধুনিক এবং বড় পরিসরে নির্মাণ করা হয়েছে পার্থ স্টেডিয়াম। কিন্তু ওয়াকা? যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে কত ক্রিকেটীয় ঐতিহ্য-প্রাচুর্য আর খণ্ড খণ্ড ইতিহাস।
যার বড় স্ট্যান্ডের গায়ে লেখা—লিলি-মার্শ স্ট্যান্ড। পুরো মাঠে এত কিছু সংরক্ষণ করা, যার কোনটা বাদ দিয়ে কোনটার কথা বলবেন। স্যার ডনের নামে এখানে ব্র্যাডম্যান বলরুম আছে। আছে আরও অনেক কিছু। কিন্তু আমরা যারা রেডিওতে ক্রিকেট শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে ওয়াকা মানে বাউন্স আর গতির উইকেট। যেখানে লিলি-টমসন প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতেন গতি-ঝড়ে! স্কোরকার্ডের পাতা ওল্টালে কুইজের মতো মনে হয়, ‘কট মার্শ বোল্ড লিলি...!’ কত ব্যাটারের নামের পাশে এই প্রাণ সংহারক হিসেবে ওই জুটির নাম লেখা আছে? প্রাক্-হেলমেট যুগে যারা লিলিকে সামলেছেন, তাদের অন্যতম সুনীল গাভাস্কার। লিলির বল হাতে ঔদ্ধত্যের জবাব ব্যাট হাতে দিয়েছেন ভিভ। সেই লিলির প্রথম সাক্ষাৎকারের সুযোগ পেয়েছিলাম চেন্নাইয়ে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে। সুযোগটা করে দিয়েছিলেন টি আই শেখর। ভারতের এই সাবেক ক্রিকেটার এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের রাহুল-সজল চৌধুরী-মোর্শেদ আলী খানদের কিছুদিনের জন্য কোচিং করিয়েছেন লিলি। কিন্তু তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। কিন্তু তারপরও তাদের সম্পর্কে লিলির ধারণাটা খুব উঁচু ছিল। ওরা কেন পারছেন না, সে সময় সেই প্রশ্নটাও করেছিলেন লিলি।
২৪ বছর পর সেই লিলির শহরে এসে তন্নতন্ন হয়ে তাকে খোঁজার চেষ্টা। যার শহরে বিশ্বকাপের ম্যাচ হচ্ছে, অথচ তিনি নেই কোথাও! ওয়াকায় গিয়েও লিলিকে পাওয়া গেল না। শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া খেলছে ওসমান খাজার কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে। লিলি-মার্শ স্ট্যান্ডে কত দর্শক! যে অ্যাগার জাম্পার বদলে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, জাম্পা ফেরার পর অ্যাগার ফিরলেন তার ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া দলে শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে! অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সংস্কৃতিটাই ও রকম। জাতীয় দলে দরকার নেই। তাহলে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে নেমে পড়তে হবে! সময় নষ্ট করা যাবে না। সেই ম্যাচে ওয়াকায় দেখা রডনি নন। অন্য এক মার্শের সঙ্গে। যার বড় ছেলে শন খেলছেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। আবার সন্ধ্যায় ব্রিসবেনে আরেক ছেলে নামলেন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলতে। আমাদের দেশে হলে এই বাবা ছুটতেন কোথায়? বিশ্বকাপ খেলছে ছেলে নিজের দেশে, কিন্তু তিনি ভাবলেশহীন! সন্ধ্যায় বাড়িতে গিয়ে টিভিতে দেখলেন ছোট ছেলের খেলা! তার মুখে আশা, আশঙ্কা, হতাশা, স্ফূর্তি কোনো কিছুর ঢেউ খেলে না! যেমন পার্থ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া সোয়ান নদীকেও একই রকম নিস্তরঙ্গ মনে হলো!
প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে যারা বড় হয়েছেন, সোয়ান নদী তাদের কাছে লেকই মনে হয়। জিওফ মার্শের কাছে বিশ্বকাপ ম্যাচও যেন তাই। নিজে বিশ্বকাপ জিতেছেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ’৮৭তে। অ্যালান বর্ডারের বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ডেভিড বুনের ওপেনিং পার্টনার ছিলেন। এরপর স্টিভ ওয়ার বিশ্বকাপজয়ী দলের (১৯৯৯) কোচ হিসেবে বিশ্বকাপের মেডেল তার বাড়িতে। আর সেই আরও দুটো বিশ্বকাপের মেডেল এসেছে। ছোট ছেলে মিশেল মার্শ ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন। ২০২১ দুবাইতে জিতলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। মার্শ পরিবারে চার-চারখানা বিশ্বকাপ মেডেল!
কিন্তু চার না সংখ্যাটা আরও বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন সিনিয়র মার্শ। ‘আমার নাতি, শনের ছেলে অস্টিন, অস্টিন মার্শও হয়তো একদিন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ জিতবে।’ আশা জিওফ মার্শের।
মার্শ পরিবারের ক্রিকেটীয় সাফল্য সত্যিই ঈর্ষণীয়। কিন্তু তার থেকে বেশি ঈর্ষণীয় মনে হলো জিওফ মার্শের নির্লিপ্ত থাকার অসাধারণ ক্ষমতাকে! আসলে অস্ট্রেলিয়ানরা আমি নয়, আমরাতে বিশ্বাসী। তাই জিওফ মার্শ বলতে পারেন, ‘আমরা বিশ্বকাপ জিতেছি। ভবিষ্যতে আরও জিততে চাই। সেই কাপ জয়ে যদি আমাদের (মার্শ পরিবার) এর একটা পরম্পরা খুঁজে পায় আগামীর ইতিহাসবিদরা। তাহলে বলতে পারব ক্রিকেট খেলে ভুল কিছু করিনি।’
আমারও মনে হলো বিশ্বকাপ কাভার করতে এসে যেখানে বাংলাদেশের কোনো খেলা নেই, সেই পার্থে পা রেখে খুব একটা ভুল হয়নি!
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট