ভাইরাল হওয়ার একটা ক্রেজ চারদিকে। রাষ্ট্রীয় বহু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যেমন দেশের বড় বড় দুর্নীতি, অপরাধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, বাজেট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিচার ব্যবস্থা, ট্রাফিক জ্যাম, বেকারত্ব নিয়ে নেটিজেনরা অতো পোস্ট না দিলেও, চটুল ও রসালো ইস্যু নিয়ে সব সময়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত। ভাইরাল হওয়ার জন্য ইচ্ছে করেই এমন ভিডিও তৈরি করা হয়। কেননা, স্বাভাবিক পোস্ট দিলে দর্শকদের তেমন নজর কাড়ে না, তেমন আলাপ আলোচনাও হয় না। এ কারণেই অসম বয়সের প্রেম, বিয়ে, বেসুরো গলায় গান, বারবার ডিভোর্স, ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস—এ ধরনের অর্থহীন ভিডিও বা পোস্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব ভাইরাল পোস্টের ভার নেটিজেনরা কতটুকু নিতে পারছেন?
সেলিব্রেটিদের পান থেকে চুন খসে গেলেও তারা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যান। আজকাল সাংবাদিকেরাও আসল সংবাদ অনুসন্ধান বাদ দিয়ে, কোন সেলিব্রেটি ওজন কমিয়ে শুকিয়ে গেলেন, কার পাশে কে দাঁড়িয়ে নাচলেন, কে কার দিকে কীভাবে তাকালেন, কার শাড়ির আঁচল একটু সরে গেলো, কার অডিও বা ভিডিও লিক হলো, ইত্যাদি সব অপ্রয়োজনীয় খবর মিডিয়াতে নিয়ে আসেন। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়, এ ভিডিওগুলো। এমন কি শিশু সেলিব্রেটিরাও এ থেকে রক্ষা পায় না, সামান্য ‘কেন্দে দেওয়া’ উচ্চারণ ভুলের জন্যও সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেলিব্রেটিরা সবসময় আলোচনা, সমালোচনায় থেকে অভ্যস্ত। তাই মানসিকভাবে এসব ঝড় কাটিয়ে তারা আবারও স্বাভাবিকভাবে কাজে আসতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন তো তেমন নয়। ভাইরাল হওয়ার পর সবার জীবন একইভাবে বয়ে চলে না। তেমন কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক বরং।
অসম বয়সের প্রেম ও বিয়ের মতো ব্যক্তিগত ঘটনা মিডিয়ার আলোচিত বিষয় হতে পারে কিনা, এটি নিয়ে নৈতিক বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এভাবেই অনেকে রীতিমতো ভাইরাল। আলোচনা, সমালোচনার ঝড় সব সময় সাধারণ মানুষ বহন করতে পারে না। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক বছর আগে, একজন কলেজ শিক্ষিকার রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। মিডিয়াতে তাদের ব্যক্তিগত ঘটনা এভাবে ভাইরাল না হলে, এত আলোচিত না হলে হয়তো এমনটা নাও ঘটতে পারতো। সম্প্রতি একাধিক স্ত্রী নিয়ে সুখী জীবন যাপনের ব্যক্তিগত ঘটনাগুলোও মিডিয়ার ভাইরাল ইস্যু। এ ঘটনাগুলো প্রচার করে মিডিয়া কি এক অর্থে বহুবিবাহ, বহুগামিতার প্রচারণাই চালাচ্ছে না? এ ধরনের খবরগুলো ভাইরালের পর সম্প্রতি এক সুখী দম্পতি সামাজিক হেনস্তার শিকার হয়, স্বামীকে নিয়ে সুখী ছিলেন, দুজন স্ত্রীকে ঘরছাড়া করা হয়।
ভাইরাল হওয়ার জন্য অনেকে ইচ্ছে করেই শিশুদের নিয়ে নানান কনটেন্ট তৈরি করেন, যা প্রায় সময়ই শিশুর উপযোগী নয়। ভাইরাল হওয়ার পর এই শিশুদের জীবনটা আর স্বাভাবিক থাকে কি? নেটিজেনরা ভেবে দেখতে পারেন। ভাইরাল হওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভিডিও যেমন, অতিরিক্ত গতিতে বাইক চালানো, বিপজ্জনক স্থানে ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে প্রচুর টিকটকার দুর্ঘটনার শিকার হন। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভিডিও সমাজে কোনো পজিটিভ বার্তা দেয় না। তবুও এগুলোই ভাইরাল হওয়ার সহজ তরিকা। সম্প্রতি এক জনপ্রিয় টিকটকার এমন ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান।
প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করেও বেশ কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়। কোরবানির জন্য কেনা গরু প্রাণ ভয়ে ব্যস্ত রাস্তায় দৌড়ে যাচ্ছে, যেকোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। সেই প্রাণীটির তো বটেই, অন্যদেরও জানমালের ক্ষতি হতে পারে। তবুও ভাইরাল হওয়ার নেশায় ইচ্ছে করেই একটি প্রাণীকে এমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, ভয় দেখিয়ে ভিডিও করা হয়। প্রাণীর প্রতি এমন নির্মমতাও নেট দুনিয়ায় স্রেফ হাসির খোরাক। এরই আরেক ভাইরাল উদাহরণ, একটি দুলন্ত দড়িতে বিপজ্জনকভাবে একটি বিড়ালকে সামনের দুই পায়ে ঝুলিয়ে দিয়ে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘পাঞ্ছি বানো ওড়কে চালো মাস্তো গগন মে’ গান বাজানো। অথচ বিড়ালটির এভাবে দড়িতে ঝুলতে যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি সে প্রচণ্ড ভয়ও পাচ্ছে।
ভাইরালের সবটাই যে সবসময় নেতিবাচক, তা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এক ইনফ্লুয়েন্সারের পরিবারের ঋণখেলাপী ও তাদের পানীয়ের কারখানায় যথাযথ হাইজিন ব্যবস্থা না থাকার ঘটনাগুলো ভাইরাল হয়েছে। যদিও এতে কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে জরিমানা, মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়নি। শুধু সাময়িক ভাইরাল রসালো খবর হয়েই তা রইলো।
শেষ পর্যন্ত তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, ভাইরালের ভার কি নেটিজেনরা আসলেই বহন করতে পারছেন?
লেখক : শিক্ষক ও লেখক
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































